ঢাবিতে চান্স পায়নি বলে প্রেমে বিচ্ছেদ, ভুলে যাওয়াই শ্রেয়

আমিনুল ইসলাম
আমিনুল ইসলাম  © সংগৃহীত

এক ছেলের গার্লফ্রেন্ড তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। মনের দুঃখে সে আমাকে টেক্সট করেছে। অনেকদিন পর আজ ‘‘আদার বক্স’’ চেক করছিলাম। প্রথম মেসেজটা'ই দেখি এই ছেলের। এরপর আর কোন টেক্সট না পড়ে এই লেখা লিখতে বসেছি। ছেলেটা রোমান হরফে বাংলায় লিখেছে 

স্যার, আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ড; আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন পর্যন্ত প্রেম করেছি। আমাদের প্রেম সেই ক্লাস নাইন থেকে। প্রায় পাঁচ বছর আমরা প্রেম করছি। মেয়েটাই আমাকে প্রথম প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো। আমরা একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিংও করেছি। ওর কোচিং করার টাকাও আমি দিয়েছি। ওর যাওয়া-আসার খরচও আমি নিজে টিউশনি করে জোগাড় করেছি। 

সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়েছে। আমি পাইনি। এর পর থেকে দেখি সে আমার সাথে আর ভালো করে কথা বলে না। এখন তো আর যোগাযোগই করছে না। আমি খুব ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছি। কোন কিছু ভালো লাগছে না। আমি আপনার লেখা অনেক দিন থেকে ফলো করি। আপনি প্রথম আলোয় ভর্তি পরীক্ষার্থীদের নিয়ে যে কলাম লিখেছিলেন; সেটা পড়েই আপনার লেখার সাথে পরিচয়। স্যার, আমার তো এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না। আমার এখন কি করা উচিত? 

এই ছেলের লেখা পড়ে আমার হঠাৎ দুই বন্ধুর কথা মনে হয়েছে। এরা দুইজন খুব কাছের বন্ধু ছিল। একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে। পাশ করার পর একই সাথে বিসিএসের কোচিং করেছে। এক সাথে প্রিপারেশন নিয়েছে। এক বন্ধু বিসিএস ক্যাডারে চান্স পেয়েছে। অন্যজন পায়নি। যিনি পান'নি; তিনি আমাকে একদিন মনের দুঃখে বলেছিলেন- "আমরা একই সাথে প্রস্তুতি নিয়েছি। যে-ই না সে বিসিএসে চান্স পেয়ে গেল; আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আমি ফেসবুকে মেসেজ দিলেও দেখতো না। মনে হত আমাকে চেনেই না!  একটা সময় দেখি আমাকে ফেসবুক থেকেও ব্লক করে দিয়েছে। 

আরও পড়ুন: রনির পাশে ঢাবি শিক্ষার্থীরাও, স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল কমলাপুর

এমন না যিনি বিসিএসে চান্স পাননি; তিনি কোন খারাপ কিছু করতেন। তিনি ঢাকার একটা বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেছেন। তারও কিছুদিন পর বিদেশে পিএইচডি করতে এসছেন। বিদেশেই উনার সাথে পরিচয়। একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি তার এই অভিজ্ঞতার কথা আমাকে বলেছিলেন। 

এইসব বিষয় নিয়ে আমার নিজস্ব একটা মতামত আছে। বস্তুগত কিংবা পেশাগত অবস্থার পরিবর্তনের ফলে যাদের আচার-আচরণের পরিবর্তন হয়। যারা নিজেদের বড় ভাবতে শুরু করে এবং আশপাশের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এমনকি খুব কাছের মানুষজনকে ভুলে যায়। তারা আসলে মানুষ হিসেবে খুবই নিচু শ্রেণীর। 

আমার মনে আছে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর আমার স্কুল জীবনের দুই ফ্রেন্ড ইকবাল এবং মুকুল আমাকে ভীষণ রকম হেল্প করেছিল। ওই সময়ে  ঢাকার বাইরে যাওয়া, পরীক্ষা দেয়া, এডমিশন নেয়া এইসব বিষয় আমার একার পক্ষে করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কারন আমি খুবই ভীতু স্বভাবের মানুষ ছিলাম। তাছাড়া পরিবারের সবাই বলছিল- ঢাকায় যেহেতু চান্স পেয়েছিস; কেন শুধু শুধু সিলেটের শাহজালাল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাবি? কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল, আমি সিলেটেই পড়বো। 

আরও পড়ুন: চবিতে কী হয়েছিল সেই রাতে?

আজ থেকে প্রায় ২৬ বছর আগের কথা বলছি। সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থাও এত ভালো ছিল না। খুব একটা বেশি কেউ ঢাকা থেকে সিলেটে পড়তেও যেত না। কিভাবে কি করব বুঝতে পারছিলাম না। তখন আমার এই দুই বন্ধু আমাকে হেল্প করেছিল। ওরা আমাকে ফর্ম কিনে এনে দিয়েছে। ফিলাপও করে দিয়েছে। চান্স পাবার পর আমাকে নিয়েও গিয়েছে ভর্তি হবার সময়। এমন কিছু নেই করেনি। কারন ওরা জানত, আমি খুবই নরম এবং ভীতু স্বভাবের মানুষ ছিলাম। আমার একার পক্ষে এইসব করা সম্ভব হত না। আজ থেকে এত বছর পরও আমি ওদের এই উপকার ভুলিনি। দূর থেকে আমি চেষ্টা করি ওদের খবর নেয়ার। মন থেকেই আমি ওদের জন্য প্রার্থনা করি- ওরা যেন ভালো থাকে। 

ছেলে, 

আমি সব সময় বিশ্বাস করে এসছি- যারা অতীত ভুলে যায়; তাদের পক্ষে যে কোন খারাপ কাজ করা সম্ভব। আমি সব সময় চেষ্টা করেছি এই ধরণের মানুষ গুলোকে এড়িয়ে চলতে। হিসেব করলে বাংলাদেশি হিসেবে নিজেকে আমি সফল বলতেই পারি। নিজেকে জাহির করার জন্য নয়। স্রেফ বুঝানোর জন্য বলছি। পৃথিবীর নামি-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বচ্চো ডিগ্রী নিয়েছি। নিজেই এখন ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াই। কিন্তু আমি সেই ঢাকার নাখালপাড়ার সরু গলিতে জন্ম নেয়া আমিনুলই রয়ে গিয়েছি। আমার কখনো নিজেকে এর চাইতে বড় কিছু মনে হয়নি। এই বয়েসে এসেও আমি আমার ওই দুই স্কুল জীবনের ফ্রেন্ডকে ঠিকই মনে রেখেছি। 

মেয়েটা হয়ত কখনো তোমাকে ভালোই বাসেনি। তোমার বরং উচিত হবে তাকে ভুলে যাওয়া। সে যে চলে গিয়েছে এতে বরং তোমার আনন্দিতই হওয়া উচিত। তাছাড়া এত কম বয়েসে হতাশ কিংবা ডিপ্রেশনে ভোগারও কোন মানে হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সব কথা নয়। তোমার উচিত হবে নিজের কাজটি ঠিক ভাবে করে যাওয়া। দেখবে একটা সময় তুমি'ই জীবনে সফল হবে। তখন হয়ত এই মেয়েটার মত হাজারটা মেয়ে তোমার আশপাশে ঘুরে বেড়াবে। তবে মনে রেখো- ওই সময়ও তোমার পা যেন মাটিতেই থাকে। আশপাশের মানুষজনকে যেন ভুলে না যাও। এটি যেমন তোমার জন্য প্রযোজ্য; ঠিক তেমনি যে কোন ছেলে কিংবা মেয়ের জন্যও প্রযোজ্য।  

বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমরা পেশাগত সফলতার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে গুলিয়ে ফেলি। তখন বেশীরভাগ সময় আমাদের আশপাশের দরিদ্র কিংবা ছোট-খাটো চাকরি করা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের আর মানুষ মনে হয় না। এমন মানুষদের আমি সব সময় এড়িয়ে চলেছি। কারন আমার ধারণা অতীত ভুলে এই মানুষ গুলোর পক্ষে জগতের যে কোন খারাপ কাজ করে ফেলা সম্ভব।  তোমারও উচিত হবে এই মেয়েটিকে এড়িয়ে চলা।

লেখা: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত


সর্বশেষ সংবাদ