কোরবানি, পশুপ্রেম ও অমানবিকতার বয়ান
- সালেহ উদ্দিন সিফাত
- প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২১, ১২:০০ AM , আপডেট: ২১ জুলাই ২০২১, ১২:০০ AM
প্রতি বছর কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে আসলে কেউ কেউ পশুহত্যা, নিষ্ঠুরতা, রক্তপাত ইত্যাদির ধুন তুলে কোরবানিকে একটা অমানবিক ও নির্দয় উৎসব হিসাবে প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগে। পাশ্চাত্যের একাডেমিয়া থেকে ডিগ্রিধারী কেউ কেউ তো করোনাকেও কোরবানির বিপক্ষে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। সচেতন মুসলমানরা এই ঠুনকো বিরোধিতার সমুচিত জবাবও দেন।
তবে এই অহেতুক সমালোচনা ও ইসলামবিদ্বেষিতার জবাব দানের ভাষা কিছু কিছু জায়গায় আমার কাছে সমস্যাজনক বলে মনে হয়েছে। জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই বিরুদ্ধবাদীদের বিরোধিতার গ্রাউন্ডকে আমলে নিয়েই পাল্টা যুক্তি দিতে চান।
‘‘কোরবানি আসলে যাদের পশুপ্রেম উথলায়ে উঠে...’’ এরকম ন্যারেটিভে যারা বিরোধিতাকারীদের ক্রিটিক করেন, তাদের অনেকেই উল্লেখ করেন না বা ভুলে যান যে, কোরবানি নিজেই একটা পশুপ্রেমের ঘটনা। এটা স্পষ্ট করা জরুরি। নতুবা, একটা চিত্র সামনে দাঁড়াবে যেখানে মুসলমানরা পশুর প্রতি কোনো মায়া-মমতা রাখে না।
পরোক্ষভাবে স্রেফ খাদক ও রক্তপিপাসু একটা জাতির চিত্র সামনে তুলে ধরার খায়েশ লুক্কায়িত থাকে পশুপ্রেমের নামে কোরবানির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া লোকদের মনে। পশুর প্রতি টান থাকা খোদ রাসুলের শেখানো আদর্শ। আমরা কোরবানির পশুপ্রেম বুঝি না, কারণ পশু লালন-পালনের সাথে এখন আমাদের সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
যে নিজের পালিত পশুকে কোরবানি দেয়, তার টান স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। গত বছর আমরা ছাগল কোরবানি দিয়েছিলাম। ছোটো ভাই ছাগলটাকে প্রায় ৪-৫ দিন লালন-পালন করেছিল। কোরবানির দিন সে নিজেকে সংবরণ করতে পারে নাই। ছাগলটা যখন কোরবানি হওয়ার আগে ‘ম্যাঁ’ বলে চিৎকার দিলো, ছোটো ভাই বুক ফাটানো কান্না কেঁদেছিল। ছোটো থাকতে একজন ব্যাপারির কান্না দেখেছিলাম গরুকে বাড়িতে রেখে যাওয়ার পর।
এরকম অহঃরহ ঘটনা আমরা পত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখি। অনেকের প্রকৃত অভিজ্ঞতাও হয়েছে। পশু লালন-পালন প্রক্রিয়া সাথে জড়িত না থাকায় এই প্রেমের মূল্য বুঝার অবস্থানে আমরা নেই। নবীর হালতে তথা রাখালের অবস্থানে অবতীর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত পশুর প্রতি এই ভালোবাসা আমরা বুঝবো না। রাসুল কোরবানির আগে পশুর সামনে ছুরি দেখাতে না করেছেন।
এক পশুর সামনে আরেক পশুকে জবাই দিতেও না করেছেন। পশুর সেন্সিবিলিটি নিয়েও রাসুল (সা.) এতোটাই সচেতন ছিলেন। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে রাহমাতুল্লিল আ'লামীন উপাধি এমনি এমনি দেন নি।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কোরবানি দিয়ে পশুর প্রতি ভালোবাসা কীভাবে প্রমাণিত হয়? প্রকৃতার্থে কোরবানি একটি ভালোবাসার উপর আরেকটি ভালোবাসার জয় লাভের উৎসব। আল্লাহকে রাজি-খুশি রাখাই কোরবানির মৌলিক উদ্দেশ্য। ইব্রাহীম (আ.) এর ঘটনাটা এক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য। তাছাড়া, কোরবানিকে সবচেয়ে ভালোভাবে উপলব্ধি করার জন্য কুরআনের এই আয়াতটি সবচেয়ে উপকারি হবে।
‘ক্বুল ইন্না স্বলাতি, ওয়া নুসুকি, ওয়া মাহইয়ায়া ও মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আ'লামীন।’ (নিশ্চয় আমার নামায, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সব বিশ্বের প্রতিপালক মহান প্রভুর জন্য।)
কোরবানি তাঁর জন্য খাস। বাকি অভাবী ও আত্মীয়দের গোশত প্রদান, সবাই মিলেমিশে খাওয়া- এসব তাঁর প্রতি ভালোবাসার বাস্তবিক ফল। ফলে, কোরবানি যদি ঐতিহাসিকভাবে একটা Cultural Resistance বা সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অংশও হয়, তথাপি সেটা একটা পার্টিকুলার ঘটনা। এটাকেই যদি কোরবানির সমর্থনে একমাত্র কারণ হিসাবে হাজির করা হয়, তাহলে ঐ রেজিস্টেন্স সফলতা লাভ করলে কারণটি আর বিদ্যমান থাকবে না।
ঐতিহাসিকরা বলেন, একসময় এই অঞ্চলে গরু কোরবানি করা যেতো না। গরু কোরবানি করলে সেই পরিবারকে চরম নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে যেতে হতো। এমনকি কোরবানিদাতাকে হত্যা করার কথাও অনেকে উল্লেখ করেছেন। বর্তমানে বিজেপি শাসিত ভারতে চলছে একই অবস্থা।
গো-হত্যার কারণ দেখিয়ে অনেক মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ফলে, কোরবানি কেবল একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়; একটা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠারও সংগ্রাম হয়ে উঠছে। কিন্তু Cultural & Political Identity প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে আমরা কি কোরবানি ছেড়ে দিবো? না তো, কারণ কোরবানির মৌলিক উদ্দেশ্য কোনো ম্যাটেরিয়াল ফেনোমেনন বা বস্তুবাদী ঘটনা না; বরং সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক ও ঐশী।
পশুপ্রেম থাকা উচিত। পশুর প্রতি ভালোবাসা না থাকলে আমাদের মানবিকতা তথা আশরাফুল মাখলুকাত মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আমাদের বরং ক্রিটিক করা উচিত পশুপ্রেমকে কোরবানির বিরুদ্ধে একটা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে চাওয়ার খায়েশকে। কোরবানিই পশুপ্রেমের ঘটনা। এটা উপলব্ধি করতে হলে রাখাল হতে হবে অথবা রাখালের মতো ভাবতে জানতে হবে।
আমাদের নবী (সা.) থেকে শুরু করে পূর্ববর্তী অনেক জাতির নবীকেই আল্লাহ রাখালের কার্যক্রমের মাধ্যমে নবুয়তের জন্য উপযুক্ত করে তুলেছিলেন। তাঁদের অবস্থানে নিজেদের উন্নীত করতে পারলেই আমরা কোরবানির ঐশী সুরত অনুধাবন করতে সক্ষম হবো। নতুবা, আর্বান পশ KFC হান্টার হয়ে কোরবানিকে একটা নির্দয় ঘটনা হিসাবে চিত্রিত করে বিদ্বেষিতাই ছড়াবো।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়