দেশে ডজন ধরনের এসএসসি-সমমানের পরীক্ষা, বিশ্বে নজিরবিহীন

দেশে ডজন ধরনের এসএসসি-সমমানের পরীক্ষা রয়েছে
দেশে ডজন ধরনের এসএসসি-সমমানের পরীক্ষা রয়েছে  © ফাইল ছবি

সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর শিক্ষার্থীদের দিতে হয় মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা এসএসসি পরীক্ষা। মাদ্রাসায় গিয়ে এর সমমানের পরীক্ষা থাকে দাখিল। একই নামে অর্থাৎ এসএসসি পরীক্ষা আছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাইভেট পর্যায়েও এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া যায়। আবার দাখিল ভোকেশনাল পরীক্ষাও দেওয়া যায় এ পর্যায়ে। এ পরীক্ষা আবার কারিগরিতে গিয়ে হয়ে যায় এসএসসি (ভোকেশনাল)। ইংরেজি মাধ্যমের মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও রয়েছে এসএসসি পরীক্ষা।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নামি প্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম পড়ানো হয় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। এসব প্রতিষ্ঠানের এসএসসির সমমানের পরীক্ষা হলো ‘ও’ লেভেল। সারা দেশেই কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃত শিক্ষাব্যবস্থাও আছে। এ ব্যবস্থা থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস করা শিক্ষার্থীরা পান মাস্টার্সের সমমান। এখানে হাফেজি ও মাওলানা (টাইটেল) ধারায় পড়ালেখা হয়।

৯টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হয়। তাদের অধীনেই প্রাইভেট এসএসসি দেওয়া যায়। আর দাখিল ও মাদ্রাসার ভোকেশনাল পরীক্ষার জন্য রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। ভোকেশনাল পরীক্ষা নেয় কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে থাকে। তবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের এডেক্সেল ও কেমব্রিজ কারিকুলামের পরীক্ষার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ নেই। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই নিবন্ধনহীন।

এর আগে অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণিতে সাধারণে পিইসি ও জেএসসি এবং মাদ্রাসায় জেডিসি চালু ছিল। যদিও তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর কওমি মাদ্রাসার পরীক্ষার জন্য একাধিক কর্তৃপক্ষ রয়েছে। এগুলোতে তেমন সরকারি তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ দেশে প্রাথমিক স্তর থেকে সাধারণত এক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকে। এ ব্যতিক্রমও আছে। একাধিক ব্যবস্থাও চালু থাকে। তবে সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা আছে অধিকাংশ দেশে। কারিগরিতে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে অনেক দেশ।

এ স্তরের পড়াশোনা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার ভিত তৈরি করে। কোনো কোনো দেশে একাধিক মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা থাকে। তবে বাংলাদেশে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বহু ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। পরীক্ষাও আলাদা। এ স্তরের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসএসসি বা সমমানের অন্তত ১২ ধরনের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর সবগুলোর মান এক। এতে এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করে সব পর্যায়ে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, দেশে মূলত সাধারণ, আলিয়া মাদ্রাসা ও কারিগরি মূল ধারায় চলছে। অন্যগুলোর ক্ষেত্রে মানে কম্প্রোমাইজ করা হচ্ছে। এর কোনও নিয়ন্ত্রণও নেই। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা দেশকে কতটা ওন করে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। দেশের বাইরে চলে যায় বেশি। কওমিও চলে নিজেদের মতো।

তিনি বলেন, কওমি ব্যবস্থা দেশের প্রচলিত শিক্ষার সঙ্গে তাল মেলাতে চায় না। এভাবে শিক্ষায় বৈষম্য বাড়ছে। নামি প্রতিষ্ঠানগুলোয় ধনীরা পড়ছে। এ ধরনের বৈষম্য সমাজের জন্য ভালো নয়। এর অবসান হওয়া দরকার। শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের যুযোগপযোগী হলে তা সমাজের জন্য ভালো হবে। 

আরো পড়ুন: হাজার কোটি টাকা ব্যয়েও কারিগরি শিক্ষায় গতি আসছে না

জানা গেছে, দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা সাধারণ স্কুল এবং মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। মধ্যবিত্তদের একাংশ ও উচ্চবিত্তদের সন্তানরা ইংলিংশ মিডিয়াম ও বিশেষায়িত স্কুলে বেশি পড়ছে। ধর্মীয় শিক্ষার জন্য কওমিতে পাঠানো হয়। শিক্ষাবিদদের মতে, এভাবে কয়েক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকায় বৈষম্য বাড়ছে। এর নিয়ন্ত্রণও সরকারের হাতে থাকছে না। অনেকে ভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ে উচ্চশিক্ষায় ধাক্কা খাচ্ছে। ঝরে পড়ার প্রবনতাও আছে।

জানা গেছে, প্রায় সব দেশেই শিক্ষাব্যবস্থা সরকারিভাবে চালানো হয়। এদেশেও সেভাবে আছে। তবে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে বাড়তি খরচও থাকে। এ সময় থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খরচ বেশি হওয়ায় অনেক অভিভাবকের জন্য তা বহন কষ্টসাধ্য। ফলে তারা সাধারণ মাধ্যম ও মাদ্রাসায় ভরসা করেন। আর ধণাঢ্যরা যান ইংরেজি মাধ্যম বা বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত নামি ও ব্যয়বহুল প্রতিষ্ঠানগুলোয়।

প্রত্যাশা অনুযায়ী এগোতে পারেনি কারিগরি (টেকনিক্যাল) শিক্ষাও। গত বছর দেশের মধ্যে মোট শিক্ষিত জনশক্তির শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ এ খাতের ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যার ব্যুরোর (বিবিএস) জনসংখ্যা ও গৃহগণনা-২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক দশকেরও বেশি সময়ে শিক্ষিত জনশক্তি (৫ বছরের বেশি বয়সী) শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ বেড়েছে। অথচ ২০১৮ থেকে ২০২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে ৫৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে বলে জানা গেছে। চলতি অর্থবছরে ১০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সবাই বিষয়টি জানে। কিন্তু কেউ আসলে মানিয়ে নিতে চায় না। আমরা শিক্ষা ও পরীক্ষা গুলিয়ে ফেলছি। দেশের সবাই মেধাবী। তাদের মেধার জায়গাটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এখানে পাবলিক পরীক্ষায় গুরুত্ব বেশি। এটা বাদ দিয়ে ইনস্টিটিউশনাল মূল্যায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। 

তিনি বলেন, যিনি পড়াবেন তিনিই মূল্যায়ন করবেন। অথবা অন্য কেউ সহযোগিতা করবেন। এখানে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে মেলানো হচ্ছে না পড়াশোনা। এতে ১০ বছর পর বিদেশে কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাবে। এর পরিবর্তন দরকার। তবে আগে পাইলটিং করতে হবে। কারণ হঠাৎ পরিবর্তন কেউ মেনে নেবে না। ধীরে ধীরে করতে হবে। পুরোনো ধারার পড়াশোনায় আর চলবে না। পরিবর্তনের সঙ্গে সবাইকে মানিয়ে নিতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মাধ্যমিকে বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে বৈষম্য বাড়ছে বা সমস্যা হচ্ছে বলে আমরা মনে করি না। এখন মাধ্যমিকে এসএসসি, দাখিল ও কারিগরি মাধ্যমে পরীক্ষা হয়। এসব মাধ্যমগুলোতে আমরা শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা দেখিনি।

তিনি বলেন, এর বাইরে কওমি আর কিছু বিদেশি কারিকুলাম আছে। বিদেশি এ ধরনের কারিকুলাম বিশ্বের সব দেশেই রয়েছে। যেমন সৌদির জেদ্দাতে আমাদের বাংলা স্কুল আছে। সেখানে আমাদের দেশের কারিকুলামে পাঠদান হচ্ছে। আর কওমির যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো ফ্রেমওয়ার্ক নেই, তাই তাদের নিয়ে কিছুটা সমস্যা থাকতে পারে। তাদেরকেও যেকোনো একটা কারিকুলামের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে এ সমস্যাও কেটে যাবে।


সর্বশেষ সংবাদ