রাসেল ভাইপার: বাংলাদেশে প্রায় বিলুপ্ত হওয়া বিষধর সাপ কীভাবে ফিরে আসছে

বিষধর রাসেল ভাইপার সাপ
বিষধর রাসেল ভাইপার সাপ  © সংগৃহীত

বিষধর রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ে মারা গেছেন শাকিনুর রহমান সাব্বির নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায়। রবিবার (৫ মে) পদ্মা নদীর তীরে তিনি সাপের কামড়ে আক্রান্ত হলে পরে সোমবার (৬ মে) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

এর আগেও বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকায়, বিশেষ করে পদ্মা তীরবর্তী কয়েকটি জেলা ও চরাঞ্চলে এই সাপের কামড়ে মারা গেছেন কয়েকজন।

রাসেলস ভাইপার সাপ বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে যেসব সাপ দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বিষাক্ত।

আরও পড়ুন: রাসেল’স ভাইপারের কামড়ে প্রাণ গেল রাবি শিক্ষার্থীর 

এই সাপের কামড়ে শরীরের দংশিত অংশে বিষ ছড়িয়ে অঙ্গহানি, ক্রমাগত রক্তপাত, রক্ত জমাট বাঁধা, স্নায়ু বৈকল্য, চোখ ভারী হয়ে যাওয়া, পক্ষাঘাত, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন রকম শারীরিক উপসর্গ দেখা যেতে পারে।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সাপের এই প্রজাতিটি বাংলাদেশ থেকে বহু বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু গত ১২-১৫ বছর আগে থেকে আবারো এই সাপের কামড়ের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই প্রজাতির সাপ এই অঞ্চলে আবার কীভাবে ফিরে আসছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে গবেষণা চলছে।

কীভাবে ফিরে আসছে রাসেলস ভাইপার
বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপারের পুনরাবির্ভাব ও এই সাপ থেকে মানুষের ঝুঁকির বিষয়ে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আহসান মনসুর। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ২০টি রাসেলস ভাইপার দংশনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে করা গবেষণাটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইাটি, বাংলাদেশে।

সেসময় ঐ গবেষণায় উঠে আসে যে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৭টি জেলাতেই রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি রয়েছে। ঐ গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতেই এই সাপের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল।

ঐ গবেষণায় উঠে আসে যে এই প্রজাতির সাপের সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি ছিল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। তবে বর্তমানে আরো বেশি এলাকায় এই প্রজাতির সাপের উপস্থিতি রয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অধ্যাপক আহসান মনসুর ধারণা প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বল্প সংখ্যক রাসেলস ভাইপার সবসময়ই ছিল, কিন্তু বংশবিস্তারের মত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকায় এই সাপের উপস্থিতি তেমন একটা বোঝা যায়নি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে এই সাপের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল ফলানো- মন্তব্য করেন অধ্যাপক আহসান।

“আগে কৃষিজমিতে বছরে একবার বা দুইবার ফসল ফলানো হত এবং বাকি সময় পানির অভাব থাকায় জমি পরিত্যক্ত পড়ে থাকতো। ৯০' এর দশকে সেচ পদ্ধতির উন্নতির সাথে সাথে কৃষকরা বছরে দুই থেকে তিনটি ফসল ফলানো শুরু করেন এবং জমি কম সময় পরিত্যক্ত থাকতে শুরু করে।”

“সারা বছর ক্ষেতে ফসল থাকায় জমিতে ইঁদুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যা এই সাপের প্রধান খাদ্য। আর ইঁদুর বাড়ার সাথে সাথে সাপ পর্যাপ্ত খাদ্য পেতে শুরু করে এবং বংশবিস্তারের জন্য যথাযথ পরিবেশ পেতে থাকে,” বলেন অধ্যাপক আহসান।

ঘন ঝোপ আর পরিত্যক্ত জমি অপেক্ষাকৃত কমে যাওয়ায় এই সাপ কৃষি জমিতেই থাকে, যার ফলে যারা মাঠে কৃষিকাজ করেন তারা রাসেলস ভাইপারের দংশনের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়ে থাকেন। এছাড়া বর্ষাকালে নদীর পানি বাড়ার ফলে ভারতের নদ-নদী থেকে ভেসেও এই সাপ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে বলে জানান অধ্যাপক আহসান।

“এখন পর্যন্ত পদ্মা অববাহিকায় এই সাপ সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। আমরা দেখেছি যেসব জায়গায় এই সাপ পাওয়া গেছে তার অধিকাংশ জায়গাতেই কচুরিপানা রয়েছে, আবার কচুরিপানার মধ্যেও এই সাপ পাওয়া গেছে। কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি কচুরিপানার ওপরে ভেসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এই সাপ বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছেছে।”

মূলত বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতির সবচেয়ে বেশি প্রমাণ পাওয়া গেলেও সম্প্রতি দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পটুয়াখালীতেও এই সাপের দেখা মিলেছে বলে জানান অধ্যাপক ফরিদ আহসান।

এছাড়া ২০১৪ ও ২০১৫ সালে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি চর এলাকায় বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা অন্তত পাঁচটি রাসেলস ভাইপার সাপ অবমুক্ত করা হয়।

তবে অধ্যাপক আহসান মনে করেন অবমুক্ত করা অল্প কয়েকটি সাপ বাংলাদেশে এই প্রজাতির সংখ্যা বাড়ানোর পেছনে খুব বেশি ভূমিকা রাখেনি।

কতটা মারাত্মক এই সাপের দংশন
বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপারের দংশনের হার খুব বেশি না হলেও ভারতে প্রতি বছর যে পরিমাণ সর্প দংশনের ঘটনা ঘটে তার মধ্যে অন্তত ৪৩% এবং শ্রীলঙ্কায় প্রতি বছর মোট সর্প দংশনের ঘটনার ৩০-৪০% রাসেলস ভাইপারের কারণে হয়ে থাকে।

সাধারণত কৃষি জমিতে থাকে বলে মানুষ অনেক সময়ই সাপের গায়ে পা দেয় বা না জেনে একে বিরক্ত করে থাকে। আর রাসেলস ভাইপার বিপন্ন বোধ করলে আচমকা আক্রমণ করে থাকে।

এই প্রজাতির সাপের কামড়ের কিছুক্ষণ পরই দংশিত স্থানে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। ব্যাখার পাশাপাশি দংশিত স্থান দ্রুত ফুলে যায় এবং ঘণ্টা খানেকের মধ্যে দংশিত স্থানের কাছে শরীরের আরো কয়েকটি অংশ আলাদাভাবে ফুলে যায়।

দ্রুত চিকিৎসা না করা হলে নিম্ন রক্তচাপ, কিডনি অকার্যকর হওয়াসহ বিভিন্ন ধরণের শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৫৪ লাখ মানুষ সাপের দংশনে দংশিত হয়, যার মধ্যে প্রতি বছর অন্তত এক লাখ মানুষ মারা যায়। আর সাপের দংশনে আহত হয়ে বছরে প্রায় ৪ লাখ মানুষের অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় অথবা পঙ্গুত্ব বরণ করেন।

সংস্থাটির ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন এবং বছরে অন্তত ৬ হাজার মানুষ মারা যান।

২০২১ সালে প্রকাশিত বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অবলম্বনে


সর্বশেষ সংবাদ