খাদ্য অধিকার ও কৃষি খাদ্যব্যবস্থা সম্মেলন

খাদ্য অধিকার আইন প্রতিষ্ঠাসহ নানা দাবি আলোচকদের

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের খাদ্য অধিকার এবং কৃষি খাদ্যব্যবস্থা সম্মেলনে অতিথিরা
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের খাদ্য অধিকার এবং কৃষি খাদ্যব্যবস্থা সম্মেলনে অতিথিরা  © টিডিসি ফটো

দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সুরক্ষার জন্য জলবায়ু সহনশীল, পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলা ও সবার জন্য খাদ্য অধিকার আইন নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে ‘এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের খাদ্য অধিকার এবং কৃষি খাদ্যব্যবস্থা সম্মেলন ২০২৩’ এর সমাপনী অধিবেশনে। আর এসব দাবি ও প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক পর্দা নামলো এবারের আসরের মূল আয়োজনের। এবারের সম্মেলনে দেশ-বিদেশের প্রায় ৬ শতাধিক অতিথি অংশগ্রহণ করেছেন।

সমাপনী অধিবেশনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দাবি জানানো হয়েছে, কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থাকে ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই করার জন্য কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তে জনবান্ধব কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা শক্তিশালী করার বিষয়ে। সর্বোপরি, কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থায় বহুবিধ অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা প্রয়োজন যেখানে নাগরিক সমাজের সংগঠন, কৃষক সংগঠন, গবেষক, যুব, নারী, মৎস্যজীবী, ক্ষুদ্র পারিবারিক কৃষকসহ সকলের জোরালো কণ্ঠস্বর শোনা যাবে—এমন উদ্যোগের দাবিও জানানো হয়েছে এবারের সম্মেলনে।

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবীর এর সভাপতিত্বে সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম এবং অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আইন উদ্দিন। সমাপনী অধিবেশনে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী। পুরো আয়োজনটি সমন্বয় ও সঞ্চালনা করেন খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সমন্বয়কারী কানিজ ফাতেমা।

সমাপনী অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রুহুল আমিন তালুকদার, নেপালের জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনের যুগ্ম সচিব ড. কিরণ রূপখেটি , ভারতের দেশীয় প্রতিনিধি সাসমিতা জেনা, হেইফার ইন্টারন্যাশনাল এন্ড ওয়ান হেলথ এশিয়া রিজিওনের সিনিয়র ডিরেক্টর অফ প্রোগ্রাম দিলিপ ভান্ডারি প্রমুখ। 

সম্মেলনের ঘোষণাপত্রের সাথে একমত পোষণ করে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, বর্তমান সরকারের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে দেশকে খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত করা। বর্তমানে আমরা প্রায় ৪ কোটি ৫৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন করে থাকি, যদিও কৃষিজমি একটুও বাড়েনি। কৃষি সংক্রান্ত সকল প্রতিষ্ঠানে সরকারের সহায়তা থাকায় সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেও পুষ্টি এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সেজন্য কাজ করছে। বর্তমান সরকার যতগুলো সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করেছে, আর কোথাও এমনটি নেই। 

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মো. আইন উদ্দিন বলেন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সুরক্ষার জন্য সরকার সার, বীজ, কীটনাশক সুলভ-মূল্যে সরবরাহ করছে এবং কৃষিব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে ভর্তুকি দিচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার সকল মহামারী ও অর্থনৈতিক মন্দা উপেক্ষা করে বর্তমানে ১৯ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্য মজুদ করেছে। সম্মানীয় অতিথির বক্তব্যে মো. রহুল আমিন তালুকদার বলেন, সরকার কৃষিখাতে বরাবরের মতো ভর্তুকি অব্যাহত রেখেছে। যার ফলে কোভিড-পরবর্তী বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের সময়ও দেশ খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন হয়নি। বরং সরকার কৃষকদের জন্য নানা ধরণের প্রণোদনা বাজেটে বৃদ্ধি করেছে। 

অনুষ্ঠানে ড. কিরণ রূপখেটি বলেন, নেপাল সরকার সকলের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে গৃহীত হয়েছে খাদ্য অধিকার সংক্রান্ত আইন, যা পুরোপুরি কার্যকর করা এখনও সম্ভব হয়নি। প্রযুক্তিগত রূপান্তরের সাথে খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়টিকে যুক্ত করে আমাদেরকে আরো পদক্ষেপ নিতে হবে। 

সাসমিতা জেনা বলেন, সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার দাবি আমরা করি, কিন্তু কারা আসলে সবচেয়ে প্রান্তিক তার সঠিক তথ্য কি আমাদের কাছে আছে? খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থায় সুশাসন তথা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা আমাদের অন্যতম দাবি, যা কার্যকর না হলে সবাই খাদ্য অধিকারের আওতায় আসবে না। অধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কর্মসূচি গ্রহণ না করলে আমাদের জন্য টেকসই উন্নয়ন অধরাই থেকে যাবে। খাদ্য অধিকার নিশ্চিতে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যুব, শিক্ষার্থী, প্রান্তিক কৃষক সকল পক্ষকে নিয়ে একসাথে কাজ করার উপর গুরুত্ব প্রদান করেন দিলিপ ভান্ডারি।

ঘোষণাপত্র পাঠকালে মহসিন আলী সম্মেলনের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সুরক্ষার জন্য জলবায়ু সহনশীল, পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থা এবং পারিবারিক কৃষির সাথে সংশ্লিষ্টদের অধিকারকে সমুন্নত রাখা, বাংলাদেশসহ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহে সবার জন্য খাদ্য অধিকার আইন নিশ্চিত করা, ক্ষুদ্র কৃষকবান্ধব এবং একইসাথে বৃহৎ কৃষি খামারিদের সহায়তা করে এমন কৃষি পরিষেবার (ভর্তুকি) ব্যবস্থা করাসহ মোট দশটি দাবি উত্থাপন করেন।

 এছাড়াও কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থাকে ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই করার জন্য কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তে জনবান্ধব কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা শক্তিশালী করা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিসমূহ পর্যালোচনা করে সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক অংশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করা, কৃষিতে ডিজিটাইজেশন বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠী যাতে সহজে এতে অভিগম্যতা পায় সেজন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠী-ভিত্তিক ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি একটি সাধারণ পরিসর (প্ল্যাটফর্ম) সৃষ্টি করা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিসমূহের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা এবং সেবাগ্রহীতাদের উত্তরণে একটি সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনাসহ শক্তিশালী মনিটরিং ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিশ্চিত করার দাবিও জানানো হয়েছিল এবারের ঢাকা সম্মেলন থেকে।

কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় বহুবিধ অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা, যেখানে নাগরিক সমাজের সংগঠন, কৃষক সংগঠন, গবেষক, যুব, নারী, মৎস্যজীবী, ক্ষুদ্র পারিবারিক কৃষকসহ সকলের জোরালো দাবি বা কণ্ঠস্বর উত্থাপনের সুযোগ থাকবে, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কৃষি-প্রতিবেশ-ব্যবস্থা সংক্রান্ত উপকরণ, কৌশল এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার উপরে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা এবং কৃষক ও উৎপাদক সংগঠনগুলোর জন্য একটি পৃথক আইন বা বিধান প্রয়োজন, যা কৃষি ভ্যালু চেইনের সকল পর্যায়ে কৃষকদের অংশগ্রহণ ও তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে—এমন দাবিও জানানো হয়েছিল এবারের সম্মেলন থেকে।


সর্বশেষ সংবাদ