‘বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ’
বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদনের এক-তৃতীয়ংশই জলবায়ু সংকটে ঝুঁকির মুখে রয়েছে এবং একইভাবে খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বন উজাড়, নগরায়ণ, কৃষি জমিতে সারের ব্যবহারের ফলে বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি কার্বন নিঃসরণ হয়। বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত—যেটি আমাদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মহসিন আলী।
বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং টেকসই কৃষি ও স্থায়িত্বশীল খাদ্য ব্যবস্থাপনা: ২৮তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত দিক-নির্দেশনা ও বাংলাদেশের বাস্তবতা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন তিনি।
মহসিন আলী বলেন, খাদ্য অধিকার আইন ইস্যুতে আমরা খাদ্য প্রাপ্তি, পিছিয়ে পড়া, পিছিয়ে রাখা মানুষ এবং খাদ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট পুষ্টি অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, নিরাপদ খাদ্য, কৃষি, ভ‚মি, পানিসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের এই নেটওয়ার্ক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, পানিতে আর্সেনিকের আধিক্য, জমির উর্বরতা হ্রাস ইত্যাদির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরাই।
আরও পড়ুন: ‘মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে গণমাধ্যম’
সরকারকে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনে খাদ্য ও কৃষি ভর্তুকি বাড়াতে হবে। ন্যায্যমূল্যের ভ্রাম্যমাণ ট্রাক, দোকান বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাভাবিক মূল্যে খাদ্যের জোগান বাড়াতে হবে। এম. জাকির হোসেন খান বলেন, আমাদের কৃষিজ সরঞ্জামাদি চলে যাচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে, বিশেষ করে বীজ। উৎপাদনে খরচ কম হওয়াতে আমাদের কৃষক ধানে না গিয়ে গম এবং যব আবাদের দিকে যাচ্ছে। কমিউনিটিভিত্তিক স্থানীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা করতে হবে।
এছাড়া সেমিনারে বক্তারা কৃষি খাদ্য-ব্যবস্থা এবং এর পরিচালনায় ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি ও সংকটের মধ্যে নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিশ্চিত ও জোরালো করা, দ্রুত হালনাগাদ বিসিসিএসএপি অনুমোদন, কপ-২৮ এর ঘোষণা এবং দেশের নিজস্ব সক্ষমতার আলোকে গাইডলাইন তৈরি এবং বাস্তবায়নে উদ্যোগ, ‘ইমিডিয়েট ফান্ড’ নামে যে বৈশ্বিক তহবিল গঠন করা হয়েছে তা হতে বাংলাদেশকে কৃষিখাতে বরাদ্দ নিশ্চিত এবং কপ-৩০ এর মধ্যে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করার বিষয়ে জোর দেন।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিগত বছরগুলো থেকে বেশকিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে, যেমন ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টি, বন্যার প্রকোপ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোনের মাত্রা ও তীব্রতা বৃদ্ধি, অকাল খরা ইত্যাদি। এছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলের একটি প্রধান সমস্যা হলো মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা।
আরও পড়ুন: ভাগ অংশের সমাধান পারে না প্রাথমিকের ৯৫% শিশু
জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের বিরূপ আচরণের প্রভাবে এই লবণাক্ততা প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সেখানে সুপেয় পানির অভাব, খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি, মানুষের বাস্তুচ্যুতি, কর্ম-সংস্থানের অভাব ইত্যাদি আরও প্রকট হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর নেতিবাচক প্রভাবে খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থা বর্তমানে হুমকির মুখে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষেরা ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ভুগছে এবং তাদের বিপন্নতার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও জানান তারা।
সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাচঁতে আমাদের একা কাজ করলে হবে না, বিশ্বের সকলকে সাথে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করে আমাদের কৃষি তথা অর্থনীতিকে স্থায়িত্বশীল করতে সরকারের সকল মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
কৃষি, শিল্প, পশু, মাছ উৎপাদনের সাথে বিশেষ করে পানি ও ভূমির সম্পৃক্ততা রয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে এর বিপণন কীভাবে হবে এবং সবার হাতে খাদ্য পৌঁছে দিতে হলে একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করতে হবে বলেও জানান ড. কাজী খলীকুজ্জমান।
আরও পড়ুন: দেশে ন্যায্য কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহবান ওয়েভ ফাউন্ডেশনের
সেমিনারে ড. রেজাউল করিম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয় বিষয়ে পরবর্তী ২ বছরের মধ্যে আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে বিশ্বব্যাপী কৃষির জন্য ফান্ড তৈরি করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে কতটুকু নিতে পারবে সেটা এখন বিবেচনার বিষয়। এছাড়াও সেমিনারে আরেক অতিথি ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষকের যে ক্ষতি হয়, সেক্ষেত্রে যদি আর্থিক সহায়তা না দেয়া হয় তাহলে কৃষক আর কৃষিতে ফিরতে আগ্রহ পাবে না।
এদিন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, কৃষিখাতের পাশাপাশি পোল্ট্রি, মৎস্যখাতেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন ইস্যু অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে আমাদের এখানে শিল্পভিত্তিক মৎস্য খাতের ব্যাপ্তি ঘটেছে। এ সকল ক্ষেত্রে খাদ্য নিরাপত্তা এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার হিসেবে বহুল আলোচিত। আমাদের মাথাপিছু আয়, কর্মসংস্থান বাড়ার সাথে সাথে খাদ্যের পুষ্টি নিশ্চিতকরণের বিষয়টি জড়িত।
তিনি বলেন, খাদ্যপণ্য ও পশুপালন খাতে ঘাটতি তৈরি হওয়াতে পুষ্টিতেও ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আর এ সকল ইস্যু জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের দেশে জলবায়ু সংশ্লিষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার এখন কোনো নির্দিষ্ট সময়কাল নেই এবং দিনদিন এগুলো খুব শক্তিশালীও হয়ে উঠছে। মূলত, জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি ব্যবহার বাড়ার কারণেই তা ঘটছে।
আরও পড়ুন: সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সঙ্গে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করতে হবে: ড. খলীকুজ্জমান
অনুষ্ঠানে মো. শামসুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে অভিযোজন করতে হবে প্রযুক্তিগতভাবে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গিয়ে সনাতন কৃষিব্যবস্থা ঝুঁকির মুখে পড়ছে। কৃষিক্ষেত্রে আরও গুরুত্ব বাড়াতে হবে এবং ঐসকল ফসলকে গুরুত্ব দিতে হবে যেগুলো জলবায়ু সহিষ্ণু।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে নারীদের যে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন দরকার সেটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি জানিয়ে সেমিনারে ড. আজরীন করিম বলেন, এতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হয় নারী ও শিশু। গৃহস্থালির সকল কাজে নারীরা দায়িত্ব পালন করেন। তাই তাদের যাবতীয় কাজের ক্ষেত্রভিত্তিক অবদানকে স্বীকার করতে হবে বলেও মনে করেন ড. আজরীন।
সেমিনারে খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক গবেষণা পরিচালক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এম আসাদুজ্জামান। সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য ও সঞ্চালনা করেন খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সমন্বয়কারী ও ওয়েভ ফাউন্ডেশন এর সুশাসন, অধিকার ও ন্যায্যতা কর্মসূচির উপ-পরিচালক কানিজ ফাতেমা।
আরও পড়ুন: ‘নারীদের নেতৃত্ব দিতে হবে নিজ নিজ অবস্থানে’
এছাড়াও বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ড. রেজাউল করিম, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম খান, চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম. জাকির হোসেন খান, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ ফেলো ড. আজরীন করিম সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন।