বৈষম্য হ্রাস করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিসর বৃদ্ধির আহ্বান
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:১৭ PM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:১৭ PM
গত কয়েক শতকে বাংলাদেশ সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, কিন্তু সে অর্জনের সুফল সবার ঘরে পৌঁছায়নি। যার প্রেক্ষিত অরক্ষিত ও বঞ্চিতদের জন্য নেয়া হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি/সামাজিক সুরক্ষা। বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা বহুবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ এ খাতে ব্যয় হলেও কর্মসূচিসমূহের প্রকৃত প্রভাব প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র (এনএসএসএস) নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। তবে কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীদের বাছাই প্রক্রিয়া এবং সুবিধাসমূহ বণ্টনে সুষ্ঠুতা, অনিয়ম ও বৈষম্য রয়েছে। এছাড়া সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে বাস্তবায়নাধীন এসব কার্যক্রমের যথাযথ মনিটরিং হয় না; পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ের পরে উপকারভোগীর অবস্থান মূল্যায়ন এবং মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী পরিকল্পনা প্রণয়নেরও তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা ব্যবস্থা নেই। ফলে সংখ্যাগত দিক থেকে কত মানুষের দারিদ্র্য অবস্থার উন্নয়ন হলো বা হলো না, তারও যথাযথ বা সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) ঢাকার দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হলে এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ওয়েভ ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি: বৈষম্য ও অধিকার’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে বক্তারা এসব বলেন। ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলীর সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাকিয়া আফরোজ, পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব), মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। এছাড়া সম্মানীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ, চেয়ারম্যান, ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ড. শহীদুল ইসলাম জাহিদ, অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ড. এস এম জুলফিকার আলী, গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান; ড. মাহফুজ কবীর, গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ; আইয়ুব খান, উপ-পরিচালক (নিবন্ধন) সমাজসেবা অধিদপ্তর; আমানুর রহমান, চিফ অব পার্টি, থ্রিভ এক্টিভিটি, কেয়ার বাংলাদেশ। সংলাপে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. আসিফ এম. শাহান, সহযোগী অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকল্পের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন মীর মোস্তাক আহমেদ, প্রকল্প সমন্বয়কারী, ওয়েভ ফাউন্ডেশন এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন ও সঞ্চালনা করেন কানিজ ফাতেমা, উপ-পরিচালক, ওয়েভ ফাউন্ডেশন। এছাড়াও যুব ও ছাত্র প্রতিনিধি; লোকমোর্চা ও প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী; নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ এতে অংশগ্রহণ করেন এবং মুক্ত আলোচনায় তারে মতামত ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।
সংলাপে সভাপতির বক্তব্যে মহসিন আলী বলেন, ওয়েভ ফাউন্ডেশন টেকসই উন্নয়ন; জলবায়ু ন্যায্যতা; সুশাসন, অধিকার ও ন্যায্যতা এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে সাফল্য এসেছে সেক্ষেত্রে আমাদের পদ্ধতিগত সংস্কার এবং তা বাস্তবায়ন সময়ের দাবী। সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়া, নগর এবং পার্বত্য অঞ্চলে যথেষ্ট বরাদ্দ বৃদ্ধি, স্থানীয় সরকারের কাঠামো সংস্কার, জবাবদিহিতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের আরো কাজ করে যেতে হবে। প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ড. আসিফ এম. শাহান বলেন, ২০১৫ সালে ‘জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল বা এনএসএসএস গৃহীত হয়। এনএসএসএস প্রবর্তনের ৯ বছর পরেও বিপুল সংখ্যক লোক এখনও এই কর্মসূচির আওতায় আসেনি। জাকিয়া আফরোজ বলেন, সরকার নারী ও শিশু সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। তবে কর্মসূচি বাস্তবায়নে এখনও নিড অ্যাসেসমেন্ট হয়নি। যার ফলে আমাদের প্রকৃত উপকারভোগীর সংখ্যা নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সুবিধাভোগী সিলেকশনের ক্ষেত্রে সঠিক মানুষকে সিলেকশন করতে পারাটাও বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা ২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা বাজেট পেয়েছি। ১০ লাখ ৪৪ হাজার লোক এ সুবিধা পাচ্ছে। প্রতিবছর ১০ শতাংশ করে সুবিধাভোগী বাড়ানোর কথা কিš‘ বাজেট সল্পতার জন্য সেটা সম্ভব হয় না। মহিলাদের মধ্যে যাদের আর্থিক সহায়তা করা হয় অনেক সময় দেখা যাচ্ছে তাদের ব্যাংক একাউন্ট থাকে না। তাদের স্বামী অথবা পরিবারের কারো একাউন্টে টাকা নেয়। ফলে সরাসরি সে টাকাটা পাচ্ছে না। আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যেন সরাসরি তারা টাকাটা পায়। অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেন, আমরা সামাজিক সুরক্ষা কাকে দিতে চাচ্ছি, প্রকৃত উপকারভোগী লক্ষ্য অনুসারে কর্মসূচির আওতায় আসছে কিনা এ বিষয়গুলো অস্পষ্ট। গণতান্ত্রিকভাবে আমরা সামস্টিক সমাধানের লক্ষ্যে বরাদ্দ; উপজেলা পর্যায়ে দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান; সুষ্ঠু বন্টনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত; নির্বাচিত প্রতিনিধিদের রাখা; গ্রামীণ উন্নয়ন সভা বাস্তবায়ন, সর্বোপরি মানবিক সমাজব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে চাই।
ড. শহীদুল ইসলাম জাহি বলেন, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র উত্তরণে আমাদের মত প্রকাশের অধিকার আছে কিনা তা এখন আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনে শুধু মৌলিক চাহিদার কথা চিন্তা করলে হবে না, সামগ্রিক প্রেক্ষাপটও বিবেচনা করতে হবে। সেজন্য দায় দায়িত্ব কেবল সরকারের নয় বরং আত্ম উন্নয়নে নিজেকে এগিয়ে নিতে হবে।
ড. এস এম জুলফিকার আলী বলেন, আমরা এখনো উপকারভোগী ঠিকমতো বাছাই করতে পারি না সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের ক্ষেত্রে। বর্তমান সরকারের এখন একটা সুযোগ এসেছে নির্মোহভাবে এ তালিকা তৈরির ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের। নিরাপত্তা বেষ্টনির সেবাগুলোকে যত ডিজিটালাইজেশন করা যাবে, বাস্তবায়ন ও জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া তত স্বচ্ছ হবে। এ কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের জন্য দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে। ড. মাহফুজ কবীর বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিসর বিস্তৃত। আমাদের মৌলিক এবং গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন। বাস্তবায়ন এবং প্রকৃত উপকারভোগীদের নির্বাচনে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান এবং প্রকৃত উপকারভোগী প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা বলয়ে যে কমিটি আছে সেখানে ভবিষৎ প্রজন্মের প্রতিনিধি থাকতে হবে। ২০২৬ সালের সামাজিক উন্নয়ন কৌশলগত নির্দেশিকায় আমারে চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণে কথাগুলো সন্নিবেশিত করতে হবে।
আইয়ুব খান বলেন, ১ কোটি ২৫ লক্ষ মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা বলয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সরকার ভাতা প্রদানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে জিটুপি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে প্রকৃত উপকারভোগী নির্বাচনে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেজন্য সকলের সহায়তা প্রত্যাশা করছি।
আমানুর রহমান বলেন, বাংলােেশর সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচিগুলো সর্বজনীন করে জনগণের অংশগ্রহণ এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে সম্পৃক্ত করে অভিযোগের মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে।
অনুষ্ঠিত জাতীয় সংলাপে উত্থাপিত সুপারিশসমূহ হলো: সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; প্রকৃত উপকারভোগীরে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা; সংস্কারের ক্ষেত্রে দায় এবং দরকে গুরুত্ব দেওয়া; সরকারি পর্যায়ে খসড়া সামাজিক সুরক্ষা কৌশলগুলোর অনুমোদন; চাহিদা বিবেচনায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ঢেলে সাজানো; স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসূচিসমূহ বাস্তবায়নের জন্য একটি স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং সেবাগ্রহীতাদের উত্তরণে একটি সুস্পষ্ট দিক-নির্শেনাসহ শক্তিশালী মনিটরিং ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিশ্চিত করা; সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসমূহের ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা (জিআরএস) সহজতর ও কার্যকর করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা; সামাজিক সুরক্ষাসহ সরকারি বিভিন্ন সেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রচারের জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনসমূহের সহায়তা গ্রহণ এবং বেসরকারি সংগঠনগুলোরও এ সংক্রান্ত প্রচারাভিযান অব্যাহত রাখা; নগর দরিদ্রদের চাহিদা বিবেচনায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ঢেলে সাজাতে হবে; সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগী বাছাইকরণ প্রক্রিয়ায় যে ডিজিটালাইজেশন শুরু হয়েছে তার সুফল পেতে হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে; সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রাপ্তিতে যে অধিকার রয়েছে সে বিষয়ে এনজিওদের ক্যাম্পেইন কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে; এনজিওদের সহায়তা দিয়ে সরকারের অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হবে; শহরাঞ্চলের জন্য বিশেষ করে নগর রিদ্রদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ, সঠিক উপকারভোগীদের নিকট পৌঁছানোর জন্য কর্মসূচিসমূহকে যথাযথভাবে জিজিটালাইজ করা; একইসাথে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়লেও পরিমাণ না বাড়ায় দেশের দরিদ্র থেকে নিম্ন মধ্যবিত্তদের পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা এক বিরাট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।