গ্রাফিতি আঁকতে অনুমতি, ধর্ষণ করতে গেলে কি অনুমতি নিতে হয়?

তসলিমান নাসরিন
তসলিমান নাসরিন

সারাদেশে সংগঠিত ধর্ষণ নিয়ে লিখেছেন নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্ষণের পাশাপাশি পুলিশেরও সমালোচনা করেছেন তিনি।

তসলিমা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের পুলিশকে কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে জাদুঘরে রাখার সময় হয়ে গেছে। পুলিশের কাজ রাতে টহল দেওয়া, চোর ছ্যাঁচড়, গুণ্ডা বদমাশ, ধর্ষক নির্যাতক, খুনী সন্ত্রাসীদের ধরা, শহর বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ও মা, বাংলাদেশের পুলিশ ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে সচেতন ছাত্র ছাত্রী গ্রাফিতি আঁকছিল, তাদের মেরে ধরে ভ্যানে উঠিয়ে থানায় নিয়ে রাতভর অত্যাচার করেছে। পুলিশ বলছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে গ্রাফিতি আঁকতে অনুমতি নিতে হয়। ধর্ষণ করতে গেলে কি অনুমতি নিতে হয়? অবশ্যই নয়। অনুমতি ছাড়া অন্যায় করা যাবে, অনুমতি ছাড়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যাবে না।

দেশটা নষ্ট হতে হতে একেবারে গলে গেছে। দেশের মস্তিস্ক থেকে এখন দুর্গন্ধ পুঁজ বেরোচ্ছে। এই দেশই তো মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলাম বলে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে আমাকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমাকে বলা হয়েছিল, ‘লেখালেখি পত্র-পত্রিকায় ছাপাতে চাইলে আমাদের অনুমতি নিতে হবে’। মৌলবাদিরা যে দেশ জুড়ে নারী নির্যাতন করে বেড়াচ্ছিল, তাতে অবশ্য তাদের অনুমতি নেওয়ার কথা কেউ বলেনি।

ভালো কাজ করার সময় যে সরকার অত্যাচার করে, নির্বাসনে পাঠায়, জেলে ভরে, সেই সরকার নিজের ভালো ছাড়া আর কারও ভালো চায় না। দেশের ভালো তো চায়ই না।’

এর আগে তিনি লেখেন, আমাদের দুঃখ এই, আমরা মেয়েরা সংখ্যাগুরু হই, সংখ্যালঘু হই আমরা কেউ নিরাপদ নই। কারণ আমাদের দুর্ভাগ্য এই, আমরা এক সমাজে যাদের সঙ্গে বাস করি, তারা সকলেই পুরুষ নয়, তারা অনেকেই চক্ষুকর্ণহীনবোধবুদ্ধিবিবেকহীন পুরুষাঙ্গ। এই পুরুষাঙ্গগুলো যতদিন না পুরুষ হয়ে উঠবে ততদিন ধর্ষণ বন্ধ হবে না। পুরুষাঙ্গ হওয়া কোনও গৌরবের ব্যাপার নয়। যদিও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের পুরুষাঙ্গ হয়ে ওঠার প্রেরণাই জীবনভর জুগিয়েছে। জন্মের সময়ই তো নবজাতকের পুরুষাঙ্গ দেখে পরিবারে খুশির ফোয়ারা ছোটে। সেই থেকে শুরু। তারপর পরিবারের পুত্রধনকে যে হারে সেবা যত্ন করা হয়, তার পেছনে ধন সম্পদ যেভাবে ব্যয় করা হয়, তার জন্য আশা আকাঙ্ক্ষা যেভাবে জমানো হয়, যত স্বপ্ন দেখা হয় তাকে নিয়ে- তাকে একরকম সম্রাট বানিয়ে দেওয়া হয়। সম্রাট তো হবেই অহংকারী, করবেই ধরাকে সরা জ্ঞান। তাকে তো জন্ম থেকে শেখানো হয়, সে ছেলে বলে সে মূল্যবান, আর অজস্র যে মেয়ে আছে পরিবারে , সমাজে, তারা কেউ তার মতো মূল্যবান নয়। মেয়েদের জন্ম পুরুষের সেবা করার জন্য, পুরুষের ভোগের বস্তু হওয়ার জন্য, পুরুষের সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য। যেমন শেখে, তেমন ব্যবহার করে। যতদিন এই সমাজ পুরুষকে মেয়েদের চেয়ে মূল্যবান মানুষ হিসেবে মানবে, ততদিন ধর্ষণ চলবে। ধর্ষণ যারা করে, তারা সবাই মগজধোলাই হওয়া লোক। পরিবার, সমাজ, এবং রাষ্ট্র তাদের অবিরাম মগজধোলাই করেছে। রাষ্ট্রের তৈরি পারিবারিক আইনে পুরুষের অধিকার বেশি। সমাজের রীতিনীতি পুরুষ তৈরি করেছে, পুরুষেরই জয়জয়কার সেসবে, পরিবারে পুরুষই হর্তাকর্তা। এই সব পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙ্গে ফেলতে হবে, তবেই না সমতা আসবে। নারী এবং পুরুষের সমানাধিকার চর্চা না হলে ধর্ষণ বন্ধ হওয়ার কোনও কারণ নেই। প্রভুরা দাসিদের নির্যাতন করে। প্রভু দাসির সম্পর্ক আদিকাল থেকে এমনই। ধর্ষণ একধরণের নির্যাতনের নাম। সমতার সমাজ তৈরি করা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত করা, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলাই ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতন বন্ধ করার উপায়।


সর্বশেষ সংবাদ