যে ঘূর্ণিঝড় বাধ্যতামূলক অবসরের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো দুই বাহিনীর প্রধানের জন্য

ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের চিত্র
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের চিত্র  © ফাইল ফটো

বাংলাদেশ নদীপ্রধান দেশ হওয়ার কারণে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে দেখা যায়। কিন্তু কোনো দুর্যোগকে কেন্দ্র করে দুই সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনা দেশের ইতিহাসে একবারই ঘটেছে। ঘটনাটি ঘটেছিল এখন থেকে ১৯৯১ সালে,আজ থেকে প্রায় ৩৩ বছর আগে।

সে বছর ২৯ এপ্রিল মধ্যরাতে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম উপকূলে শক্তিশালী একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, সে রাতে ঘূর্ণিঝড়টির ভয়াবহ তান্ডবে মারা যায় প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার মানুষ। সদ্য স্বাধীন দেশের ইতিহাসে শুধুমাত্র কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে একসঙ্গে এটিই সর্বোচ্চ প্রাণহানির রেকর্ড।

ভয়াবহ ওই ঘূর্ণিঝড়ের এক মাস পর বিমান বাহিনীর তখনকার প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল মমতাজ উদ্দিন আহমদ এবং নৌবাহিনীর তৎকালীন প্রধান রিয়ার এডমিরাল আমীর আহমদ মুস্তফাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। কিন্তু কেন এবং কী কারণে তাদের অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি?
 
বিভীষিকাময় এক রাত 
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার সমুদ্র উপকূলের মানুষের কাছে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতটি ছিল রীতিমত বিভীষিকাময় এক রাত। সেই রাতে ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার গতিবেগে বাতাস আর প্রায় ২০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস নিয়ে রাত প্রায় বারোটা নাগাদ উপকূলে আছড়ে পড়ে হারিকেনের শক্তিসম্পন্ন প্রবল এক ঘূর্ণিঝড়। মূলত সেদিন বিকেল থেকে বইতে থাকা দমকা বাতাস প্রবল এক ঝড়ের আভাস দিচ্ছিল।

সে রাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছিলেন চট্টগ্রামের সন্দীপ উপজেলার বাসিন্দা জান্নাতুল নাইম শিউলী। ঝড়ের রাতে নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন তিনি।

মিস শিউলি জানালেন যে, সেদিন রাত বারোটার দিকে তাদের ঘরে জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢুকতে শুরু করে।এরপর অবস্থা এতটাই ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, সেই রাতে বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি।

“ঘরটা প্রচণ্ড জোরে কাঁপছিল। আমারা ঘরের ভেতরে ২০-২৫জন মানুষ ছিলাম। বেশিরভাগ ছোট-ছোট বাচ্চা। আমরা সবাই শুধু আল্লাহকে ডাকতেছিলাম। মনে হচ্ছিল ঘরের নিচে পড়ে মরে যাব। মৃত্যু কী জিনিস সেটা ঐদিন অনুভব করলাম,” জানান মিস শিউলি।

অথচ আঘাত হানার এক সপ্তাহ আগেও ঝড়টিকে আবহাওয়াবিদরা চিহ্নিত করেছিলেন এক ধরনের লঘু চাপ হিসেবে, যেটি বঙ্গোপসাগরে প্রায়ই সৃষ্টি হতে দেখা যায়।

১৯৯১ সালে ঢাকায় আবহাওয়া অধিদপ্তরে কাজ করতেন আবহাওয়াবিদ সমরেন্দ্র কর্মকার। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা নিজের চোখে দেখেছিলেন, কীভাবে একটি দুর্বল লঘুচাপ হ্যারিকেন শক্তিসম্পন্ন প্রবল এক ঘূর্ণিঝড়ের রূপান্তরিত হয়।

তিনি বলেছিলেন যে, ওই বছরের ২৩শে এপ্রিল সকালের দিকে ঝড়টি প্রথমে লঘুচাপ হিসেবে ধরা পড়ে।এরপর ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে প্রথমে নিম্নচাপ, তারপর ২৭ এপ্রিল সকাল নাগাদ সেটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়।

সেদিন মধ্যরাতেই এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এবং ২৮ এপ্রিল সকাল নয়টার দিকে হারিকেন শক্তিসম্পন্ন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় বলে জানান মি. কর্মকার।

২৯ এপ্রিল মাঝরাতে ঝড়টি সজোরে উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে।

সরকারি পরিসংখ্যানুযায়ী, শক্তিশালী সেই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। অনেকের মরদেহ এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে উপকূলের বিভিন্ন স্থানে পড়ে ছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশে এর আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগে একসাথে এতো মানুষ কখনো মারা যায়নি।

“শুধু কান্নার শব্দ শুনতেছি। যেদিকে যাই শুধু লাশ। আমাদের পাশের এক বাড়িতে একসাথে ৩০ জন মারা গেছে,” জানান মিস শিউলী।

এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ে কয়েক হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে।তবে এর আগেও ১৯৭০ সালে উপকূলীয় জেলায় শক্তিশালী এক ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল বলে জানা যায়।

ভেসে গিয়েছিল যুদ্ধবিমান, ডুবে গিয়েছিল জাহাজ 
ঘূর্ণিঝড়ে যে কেবল মানুষের প্রাণহানি ও বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছিল তা নয়, বরং অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি নষ্ট হয়েছিলো কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি।

এর মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান এবং নৌবাহিনীর জাহাজ।ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে পতেঙ্গায় বিমান বাহিনীর অধিকাংশ যুদ্ধবিমান নষ্ট হয়েছিল।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বিমান বাহিনীর কোয়ার্টারে ছিলেন তৎকালীন সার্জেন্ট উইং কমান্ডার এ কে এম নুরুল হুদা।বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর এই কর্মকর্তা কথা বলেছিলেন গনমাধ্যমের সঙ্গে।

তিনি বলছিলেন, ওই ঘূর্ণিঝড়ে নৌ এবং বিমান বাহিনীর অনেক যুদ্ধজাহাজ বিকল হয়ে পড়েছিল।

“রাশিয়া থেকে সদ্য আমদানিকৃত চারটি বাক্স ভর্তি হেলিকপ্টার জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ভেসে রাস্তার উপর চলে আসে। এ হেলিকপ্টারগুলো ৫০০ গজ দুরে তলাবদ্ধ অবস্থায় হ্যাঙ্গারে ছিল”, বলেন মি. হুদা।

তিনি আরও বলেন, “পানি ও বাতাসের চাপে হ্যাঙ্গার ভেঙ্গে গিয়েছিল। নৌ বাহিনীর যুদ্ধে জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিমান বাহিনীর ক্ষতি প্রচুর ছিল। বিমান বাহিনীর ৩০ থেকে ৩৫টার মতো যুদ্ধ বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।”

প্রবল শক্তিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় উপকূলের দিকে এগিয়ে আসার সতর্কবার্তা থাকলেও বিমান এবং নৌ বাহিনীর সরঞ্জাম কেন নিরাপদে সরিয়ে আনা হলো না, সেটি নিয়ে তখন বিভিন্ন মহল থেকে নানান প্রশ্ন উঠতে থাকে।

১৯৯১ সালের ১৮ মে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত এমনই একটি খবরের শিরোনাম: ‘একটি মাত্র নির্দেশের অভাবে পতেঙ্গা বিমানবন্দরে ৭শ’ কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট’।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমান বাহিনীর কয়েকজন পাইলটের বরাত দিয়ে খবরটিতে বলা হয়ে যে, তারা প্রস্তুত থাকার পরও বাহিনীর প্রধানের কাছ থেকে কোন নির্দেশনা না পাওয়ায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে কোনও যুদ্ধবিমান সরানো যায়নি।

এর ফলে অন্তত ৪২টি যুদ্ধবিমান জলচ্ছ্বাসের পানিতে ভেসে কয়েক কিলোমিটার দূরে চলে গিয়েছিল।এতে বিমানগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল বলে খবরে বলা হয়েছে।

সব মিলিয়ে ঝড়ে বিমানবাহিনীর প্রায় সাতশ’ কোটি টাকার মতো ক্ষয়-ক্ষতি হয় বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর প্রায় দু’দিন ধরে পতেঙ্গা বিমানবন্দর এলাকায় কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না বলেও খবরে দাবি করা হয়। যদিও ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপের জন্য মে মাসের শুরুতেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

বরখাস্তের গুঞ্জন, প্রতিবাদে বিবৃতি
ঘূর্ণিঝড় শেষ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই চট্টগ্রামে নৌ এবং বিমানবাহিনীর সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি সামনে চলে আসে এবং পত্র-পত্রিকায় এটি নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হতে থাকে।

তখনকার পত্রিকায় প্রকাশিত অনেক খবরে, এসব ক্ষয়ক্ষতির জন্য বিমান এবং নৌ বাহিনীর তৎকালীন প্রধানদের দায়িত্বে অবহেলাকেই দায়ী করা হয়।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে, তৎকালীন বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল মমতাজ উদ্দিন আহমদকে বরখাস্ত করা হয়েছে।ঢাকার দু-একটি পত্রিকায় খবরটি ছাপাও হয়। এরপর বিবৃতি দিয়ে সেই খবরকে “ভিত্তিহীন”  বলে জানায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

ওই বিবৃতিতে আরও জানানো হয় যে, ঘূর্ণিঝড়ে বিমান ও নৌবাহিনীর ঘাঁটিগুলোতে ঠিক কী পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, সেটি বের করার জন্য সরকার তদন্ত শুরু করেছে। সেই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত “কল্পনাপ্রসূত তথ্য ও মহামত” প্রকাশ না করার জন্য সাংবাদিকদেরকে অনুরোধ জানায় আইএসপিআর।

২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে বিমান ও নৌবাহিনীর সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই তদন্ত শুরু করে কমিটি।

কিন্তু তারা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ঠিকমত তুলে আনবেন কী না, সেটি নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।

তদন্তের কাজ পরিচালনার জন্য ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়ে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয় বলেও ওই সময়ের পত্রিকায় খবর থেকে জানা যায়।

দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত তাদেরকে আলাদাভাবে দু'টি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তদন্তের যাদের দোষ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তখন হুঁশিয়ারী দেওয়া হয়েছিল।

বাধ্যতামূলক অবসর
মে মাসের মধ্যেই তদন্ত কমিটিগুলো নিজেদের প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর ৪ জুন বিমান বাহিনীর তৎকালীন প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল মমতাজ উদ্দিন আহমদ এবং নৌবাহিনীর তৎকালীন প্রধান রিয়ার এডমিরাল আমীর আহমদ মুস্তফাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেন তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে খবরটি জানানো হয়।

যদিও ঠিক কী কারণে তাদেরকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে, সেটি তখন পরিষ্কার করা হয়নি। প্রজ্ঞাপনে কেবল জানানো হয় যে, বাহিনী দু’টির প্রধানকে অবসর দেওয়া হয়েছে।

একই সাথে দুই বাহিনীর নতুন প্রধানের নামও সেখানে প্রকাশ করা হয়। নতুন প্রধানদের মধ্যে বিমানবাহিনীর দায়িত্ব পান তৎকালীন এয়ার কমোডর আলতাফ হোসেন চৌধুরী।

আর নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে তৎকালীন কমান্ডোর মোহাম্মদ মোহাইমিনুল ইসলামের নাম ঘোষণা করা হয়।

দুই বাহিনীর প্রধানের পাশাপাশি উভয় বাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকেও তখন অবসরে পাঠানো হয়েছিল। যদিও তাদেরকে হঠাৎ অবসরের পাঠানোর কারণ সরকার প্রকাশ করেনি।

কিন্তু তখনকার পত্রিকাগুলোর খবরের মারফত জানা যায় দায়িত্ব অবহেলার কারণেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তাদেরকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। ১৯৯১ সালের পাঁচই জুন তারিখে ঢাকা থেকে প্রকাশিত তখনকার বেশিরভাগ জাতীয় দৈনিকেই খবরটি বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা হয়। দু-একটি পত্রিকায় প্রধান শিরোনামও করা হয়েছিল।


সর্বশেষ সংবাদ