ধর্ষণ করতে বেডাগিরি লাগে, বেডাগিরির জন্য ক্ষমতা

কামরুল হাসান মামুন
কামরুল হাসান মামুন

ধর্ষণ করতে বেডাগিরি লাগে। আর বেডাগিরি দেখানোর জন্য ক্ষমতা লাগে। ক্ষমতার জন্য ক্ষমতাসীন দল করা বেডাগিরি অর্জনের সবচেয়ে সহজ পথ। ক্ষমতাসীন দল করলে শত অপকর্ম করে কোন বিপদে পরলে দলবদ্ধ শেল্টার পাওয়া যায় আবার একই সাথে পুলিশের আস্কারা পাওয়া যায়। সরকার আর পুলিশ মিলে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যে, সরকারি দলের কেউ কোন অন্যায় করলে সহজে ধরবে না। সেই অন্যায়টি যত জঘন্যই হউক। কারণ ধরলে দেখা গেছে পুলিশ উল্টো পানিশমেন্টের শিকার হয়। ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে ক্ষমতার সুতাটা কেটে দিতে হবে।

আবার ক্ষমতা থাকলেই ক্ষমতার বলে বেডাগিরি দেখানো একটি অসভ্যতা। ক্ষমতা থাকলেও ক্ষমতাকে ধারণ করে ক্ষমতাকে ভালো কাজে ব্যবহারের জন্য সুশিক্ষার প্রয়োজন। আমাদের বর্তমান সমাজে সেই সুশিক্ষা দেওয়ার মত শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠান দুটোরই অভাব। এই অভাব ৩০ বছর যাবৎ আমাদের সরকারেরাই সৃষ্টি করেছে তাদের লাভের জন্য। অশিক্ষিত সমাজকে বোকা বানানোর অনেক লাভ। যদিও সেই লাভটা আসল লাভ না। শেষ বিচারে তারাও হারে। কিন্তু সরকারে যদি আলোকিত নেতৃত্ব না থাকে তারা কেবল এই মুহূর্তের লাভই দেখতে পায়। দূরের লাভ বোঝার মত বোধ বা দেখার মত চোখ কোনোটিই তাদের নেই।

একটু আগে আমার সরাসরি ছাত্রী না হয়েও আমি যাকে প্রিয় ছাত্রীর (Samsun Nahar Rakhy) একটা স্ট্যাটাস পড়লাম। সে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে পাশ করেছে। তার লেখাটি কাট & পেস্ট করলাম। এটা হতে পারতো me too আন্দোলনের পার্ট। তারপরও এই পোটেনশিয়াল ধর্ষক শিক্ষকের বিচার কামনা করি। শিক্ষকরা যখন এমন বেডাগিরি দেখায় সেখানে ভালো সমাজ কীভাবে আশা করব? বাকিটা ছাত্রীর লেখাটি পড়ুন এবং ভাবুন।

‘‘এখনও ধর্ষিত হইনি। কিন্তু হতে পারতাম, বহুবার! আজকে একটা ঘটনা বলি।
২০০৯ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সেমিস্টারের পিএল চলে। সাথে ঈদের ছুটিও ছিল সম্ভবত। ডিসিপ্লিন বন্ধ। বাসায় বসে টিভি দেখছিলাম। এরমধ্যে ফোন আসলো সিআর Bayzid Alam Khan এর নম্বর থেকে। ও বলল, মোল্লা আজিজুর রহমান স্যারের ক্লাস টেস্ট দিছিলি তুই? তোর শীট তো স্যার খুঁজে পাচ্ছেন না। এইমাত্র বললেন আমাকে। স্যার তোকে ফোন করে কনফার্ম করতে বলেছেন। ফোন কর জলদি।

ফোন করলাম।
- সিটি দিয়েছিলে?
-জি, স্যার। দিয়েছি তো!
-খুঁজে পাচ্ছি না। আচ্ছা, দেখি আরও খুঁজে। পেয়ে যাবো হয়তো। (ধানাইপানাই)... আচ্ছা, তুমি কী একটা সমস্যা নিয়ে আসছিলে না? এখন আমি ফ্রি আছি। আসতে পারো।
মনে পড়ে গেল, কী কারণে যেন রুমানা ম্যামের রুমের সামনে উঁকি মারছিলাম। স্যার দেখে বলেছিলো, কী সমস্যা? হঠাৎ কী বলবো, পড়াশুনা বিষয়ক একটা প্রশ্ন হাজির করলাম। স্যার বলেছিল, এখন ব্যস্ত। পরে এসো। মাথা নেড়ে বিদায় হলাম। স্যার তো কারণে অকারণে আমাদের ইনসাল্ট করার জন্য মুখিয়ে থাকে। হঠাৎ যেচে পড়ে উপকার করতে চাইছে! খটকা লাগলো। বললাম, ঠিক আছে, স্যার। প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। সমস্যা নাই। ধন্যবাদ।

- টার্ম ফাইনালের প্রস্তুতি কেমন চলছে? তুমি এলে কিছু ব্যাপারে গাইডলাইন দিতে পারি।
আমার সন্দেহ বাড়লো।
-স্যার, ছুটি চলছে তো। ডিসিপ্লিন কি কোনো কারণে খোলা?
- না, আমার বাসায় চলে আসো। তুমি নিরালা এলাকা চেনো?
এবার আমি মোটামুটি নিশ্চিত, ব্যাটার মতলব খারাপ। কারণ উনার সাথে আমার এমন কোন সখ্যতা হয়নি যে আমার জন্য তার দরদ এতো উতলাইয়া পড়বে!
তবু কড়াভাবে কিছু বলতে পারিনি (এখন হলে ওর কপাল খারাপ আছিলো)। তাই
ছুতা দেয়া শুরু করলাম।
- না, স্যার। তেমন একটা চিনি না। ভেতরে যাইনি (মিছা কথা। ছাত্রী পড়াই নিরালায়)।
- সমস্যা নেই। ইজি এড্রেস। বলে দিলেই আসতে পারবে।
স্যার, আমার ছাত্রছাত্রী আসবে বিকেলে। এখন প্রায় দুটো বাজে। আর আমার বাড়ি ফুলতলা, নিরালা থেকে একঘণ্টার পথ।
- ও, আচ্ছা।
ফোন রেখে দিলো সে।
পাশে বড় আপা বসে ছিল। ফোন লাউড মোডে দেয়া ছিলো, সব শুনেছে আপা। আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে বললাম, কী হলো এটা!
বড়আপা বললো, একদম সাবধানে থাকবি এর ব্যাপারে। উদ্দেশ্য ভালো না।
আমি বললাম, সে তো বুঝতেই পারছি। আমি বরং যাই। গিয়ে দেখি ও আমার কী ছিঁড়তে পারে।
- কোনো বীরত্ব দেখানোর দরকার নাই। পুরুষ মানুষের সাথে গায়ের জোরে পারবি না। এড়িয়ে চলাই নিরাপদ। কেউ ওর দিকে আঙুল তুলবে না, তোর দিকে তুলবে।
- আমার কি দুর্নামের অভাব আছে? আর কী হবে? আর একা তো যাবো না। Nayeem Hasan , Anindya Munasib Bayazid ওদের নিয়ে যাবো। হাতেনাতে ধরবো ব্যাটাকে।
যাই হোক, আমার মাস্টারপ্ল্যান খারিজ করে দিলো বড় আপা। এরই মধ্যে আবার ফোন বাজলো। শ্রদ্ধেয় স্যারের নম্বর!
- শোনো, তোমার ছাত্রদের আজকে আসতে মানা করে দাও।
- ওদের সবার নম্বর নাই আমার কাছে। আর সামনে ওদের ভর্তি পরীক্ষা তো। এখন মিস দিলে ক্ষতি হবে, স্যার।
কোনোভাবেই হচ্ছে না দেখে রণে ভঙ্গ দিল শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমার।
মাথা পুরাই খারাপ নাকি এই লোকের! এ কী নির্লজ্জ পারসুয়েশন!
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার কল বাজলো। আবারও স্যার। বলল, শোনো, আমি যে তোমাকে ফোন করে আসতে বলেছি এটা তোমার বন্ধুদের বলো না। ওরা তোমাকে খারাপ ভাবতে পারে। তুমি তো সহজ সরল মেয়ে। অনেক কিছু বুঝবে না। ওরা নানান কথা ছড়াবে যদি শেয়ার করো।
-জি, স্যার। বলবো না।
(বলা বাহুল্য, আমার চেহারায় গাধা ভাব প্রকট!)

এরপর থেকে শুরু হলো স্যারের সাথে আমার ঠান্ডা যুদ্ধ!
ক্লাসে তার দিকে এমনভাবে তাকাতাম, যেন চোখ দিয়েই বলে দিতাম, কী বাল পড়ান আপনি। ভাড়ামি যতসব!

আর সেও তার প্রেমের নিদর্শন দেখাতো পরীক্ষার খাতায়। পুরো চার বছর তার সব কোর্সে দরিদ্র ফলাফল। রেজাল্ট নিয়ে আফসোস করি না। কিন্তু হাজার উপায়ে মানসিক অত্যাচার করেছে, ক্লাসে অপমান করেছে। আফসোস হয়, কেন তখন রেজাল্ট খারাপের ভয়টাকে পাত্তা দিছিলাম!
**লেখাটি যারা পড়লেন, কী মনে হয়, স্যারের উদ্দেশ্য কী ছিল?
** ঝুলায়ে রাখার মানে নাই। নাম বলে দিলাম।’’ [ফেসবুক থেকে]

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ