হে যুবক! অন্ধকার থেকে বেরিয়ে চল খুঁজি মুক্ত বাতাস
- আসমাউল মুত্তাকিন
- প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৪১ PM , আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৪১ PM
মধ্যরাত্রি! চারদিকে নিস্তব্ধতা। অন্ধকার চারপাশ। এই অন্ধকার টানছে আপনাকে। আপনিও তার ডাকে দিলেন সাড়া। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করা হল। আপনার ফোনটা দিয়ে প্রবেশ করলেন নীল জগতে। দেখতে থাকলেন। কল্পনা করলেন নিজেকে। ক্ষণস্থায়ী আনন্দবোধ করলেন। এখন আর ভালো লাগছে কিছু। কিছুক্ষণ পর আপনি মনে মনে বললেন ‘আগামীকাল থেকে আর প্রবেশ করব না’।
কিন্তু এই কথাটি আপনি গতকালকেও বলেছিলেন! এমন অসংখ্য তরুনদের গল্প আমাদের দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আনাচে-কানাচে। যে গল্পটির বলছিলাম তা হলো পর্ণোগ্রাফি! পর্নোগ্রাফি বর্তমান সমাজের একটি মহামারী আকার ধারন করেছে। যুবক বা তরুনদের অবক্ষয়ের কারন এটি। প্রিয় পাঠক আমি এত পর্নোগ্রাফির কথা বলছি-
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হচ্ছে কারা? কিন্তু কেন?
আমাদের দেশে পর্নোগ্রাফি ব্যবহারকারী কারা, তা নির্ধারণের কোনো চেষ্টা অতীতে কখনো হয়নি কিন্তু সামনে হতে পারে বলে আমার আশা। তবে বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ স্কুল ছাত্রদের নিয়ে একটি জরিপ করেছে। তা ছিল এমন-
ঢাকায় স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফি দেখে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, “আমাদের এই জরিপটি অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে করা হয়। আর তাতে দেখা যায়, পর্নোগ্রাফি তারা ছবি, ভিডিও, অডিও এবং টেক্সট আকারে ব্যবহার করে। এসব পর্নোগ্রাফির আবার বড় অংশই দেশে তৈরি। এই শিক্ষার্থীরা প্রধাণত মোবাইল ফোনে অনলাইনে পর্নোগ্রাফি দেখে। এর বাইরে ট্যাব, ল্যাপটপেও তারা দেখে। আবার পেনড্রাইভ ব্যবহার করে বিনিময়ও করে।।’’
বাংলাদেশে সাধারণভাবে পর্নোগ্রাফির ব্যবহার কেমন বা কারা এর ভোক্তা? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এ নিয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট জরিপ নেই। জরিপের ফলোআপে দেখা যায়, ৩০-৩৫ বছর যাদের বয়স এবং তাদের মধ্যে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের শতভাগই একবার হলেও পর্নোগ্রাফি দেখেছেন। নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখেন ৯০ ভাগ। আর যুবনারীদের মধ্যে সংখ্যাটা শতকরা ৫০ ভাগ।”
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপে আরো কিছু তথ্য উঠে এসেছে। তার মধ্যে বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে পর্নোগ্রাফির প্রবণতা বাড়ছে। এই পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধে আমাদের দেশে আইন নেই বিষয়টা এমন না, আইন ঠিকই আছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আইন থাকা সত্ত্বেও এই প্রবণতা হ্রাস পাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু তা না হয়ে বরং তা বাড়ছে ভয়ানক গতিতে।
যদিও বিটিআরসি ৫৬০টি পর্ন সাইট বন্ধ করেছে, কিন্তু পর্নোগ্রাফির জগত তো আর এই (৫৬০টি সাইট) গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। তার আছে যে এক বিশাল ফিল্ড বা বিস্তার ! আর বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা কি কম মেধাবী? তারা ভালো করেই জানে কীভাবে এই বন্ধ থাকা সাইটগুলো প্রবেশ করতে হয় ভিপিএন দিয়ে।
সংস্থাটি আরও বলেছে, পার্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনটি সুনির্দিষ্ট একটি আইন। এ আইনের অধীনে একটি-দুটি মামলায় দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়ার নজির থাকলে অপরাধীরা ভয় পেত।
এই তো গেল আমাদের সোনার দেশে পর্নোগ্রাফির চিত্র। এখন আপনি চিন্তা করুন আপনি যদি আপনার ছোট ভাই বা বোন কিংবা ভাগিনা, ভাতিজা, ভাতিজিকে সতর্ক না করেন, এর ভয়াভয়তা না বলেন কী জানি উপরের পরিসংখ্যানে পড়ে যেতে পারে আপনার প্রিয়জনও। তা আমরা নিশ্চয়ই চাই না।তাই না!
তাই এর বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর অবস্থান নিতে হবে। সচেতন করতে হবে অভিভাবকদের। ছেলে, মেয়ে সহ পরিবারের ছোটদের প্রতি যত্নবান করতে হবে। তারা যেন সারাদিন মোবাইল, কম্পিউটার বা ল্যাপটপে পড়ে না থাকে, সেদিকেও আপনার নজর দিতে হবে। আর হ্যাঁ, আপনাকে একটি তথ্য দেই।
আপনি এখন (বাংলাদেশে) যদি কম্পিউটারের সামনে থাকেন, তাহলে গুগলে শুধুমাত্র “চ” লিখে দেখেন সার্চ দেওয়ার দরকার নেই। দেখেন গুগল আপনাকে কী সাজেস্ট করে। এখন আপনার মনে প্রশ্ন হতে পারে এই সাজেস্ট গুগল কেন করে ?
কারণ গুগল সেই জিনিসই বেশি দেখায়, যেটা তার কাছে বেশি হিট বা রিকোয়েস্ট আসে। আর এই রিকোয়েস্টগুলো আমাদের ছেলেমেয়েরাই করছে বা করে থাকে। কতটা ভয়ানক তাই না!
কিন্তু এই “চ” যদি আপনি সাউথ কোরিয়া থেকে লিখেন, সেখানে কিন্তু এই আজেবাজে সাজেস্ট গুগল করবে না যা আপনাকে বাংলাদেশে করেছিল। কারণ গুগল একটি নির্দিষ্ট system এ সার্চ করে। এখন কিছু পর্নোগ্রাফির পরিসংখ্যান ও বিভিন্ন দেশের এই নিকৃষ্ট (পর্নোগ্রাফি) জিনিসের চিত্র তুলে ধরি।
পর্নোগ্রাফির পরিসংখ্যান
একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে প্রতি ১ সেকেন্ডে এই ভয়ানক 3,075.64 ডলার ব্যয় করা হয়। যা বাংলা টাকায় দাঁড়ায় ২৪৯,৬৭৪ টাকা। কী? অবাক হচ্ছেন?
পর্নোগ্রাফির জগতে এইগুলো পানিভাত। এটা তো মাত্র ১ সেকেন্ডের হিসাব। ১ দিনের টাকার পরিমাণ কত হবে ভাবতে পারেন! হিসাবটা নিজেই করে দেখুন। সারাবিশ্বে ২৮,২৫৮ জন মানুষ পর্ন দেখে ১ সেকেন্ডে। ৩৭২ জন মানুষ যে word টি search engine এ সার্চ করে সেটি হলো “adult” এ তো গেল সেকেন্ডের কথা। এখন মিনিটের কত হবে বলতে পারেন!
১টি পর্নোগ্রাফিক ভিডিও তৈরি করে আমেরিকা প্রতি ৩৯ মিনিটে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। আমেরিকা। ভার্চুয়াল জগত তথা ইন্টারনেটে এই পর্নোগ্রাফি যা মানব চরিত্র কলুষিত করছে তার অবস্থান।
আপনি কি জানেন ইন্টারনেটের জগতে পর্ন সাইট কয়টি আছে? না, না! কয়টি বললে ভুল হবে। কত লাখ আছে? জেনে অবাক হবেন ৪.২ মিলিয়ন, মানে ৪২ লাখ! যার মানে ইন্টারনেটের মোট সাইটের ১২%। সাংঘাতিক ব্যাপার, তাই না?৬৮ মিলিয়ন, মানে ৬ কোটি ৮০ লাখ মানুষ দৈনিক সার্চ ইঞ্জিনে রিকোয়েস্ট পাঠায় (মানে পর্ন দেখতে চায়) যা মোট রিকোয়েস্টের ২৫%।
হায়! হায়! এই হিসাবটা বলতে গেলো এর লিস্ট আরও লম্বা হবে।যা আর বলতে চাই না।
এখন প্রশ্ন হলো পর্ন দেখলে কী কী ক্ষতি হয়
অতিরিক্ত পর্নের নেশা ড্রাগের চেয়েও মারাত্মক ও ভয়ানক। পর্ন ড্রাগ, মদ বা সিগারেটের মতোই আসক্তি তৈরি করে। পর্ন দেখলে মস্তিষ্কে একটা ‘ফিল গুড’ রাসায়নিক তৈরি হয়। এর নাম ডোপামিন। একটানা পর্ন দেখলে মস্তিষ্কে ডোপামিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন সামান্য ডোপামিনের ক্ষরণে উত্তেজনা তৈরি হয় না। আরও বেশি ডোপামিনের জন্য মস্তিষ্ক আরও বেশি পর্নের রসদ খোঁজে এবং আসক্তি বাড়িয়ে তোলে।
অতিরিক্ত পর্নের আসক্তি সম্পর্কের ক্ষতি করে। যত বেশি পর্ন দেখবেন, ততই আপনি একটা অলীক ফ্যান্টাসির জগতে চলে যাবেন। এর ফলে বাস্তবের সম্পর্কগুলো আর আপনাকে সুখ দিতে পারবে না, যা সম্পর্কের অবনতির অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে ওঠে। এর কারনে ধর্ষন, নারী নির্যাতন ও ডিভোর্স হয়।
অতিরিক্ত পর্ন মানসিক রোগের জন্ম দেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পর্ন দেখা হয় একা, সমাজের চোখ এড়িয়ে। এর ফলে ধীরে ধীরে একটা অপরাধ বোধ জন্ম নেয়। যা থেকে ভবিষ্যতে মানসিক রোগ হতে পারে। বদমেজাজি, খিটখিটো হয়। ফলে খুন, হত্যা ইত্যাদি ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
পর্নোগ্রাফি অথবা অশ্লীলতার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
আল্লাহ্ তা’আলা অশ্লীলতা সম্পর্কে কুরআনে বলেন, আপনি বলে দিন, আমার পালনকর্তা কেবলমাত্র অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য……। [সূরাহ আল-আ’রাফ (৭) : ৩৩]
যারা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে দুনিয়া ও পরকালে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি; আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। [সূরাহ আন-নূর (২৪): ১৯]
এ থেকে মুক্তি মিলবে কিভাবে? এক কথায় বলতে পারি এসব নীল জগত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলে মুক্তি মিলবে।
এখন অনেকে বলে থাকেন , অনেক অনেক চেষ্টা করার পরও পর্ন দেখার অভ্যাস ছাড়তে পারছেন না। আমি বলি এটা একটা অজুহাত মাত্র। আপনি পারবেন। আপনার দ্বারাই সম্ভব। আপনি তো শুধু পর্ন watcher (মানে শুধু দেখেন)। একবার চিন্তা করুন performer এর কথা, যাকে ঘিরে এই পর্ন ভিডিও তৈরি করা হয়। যদি সে পারে এই অসভ্য কাজ থেকে চলে আসতে, তাহলে আপনি কেন শুধু দেখা বন্ধ করতে পারবেন না?
তেমনই এক porn performer ব্যক্তি তাঁর সময়ে সে ছিলেন most successful male porn performer. তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন কেন তিনি এই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারের শেষে তিনি একটি উক্তি করেন, যা আমি তুলে ধরছি।
“If I can change my heart, (এতটুকু বলে তিনি মুচকি হাসি দেন) anybody can.” তাই চল বন্ধু। এই নীল জগত থেকে বেরিয়ে এসে খুঁজি পৃথিবীর সুন্দর মুক্ত বাতাস।খুঁজি সুন্দর আলো।যা আপনার মনকে প্রশান্তি দিচ্ছে।
লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী