কেমন ছিল ১৯৭১ ও ৭২ সালের এসএসসিসহ অন্যান্য পরীক্ষা

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থমকে যায় এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থমকে যায় এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা  © সংগৃহীত

করোনা মহামারী ও বন্যার কারণে সাত মাস পিছিয়ে গেছে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষা। সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশ হচ্ছে আজ সোমবার। করোনার কারণে গত বছর অটোপাসও দেখতে হয়েছে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। এর আগে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ও পরের বছর ১৯৭২ সালে।

ওই সময়ের প্রজন্ম বা তখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিবরণ থেকে এ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সব শ্রেণিতে অটোপাস দেয়া হয়েছিল। অর্ধশতক পর আবারো সংকটকালে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গণহত্যাকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেখাতে চেয়েছে, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। এটা প্রমাণের জন্য এসএসসি পরীক্ষা সফল ও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে বলতে চেয়েছিল।

সে সময় অনেক পরীক্ষার্থী খাতায় লিখেছিল—‘জয় বাংলা’, ‘বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই’র মতো স্লোগান। এক খাতা-পরীক্ষক জানিয়েছেন এমন তথ্য। তবে শেষ পর্যন্ত পুরো পরীক্ষা হয়নি। তবে পরীক্ষা ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে, সরকার তা প্রচার করেছিল। যুদ্ধের বছর ঢাকা শহরে এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় টানা দশ মাস দেশের সর্বস্তরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। দিনের হিসাবে ৩৪০ দিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার পর সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ১৮৭২ সালের ৮ জানুয়ারি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু হয়। তবে স্বাভাবিক কার্যক্রম ও সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসতে আরও অনেক সময় লাগেছ।

ষাটের দশকে সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ছিল চারটি- ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা ও যশোর। স্বাধীনতার পর এসব বোর্ডের অধীনেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়। ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এসে ১২ জানুয়ারি নতুন সরকার গঠন করেন। ১৫ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। 

আরো পড়ুন: সাত মাস পেছানো এসএসসির ফল আজ, জানবেন যেভাবে

পাকিস্তান আমলে বড় পরীক্ষা বলতে এসএসসি ও এইচএসসিকে বোঝাত। সত্তরের সাধারণ নির্বাচন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে টেস্ট পরীক্ষা বা ফরম পূরণ সম্পন্ন হতে না হতেই মুক্তিযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। তখন মাধ্যমিমে এক হাজার নম্বরের পরীক্ষা হতো। তবে নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়। ইংরেজি ৭৫ আর বাংলা অথবা উর্দু ৭৫ এবং গণিত ৫০ মোট ২০০। এছাড়া দুটি ঐচ্ছিক বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা।

১৯৭২ সালে বিজ্ঞান বিভাগের এসএসসিতে উচ্চতর গণিত পরীক্ষা হয়নি। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কেবল ৫০ নম্বরের গণিত পরীক্ষা হয়। স্বাধীন দেশের প্রথম এসএসসি পরীক্ষা ছিল এটি। ওই পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের কোনো বিষয়েই ব্যাবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয়নি।

প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান তার ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইয়ে লিখেছেন, তখনকার শিক্ষামন্ত্রীর অটোপাসের সিদ্ধান্তে তিনি ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ একমত ছিলেন না। ১৯৭১ সালের অটোপাসের বিষয়ে আনিসুজ্জামান তার বইয়ে লিখেছন, শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার আগেই শিক্ষাক্ষেত্রে ইউসুফ আলী যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিলেন, সে কথাটা এখানে বলে নিই।

তিনি লেখেন, পরিকল্পনা কমিশনের থেকে শিক্ষা বিষয়ে আমি যে কয়েকটি কাগজ তৈরি করেছিলাম, তার কটিতে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে যে ক্লাসে পড়ত, ১৯৭২ সালের ১ মার্চে তাকে আবার সেখান থেকে পড়াশােনা শুরু করতে হবে। একটি বছর জাতীয় ক্ষতি হিসেবে পরিগণিত হবে এবং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা এক বছর বাড়িয়ে দেওয়া হবে।

তবে মন্ত্রিসভায় এ প্রস্তাব বিবেচিত হওয়ার আগেই জাতীয় পরিষদ সদস্য ইউসুফ আলী জনসভায় ঘােষণা করেন যে, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণউন্নতি দেওয়া হলাে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যে যেখানে পড়ত, ১৯৭২ সালে তার পরবর্তী শ্রেণিতে সে উন্নীত হবে। এ ঘোষণার বিষয়ে তিনি যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করেননি, সে কথা আমি তাজউদ্দীনের কাছ থেকে জেনেছিলাম।

বলা বাহুল্য, ঘোষণাটি ছাত্রদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এবং প্রত্যাহার করার মতাে সাহস সরকারের হয়নি। এতে যে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে কী সর্বনাশ হলো, অনেকে তা ভেবে দেখেননি। এই কারণে ইউসুফ আলীর প্রতি মনটা বিমুখ হয়ে থাকলেও তার আহবানে তাঁর দপ্তরে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা সম্পর্কে আলােচনা করতে।


সর্বশেষ সংবাদ