বিসিএস ক্যাডার-ননক্যাডার ও মেধাবীদের স্বপ্ন ভাঙ্গার অবসান হোক
এদেশের চাকরির বাজারে সবার লক্ষ্যই একটি সরকারি চাকরি। আর এই সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে চাকুরি প্রার্থী মেধাবীদের প্রথম পছন্দ থাকে বিসিএস ক্যাডার। আর বিসিএস ক্যাডার প্রাথমিক বাছাই থেকে সুপারিশ পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া করে থাকে বিপিএসসি তথা বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এছারাও দেশের সর্বোচ্চ মানের যে সরকারি চাকুরি রয়েছে তার সিংহভাগই সুপারিশ করে থাকে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং এখন পর্যন্ত সকল চাকুরী প্রার্থীর মূল আস্থা এই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের উপর। আর প্রতিষ্ঠানটিও নিরবচ্ছিন্ন ভাবে স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে লোভনীয় এই চাকুরীর জন্য পার্থী বাছাই ও সুপারিশ করে থাকে। কমিশনের সাথে যারা যুক্ত তারাও তুলনামূলক ভাবে অধিক স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ে মেধাবীদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
বিভিন্ন পেশা ভিত্তিক এই বিসিএস ক্যাডাররাই মূলত এদেশের আমলাতন্ত্র ও প্রশাসন কে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে; আর তাই সকল চাকুরী প্রার্থীর প্রথম পছন্দই থাকে বিসিএস ক্যাডার হওয়া। এই চাহিদা শুধু প্রার্থীরই নয় বরং তার পরিবার, আত্মীয় স্বজন, সামাজিক মর্যাদা,এমনকি বিয়ের বাজারেও এর চাহিদা অনন্য, ফলে উচ্চতর তথা স্নাতক পর্যায় থেকেই সবার জোর প্রস্তুতি থাকে বিসিএস ক্যাডার হয়ে নিজের,পরিবার ও দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে দেশ সেবার সুযোগ নেয়া। একদিকে শিক্ষার হার বৃদ্ধি অন্যদিকে যেহেতু মেধাবীদের প্রথম পছন্দ বিসিএস ক্যাডার সেহেতু এই চাকরির পাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতাই লক্ষণীয় এবং নির্মম বাস্তবতা হলো দেশের চাহিদা ও পদ স্বল্পতার কারণে খুব অল্প পরিমাণ প্রার্থীই তারা তাদের স্বপ্ন পূরণে সক্ষম হন। একদিকে এই চাকরি পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর মেধাবীরা ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে অধিকতর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তাদের মেধাকে শাণিত করে অন্যদিকে সর্বশেষ চূড়ান্ত তালিকায় নিজের স্থান অর্জন করতে না পাড়লে ঠিক ততোটাই কষ্ট সহ্য করতে হয়।
আরও পড়ুন: নিয়ম না মানায় গড়ে উঠছে না ভালো বিদ্যালয়
দীর্ঘমেয়াদি বাছাই প্রক্রিয়ায় প্রথমেই ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পর্বেই ঝরে যান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ কারীদের একটি বড় অংশ।গেলো কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন কারীর সংখ্যা ছিল প্রায় চার লক্ষের অধিক, ধীরে ধীরে এই সংখ্যা আগের বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে কিন্ত এই চার লক্ষাধিক আবেদনকারীদের মধ্যে ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি বাছাইয়ে টিকে থাকেন পনেরো থেকে বিশ হাজার মাত্র। বাকীরা আবার নতুন করে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন পরবর্তী বিসিএসের জন্য। এই পনেরো থেকে বিশ হাজার প্রার্থী সাধারণত পরীক্ষিত মেধাবী হিসেবে স্বীকৃতি পান কিন্ত তাদের আবার অংশগ্রহণ করতে হয় সাধারণ ও বিষয় ভিত্তিক যথাক্রমে ৯০০ এবং ১১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায়। অর্থাৎ পরীক্ষিত মেধাবীরা এবার নিজেদের মধ্যেই আবার প্রতিযোগিতা করেন এবং লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫০-৬০ শতাংশ মাত্র উত্তীর্ণ হতে পারেন তবে এখানেই তাদের মেধার যুদ্ধ শেষ নয় বরং চূড়ান্ত বাছাইয়ের পথের কাছাকাছি অবস্থান করছেন।এবার লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ২০০ নম্বরের ভাইভা পরীক্ষায় ডাকা হয় এবং এই পরীক্ষায় উপস্থিত বুদ্ধি,কথা বলার ধরন, পোশাক -পরিচ্ছদ, রুচি ও মানসিক দৃড়তাসহ নানাদিক যাচাই-বাছাই শেষে যারা পাশ করেন তারাই বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলে গণ্য হন।
এত যাচাই-বাছাইয়ের পর এই বিসিএস উত্তীর্ণদের ২৫ শতাংশই কেবল ক্যাডার পদ পেয়ে থাকেন অর্থাৎ ৮০০০ বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ক্যাডার পদ পেয়ে থাকেন মাত্র ২০০০ এর কিছু কম বেশি এবং ব্যতিক্রম ছাড়া এটাই হয়ে আসছে গত কয়েকটি বিসিএসে।বাকী ৭৫ শতাংশই হলো বিসিএস নন-ক্যাডার যারা সাধারণত খালি হাতে ফিরতেন। তাই যারা বিসিএস পরীক্ষার কঠিন ধাপগুলো সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েও পদ স্বল্পতার কারণে চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন না, তাদের জন্য সরকার কর্তৃক জারিকৃত নন-ক্যাডার পদের নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা-২০১০ এবং সংশোধিত বিধিমালা-২০১৪ অনুযায়ী সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে শূন্য পদের চাহিদা পাওয়া সাপেক্ষে পিএসসি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে চূড়ান্ত সুপারিশ করে। ৩১তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারে নিয়োগ শুরু হয় এবং উল্লেখযোগ্য হারে শুরু হয় ৩৪তম বিসিএস থেকে।
আরও পড়ুন: শাবিপ্রবি উপাচার্যের বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করব: শিক্ষামন্ত্রী
কিন্ত বিসিএস উত্তীর্ণ হলেও তাদের ভাগ্যে আদৌ চাকরি আছে কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না অথচ এত গুলো ধাপ পর্যন্ত প্রতিটি বিসিএস শেষ করতে কমিশনের সময় লেগে যায় প্রায় ৪ থেকে ৫ বছর এবং এখন যে ৪০ তম বিসিসের ভাইভা চলছে এটিও ৪ বছর পাড় হতে চলেছে।৪০ তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে যার প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া এখনও চলমান। কিন্ত সবচেয়ে অমানবিক বিষয় হলো, যারা প্রথমে ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি, ৯০০/১১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আবারও ২০০ নম্বরের ভাইভা উত্তীর্ণ অর্থাৎ মোট ১৫০০ নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও পদ স্বল্পতায় ক্যাডার পেলেন না তারা ঝুলে থাকবেন ভাগ্যের উপর অথচ তাকে পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করতে দিতে হয়েছে জীবনের মহামূল্যবান ৪ থেকে ৫ টি বছর কিন্ত তারপরও তাকে নন-ক্যাডার সান্ত্বনা নিয়ে চলে যেতে হতে পারে একেবারেই শূন্য হাতে।
সম্প্রতি দেশ রুপান্তর পত্রিকার এক প্রতিবেদন পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ২৮ তম বিসিএস থেকে ৩৭ তম বিসিএস পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজারের অধিক বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থী কোন চাকরি পাননি। যে মেধাবীরা ১৫০০ নম্বরের একই সাথে চাকরির পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বরের প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তাকেও দিন শেষে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে।এই যে মেধাবীদের ভাগ্যবিড়ম্বনা এর দায় কে নিবে।তারাতো পরীক্ষিত মেধাবী এবং চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, তাহলে তারা কেন খালি হাতে ফিরবেন অথচ বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে জনপ্রশাসনের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির প্রায় তিন লক্ষাধিক নন ক্যাডার পদ শূন্য। এই শূন্য পদ রেখে মেধাবীদের খালি হাতে ফিরে যাওয়া, এই ১৫০০ নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, এই ৪-৫ টা বছরের পরিশ্রম ও অপেক্ষাকে উপেক্ষা করলে মেধাবীরা কোথায় যাবে। কেন শূন্য পদ গুলো বছরের পর বছর শূন্য রেখে মেধাবীদের শূন্য হাতে ফেরাতে হবে। এই একই দৃশ্য রয়েছে ক্যাডার পদ গুলোতেও।সর্বশেষ সাধারণ বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয় ৩৮ তম বিসিএসের অথচ এখন পর্যন্ত চার বছর ধরে অপেক্ষায় রয়েছে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আরও প্রায় হাজারখানেক মেধাবী চাকরি প্রার্থী বিসিএস নন-ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়ার আশায়। মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ গুলো যদি নিজ উদ্যোগে এসব শূন্য পদ পূরণের চাহিদা চেয়ে কর্মকমিশনে চাহিদাপত্র না পাঠায়,অভ্যন্তরীণ মামলার জট না খুলে এবং স্ব স্ব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের নিয়োগ বিধি জটিলতায় আটকে নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে থাকে বছরের পর বছর তাহলে এই প্রতিষ্ঠানই বা কিভাবে বেকার ও অসহায় মেধাবীদের দুঃখ লাঘবের ব্যবস্থা নিবে?
আরও পড়ুন: শীঘ্রই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে: শিক্ষামন্ত্রী
বৈশ্বিক করোনার প্রভাবে দেশের চাকরির বাজার অনেকটা স্থবির,বাছাই পরীক্ষা নিতে পারেনি অনেক প্রতিষ্ঠান ফলে বেকারত্ব বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। অন্যদিকে চলমান ৪০ তম বিসিএস পরীক্ষাটিও শেষ পর্যায়ে এসেও মহামারীর কারণে ভাইভা স্থগিত হয়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছে বার বার ফলে এই বিসিএসটিও দেশের দীর্ঘতম সময় পার হওয়া বিসিএসের একটি এবং অন্য বিসিএস থেকেও স্বল্প ক্যাডার পদ। ফলে চূড়ান্ত পর্যায়ের অধিকাংশ প্রার্থীই আশাবাদী এই মহামারী কালিন শূন্য হওয়া পদ গুলি যদি এতে যোগ হয় তবে এটিও হতে পারে তাদের জন্য ধৈর্যের পুরস্কার। যদিও ইতোপূর্বে প্রায় বিসিএসেই অতিরিক্ত শূন্য পদ যুক্ত হয়েছে এমনকি সর্বশেষ ৩৮ তম বিসিএসেও চূড়ান্ত ফলের সাথে ২৪০ টি ক্যাডার পদ যুক্ত হয়। এই বিসিএসে বিজ্ঞপ্তিতে ২ হাজার ২৪টি পদ থাকলেও শেষ মুহুর্তে ২৪০টি পদ বেড়ে মোট পদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ২৬৪টি। এর আগে ৩৭তম বিসিএসে ১ হাজার ২২৬ জন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চূড়ান্ত ফলাফলে ১ হাজার ৩১৪ জনকে ক্যাডার পদে সুপারিশ করা হয়েছিলো। ৩৬ তম বিসিএসে বিজ্ঞপ্তিতে ২ হাজার ১৮০টি পদ থাকলেও শেষ মুহুর্তে ৪২৭টি পদ বেড়ে মোট পদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৬০৭টি।
এভাবে প্রায় প্রতি বিসিএসেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দ্রুত পূরণ করার জন্য বিজ্ঞপ্তিতে দেয়া পদ বৃদ্ধি করে আসছে পিএসসি। বিশেষজ্ঞ,রাষ্ট্রের গণ্যমান্য ব্যক্তি, অভিভাবক ও চাকুরী প্রার্থীরা পদবৃদ্ধির এ পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। সেই হিসেবে দীর্ঘ সময় পাড়ি দেয়া চলমান ৪০ তম বিসিএসেও যদি শূন্য পদ গুলো যুক্ত হয় সেই ক্ষেত্রে অপেক্ষায় থাকা মেধাবীদের মুখে যেমন হাসি ফুটবে অন্যদিকে পদ স্বল্পতায় যারা ক্যাডার পদ পাবেন না তারাও নন-ক্যাডার পদে চাকরি প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় অনেকটা এগিয়ে থাকবেন।
একইভাবে যেসব শূন্য নন-ক্যাডার পদ মামলা ও নিয়োগ বিধি জটিলতায় আটকে আছে এগুলোও দ্রুত নিষ্পত্তি করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি শূন্য পদ গুলো পূরণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন একদিকে যেমন মেধাবীদের দীর্ঘ অপেক্ষা ও পরিশ্রমের পর তাদের শূন্য হাতে ফিরতে হবে না,অন্যদিকে এই মহামারী কালীন পদ পূরণে নতুন করে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাছাই প্রক্রিয়ায় অর্থ ও সময় ক্ষেপণও করতে হবে না।এজন্য গতিশীল কর্মকমিশন চলমান ৩৮ তম বিসিএস নন-ক্যাডার এবং ৪০ তম বিসিএস থেকেই সেই পদক্ষেপ নিতে পারে, যা পরবর্তী বিসিএস গুলোতেও অনুসরণ করা হবে।তাহলে রাষ্ট্র পাবে সর্বোচ্চ মেধাবীদের,দেশ হবে বেকারত্বের অভিশাপ মুক্ত সোনার বাংলা এবং সেই সাথে মেধাবীদের স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্পেরও ইতি ঘটবে।
লেখক: নাট্যকার ও কলামিস্ট।