বিশ্ববিদ্যালয় দিবস কাল
জবির উঠান ছোট হলেও আকাশ অনেক বড়
- আব্দুল্লাহ্-আল-মামুন
- প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২০, ০৬:২৫ PM , আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২০, ০৬:২৫ PM
আগামীকাল মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার প্রতিষ্ঠার ১৫তম বছর পেরিয়ে ১৬তম বছরে পা রাখছে। এই শুভলগ্নে প্রিয় প্রতিষ্ঠানটির প্রতি রইলো প্রাণাধিক ভালোবাসা।
জগন্নাথ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসাবে ১৬তম বছরে পা রাখলেও প্রতিষ্ঠান হিসাবে এটি বেশ পুরনো। বলতে গেলে প্রতিষ্ঠানটির সুদীর্ঘ এক ইতিহাস রয়েছে। ১৬২ বছরের বর্ণাঢ্য ইতিহাস। ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুলের নাম বদল করে বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরী তাঁর বাবার নামে ১৮৭২ সালে জগন্নাথ স্কুল নামকরণ করেন।
১৮৮৪ ও ১৯০৮ সালে এটি যথাক্রমে দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়। এটি সে সময় ছিল দেশের উচ্চশিক্ষা বিস্তারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০০৫’ পাশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এরপরে আওয়ামীলীগ শাসনামলে ২৭/৪ ধারা বাতিলের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গতা আসে।
খাতা-কলমে বা আইনের আঙ্গিকে পূর্ণাঙ্গতা বলতে যা বুঝায় অতটুকুতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সীমাবদ্ধ ছিলো। এর বাইরে একটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে আত্মপ্রকাশের জন্য যে সকল শর্তাবলী পূরণ থাকা দরকার তার কোনটাই ছিলো না।
এজন্য মাঝেমধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান আক্ষেপ করে বলেন, ‘২০০৫ সালে স্রেফ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়েছে।’
প্রতিষ্ঠাকালীন জগন্নাথে বলার মতো ছিলো- সাত একর জায়গা, পুরনো জীর্ণশীর্ণ রংচটা ক’টা ভবন, ভাঙাচোরা চেয়ার-টেবিল, দেয়ালে সাঁটানো ছেড়াফাঁটা পোস্টার, ধুলোয় ধূসরিত জ্যোতির্ময় ইতিহাস।
বৈরি পরিবেশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও অল্প কয়েক বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি সবার নজর কেড়েছে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি। প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড় এবং একইসাথে ভর্তির আগ্রহ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে আশাবাদী করেছে।
বর্তমানে ছয়টি অনুষদের অধীনে ৩৬টি বিভাগ এবং ২টা ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে ২২,০০০ শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভরসার জায়গা একঝাঁক তরুণ, পরিশ্রমী এবং মেধাবী শিক্ষক। পৃথিবীর নামকরা নানান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাদের ঝুলিতে রয়েছে একাধিক উচ্চতর ডিগ্রী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকূল অ্যাকাডেমিক পরিবেশ (শ্রেণীকক্ষের সংকট, শিক্ষকদের বসার স্থানাভাব) না থাকা স্বত্বেও শিক্ষকদের আন্তরিকতা এবং দায়িত্বশীলতার কারণে বিজ্ঞান অনুষদের হাতেগোনা কয়েকটা বিভাগ ছাড়া বাণিজ্য, কলা ও মানবিক অনুষদের অধিকাংশ বিভাগগুলো সেশনজট মুক্ত রয়েছে।
স্বল্প বাজেট ও আনুষঙ্গিক সীমাবদ্ধতার দরুণ গবেষণা ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও অ্যাকাডেমিকসহ চাকরির বাজারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তার অনন্যতা বজায় রেখেছে। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর ১০-১২ জন শিক্ষার্থী প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ নানান প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে থাকে।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সীমাবদ্ধতা ছিল, এখনো সেগুলো সমাহারে বর্তমান। বলতে গেলে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসেনি। তবে বরাবরের মতো এ প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এগিয়ে। ছোট পরিসরে হলেও এখানে নানান ধরনের সংগঠন রয়েছে, যেমন: বাঁধন, বিএনসিসি, উদীচী, সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন, ডিবেটিং সোসাইটি, ফিল্ম সোসাইটি, ফটোগ্রাফিক সোসাইটিসহ চারুকলা ও সঙ্গীত বিভাগের অধীনে পরিচালিত আরও একাধিক সংগঠন।
ক্রীড়াক্ষেত্রেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় খুব করে অগ্রসর না হলেও, বলতে গেলে একেবারে পিছিয়ে পড়েনি। প্রতি বছর আন্তঃবিভাগীয় ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবলসহ ইনডোর গেমসের আয়োজন করে থাকে। দলীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে দেশ ও বিদেশের নানান প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে সাফল্য বয়ে আনে শিক্ষার্থীরা। ২০১৯ এসএ গেমসে চারুকলার শিক্ষার্থী মারজান আকতার প্রিয়া বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক অর্জন করেছিল।
শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংগ্রামমুখর ইতিহাসের সাথে জগন্নাথের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান । ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র সামরিক সরকারের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ , ৬৬’র ছয়দফা দাবি, ৬৮’র এগারো দফা , ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধসহ তৎপরবর্তীকালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য।
এছাড়াও দেশের যেকোনো যৌক্তিক সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক -কর্মকর্তা-কর্মচারী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস সম্প্রসারণ, আবাসন সমস্যার সমাধানসহ নানান যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করতে থাকে, যার ধারাবাহিকতা এখনো বিরাজমান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে জগন্নাথের জন্য ২০০ একর জায়গা বরাদ্দ দেয়। ইতোমধ্যে জমি অধিগ্রহণ এবং সীমানা নির্ধারণের কাজ শেষ হয়েছে।
এছাড়া আধুনিক সুযোগসুবিধা সম্বলিত ক্যাম্পাস তৈরির রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে, ইন্টারনেটের কল্যাণে যা আমরা দেখে আনন্দিত হয়েছি। বাকিটা বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নানান সমস্যাকে পদদলিত করে গত দেড় দশকে যেভাবে এগিয়েছে, তাতে আগামী দশকের শেষের দিকে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কেবল সময়ই বলে দেবে। আগামীর হাতে প্রিয় প্রতিষ্ঠানকে সপে দিলাম।
জয়তু, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়