০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৪:২৯

জামায়াত যে কারণে ইসলামপন্থী দলগুলোর জোট গড়ার চেষ্টা করছে

গণমাধ্যমের সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান  © সংগৃহীত

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন মাথায় রেখে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘এক মঞ্চ’ বা ‘প্ল্যাটফর্মে’ আনা যায় কি না, তা নিয়ে দলের ভেতরে ও বাইরে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

দলটির নেতারা বলছেন, ‘৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করতে হবে’, এটাকে ‘থিম’ ধরে ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ‘মতবিনিময়’ শুরু করেছেন তারা, যার মূল লক্ষ্য হলো পরবর্তী সংসদ নির্বাচন।

এসব রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি ইসলামপন্থী দলের অল্প পরিসরে হলেও নিজস্ব অবস্থান আছে এবং এর আলোকে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘সময় ও অবস্থানভেদে’ তাদের কিছুটা প্রভাবও তৈরি হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের প্রভাব আছে রাজনীতিতে কিন্তু তারা এককভাবে নির্বাচনি রাজনীতিতে আগে কখনো তেমন সফলতা পায়নি। আর এখন নতুন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। ফলে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের কথা চিন্তা করেই হয়তো ধর্মভিত্তিক দলগুলো একজোট হওয়ার চিন্তা করছে।

প্রসঙ্গত, স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। সেই সুযোগ নিয়ে তখন নিষিদ্ধ ইসলামপন্থী কয়েকটি দল রাজনীতি শুরু করেছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকারের অংশ হয়েছিল জামায়াত।

আরও পড়ুন: পদত্যাগ করলেন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য আবুল কালাম

দেশে এ মুহূর্তে ১১টি ইসলামপন্থী দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। তবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনের বিষয়টি আদালতের সিদ্ধান্তে আটকে আছে। ২০১৩ সালে হাইকোর্ট এ নিবন্ধন বাতিল করেছিলেন।

সাধারণত নির্বাচন এলে বরাবরই ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে তৎপরতা বেড়ে যায়, তবে এবারই প্রথম জামায়াত ইসলামী নিজেই এ ধরনের দলগুলোকে এক প্ল্যাটফর্মে আনা যায় কি না, তা নিয়ে উদ্যোগ নিয়েছে।

দলটির মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ অবশ্য বলছেন, তার দল আগেও অনেকবার এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘গোলাম আযমের (দলটির সাবেক আমির) সময় থেকেই ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী দলগুলোকে নিয়ে এমন চিন্তা হয়েছে। আর জামায়াত শুধু নির্বাচন নয় সামগ্রিক বিষয়েই গুরুত্ব দেয়। সে কারণেই ঐক্যের চেষ্টা শুরু হয়েছে।’

এখন উদ্যোগ কেন, কারা আছে
জামায়াত যাদের সঙ্গে আলোচনা বা মতবিনিময় করেছে, এমন কয়েকটি দল জানিয়েছে, মূলত আগামী নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলোকে এক মঞ্চে আনা বা এক জায়গায় নিয়ে আসাই এবারের উদ্যোগের মূল লক্ষ্য বলে তাদের কাছে মনে হয়েছে।

দলটির সূত্রগুলো বলছে, ইতোমধ্যেই ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন, লেবার পার্টি, ১২ দলীয় জোট, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল এবং কয়েকজন ইসলামি ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন জামায়াতের নেতারা।

প্রসঙ্গত, তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত আন্দোলন, মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামিক ফ্রন্ট, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, খেলাফত মজলিস এবং ইনসানিয়াত বিপ্লবের নাম নিবন্ধিত দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে আছে।

আরও পড়ুন: জনগণ আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চায় না: ড. ইউনূস

আবার ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর সেনাপ্রধান জামায়াতে ইসলামী, হেফাজত ও খেলাফত মজলিসের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর এই ঘরানার রাজনীতি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে বলেও অনেকে মনে করেন। এর বাইরে ইসলামী আন্দোলন রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়।

দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল, এমন কয়েকটি ইসলামি দলকে বাদ দিয়ে বাকিদের নিয়ে একত্র হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা করছেন তারা।

তিনি বলেন, ‘পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে সামনে নির্বাচনপ্রক্রিয়া কেমন হয় তার ওপর। তবে ইসলামি সংগঠনগুলোর উপলব্ধি হলো মাঠের জনগণ চায় আমরা এক হই। এটাকে বিবেচনায় নিয়ে কথাবার্তা চলছে। তবে কোন ফরম্যাটে কী হবে তা নির্ভর করবে নির্বাচন কেমন হয় তার ওপর।’

আবার কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও সংগঠনটির নেতাদের অনেকেই বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলছেন, দলগুলোর মধ্যে আলোচনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আলোচনা-পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। দেখা যাক কী হয়। এখনো বলার মতো কোনো পর্যায় আসেনি।’

একই ধরনের কথা বলেছেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আলোচনার প্রক্রিয়ায় আমরা আছি। তবে চূড়ান্ত কিছু হয়নি।’

আরও পড়ুন: যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার কাজ শেষে নির্বাচন: ড. ইউনূস

তবে জামায়াতের উদ্যোগে ঐক্য প্রক্রিয়ার আলোচনায় ইসলামপন্থী দলগুলো অংশ নিলেও কয়েকটি দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর কিছু লেখা বা বক্তব্য নিয়ে আপত্তি আছে। সেগুলোর সুরাহা কীভাবে হবে, সেই প্রশ্নও আছে অনেকের মধ্যে।

জামায়াত উদ্যোগ নিলো কেন
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ পর্যায়ে এসে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হলেও শেখ হাসিনার বিদায়ের তিন সপ্তাহের মাথায় অন্তর্বর্তী সরকার সে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। তারও আগে শেখ হাসিনার বিদায়ের পরপরই সেনাপ্রধান যাদের সঙ্গে নতুন সরকারের বিষয়ে আলোচনা করেছেন, সেখানে জামায়াতের আমিরও উপস্থিত ছিলেন।

দলটির মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলছেন, এখন তারা যেটি চাইছেন, সেটি হলো ইসলামি ভাবধারা বা আদর্শে বিশ্বাসীদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন বা এ ধরনের সবাইকে এক জায়গায় নিয়ে আসা।

যদিও অনেকে মনে করেন, আগামী নির্বাচনে কোনো কারণে আওয়ামী লীগ অংশ না নিলে কিংবা অংশ নিতে না পারলে জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ‘ইসলামি শক্তি’র প্রধান বিরোধী দল হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে।

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ২০-দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার পর থেকে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে বিএনপি।

আরও পড়ুন: গণহত্যাকারীদের রাজনীতি করার অধিকার নেই: ডা. শফিকুর রহমান

এরপর ২০-দলীয় জোটের দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করলেও জামায়াতের সঙ্গে দলটির প্রকাশ্যে আর সম্পর্ক গড়েনি। এমনকি ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও দল দুটির পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টিতে এসেছে।

বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, ইসলামপন্থী দলগুলো এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে এবং সে জন্যই তারা হয়তো মনে করতে পারে যে জোটবদ্ধ থাকলে নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের শক্তি আরও দৃশ্যমান হবে।

যদিও বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন কবে হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনসহ কয়েকটি বিষয়ের সংস্কার কাজ সম্পন্ন করতে চায় তারা।

অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অবশ্য শুরু থেকেই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে।

অন্যদিকে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বরাবরই সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে নতুন সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষে মত দিয়ে আসছেন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা