আবুল মনসুর আহমদ: সময়ের বিবর্তনে সমানভাবে আবেদনময়ী একটি নাম

  © ফাইল ফটো

বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ এর কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সাধারণ মানুষ। এরই মাঝে জনপ্রতিনিধিদের হরিলুট, পুকুরচুরি’র মতো যে ঘটনা প্রাত্যাহিক দৃশ্যমান তা অনেক আগেই ব্যঙ্গাত্মক ভাবে সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলেছেন আবুল মনসুর আহমদ’র লিখিত গল্পগ্রন্থ ‘ফুড কনফারেন্স’র ‘রিলিফ ওয়ার্ক’ নামক গল্পে।

‘বাইরে রবে হাসির ছটা, ভিতরে রবে অশ্রুজল’। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতার লাইন কোন এক প্রোগ্রামে বলেছিলেন সময়ের কথাসাহিত্যিক, কবি ইমরান মাহফুজ। তার একথার প্রতিচ্ছবি যেন আবুল মনসুর আহমদ’র সাহিত্যকর্ম। আবুল মনসুর আহমদ’র লেখা যেমন হাস্যরসে পূর্ণ; তেমনি রয়েছে অব্যক্ত হৃদয়ের মর্মবেদনা, রয়েছে কান্না। আর সেই কান্না থেকে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু।

আমি যখন নবম শ্রেণিতে ছিলাম! তখন বাংলা পাঠ্য বইয়ের গদ্যাংশে আবুল মনসুর আহমদ’র এক রম্য রচনা ছিলো। নাম তার ‘জনসেবা ইউনিভার্সিটি। তিনি তার এই ব্যঙ্গাত্মাক গল্পে কথিত জনপ্রতিনিধির জনসেবা কে একাডেমিক পদ্ধতির সাথে তুলনা করেছেন। গল্পের নায়ক ইয়াকুব থেকে জ্যাকবে পরিণত হওয়া। তার এক সুন্দর চরিত্রে রূপদান করেছেন তিনি। তার রচনা পড়লে এখনো সময়ের জনপ্রতিনিধি’র চেহারা ভেসে উঠে। তিনি সমাজের শুধু রাজনৈতিক ধূর্ততা নিয়ে কথা বলেন নি।পাশাপাশি ধর্মের নামে ভন্ডামির বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক রচনার মাধ্যমে এক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।

তার অসামান্য রচনার মধ্যে রয়েছে আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ফুড কনফারেন্স, আয়না, গালিভারের সফর নামা, বাংলাদেশের কালচার, আসমানী পর্দা সহ সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে একাধিক রচনা। তিনি বাংলা সাহিত্য এক নতুন ধারার স্রষ্টা। তার ধারায় এখনো লেখালেখি করেন হালের অন্যতম পন্ডিত সলিমুল্লাহ খান ও ফরহাদ মজহার সহ আরো অনেক।

‘আয়না’ তার বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম। তিনি তার এ রচনায় মুসলিম সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। ধর্মের নামে অজ্ঞতাকে পূঁজি করে মোল্লাদের ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। পাশাপাশি মুসলমানদের রাজনৈতিক পশ্চাৎপদতার জন্য তিনি কুসংস্কার কে দায়ী করেন।

‘বাংলাদেশের কালচার’ নামক বইয়ে তিনি বাংলাদেশের সংস্কৃতি বা কালচার কে পাকিস্তান, ভারত থেকে এক আলাদা সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করেছেন। এবং তার পিছনে যে কারণ রয়েছে তা তিনি তার সাহিত্যে স্পষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন

তার অপর এক রচনার নাম হলো ‘ফুড কনফারেন্স।এই গল্পগ্রন্থের সবগুলো গল্পই ব্যঙ্গাত্মক – দুর্ভিক্ষ নিয়ে সমাজের ভদ্রসমাজ বলে পরিচিতদের নিচু মানসিকতা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি বেশ স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে গল্পগুলোয়। ব্যঙ্গের পাশাপাশি রসও আছে, ফলে পড়াটা উপভোগ্য।

মোট নয়টি গল্প আছে বইয়ে, যথাক্রমে ফুড কনফারেন্স,  সায়েন্টিফিক বিযিনেস, রিলিফ ওয়ার্ক এবং জনসেবা ইউনিভার্সিটি। এর মধ্যে রিলিফ ওয়ার্ক গল্পটা কোন এক সময় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।

অসৎ মানসিকতার লোকদের কুযুক্তির প্রয়োগ প্রত্যেকটা গল্পেই দুর্দান্তভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক। তার বিপরীতে আছে সাধারণ জনগণের অসহায় নীরবতা। লেখক মনসুর আহমদ অভিজ্ঞ রাজনীতিক ছিলেন, তার লেখা আরেকটি বিখ্যাত বই আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, ই তার প্রমাণ।

প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের ১২২তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৮৯৮ সালের আজকের এই দিনে তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধানীখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক ছিলেন। তৎকালীন ‘কৃষক’ ও ‘নবযুগ’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন।

১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি।১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী মুসলিম লীগের সহসভাপতি ছিলেন।যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা'র প্রবক্তা এই সাহিত্যিক।

তিনি ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন।পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী এবং ১৯৫৬-৫৭ সালে বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে চারবছর কারাগারে ছিলেন মহান এই রাজনীতিবিদ।

আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদের আহবায়ক, প্রাবন্ধিক, কবি ইমরান মাহফুজের সাথে মুঠোফোনে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, দেখা যায় সৃষ্টিশীলদের কলম বা তুলিতে সব সময় সময়ের করুণ চিত্র ফুটে ওঠে। শিল্পী জয়নুল আবেদিন তার অমর স্কেচে এঁকেছেন দুর্ভিক্ষের চিত্র, কবি ফররুখ আহমদ তার বিখ্যাত ‘লাশ’ কবিতায়, আবুল মনসুর আহমদ ব্যঙ্গ গল্পেগল্পে। তার প্রায় লেখায়, দুর্ভিক্ষের চিত্রের সাথে দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ীদের চিত্র, মৃত মানবতা ও চেতনার চিত্র যথাযথ তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। সামাজিক বিশ্বাস, কুসংস্কার ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে আবুল মনসুর আহমদ তীব্র আঘাত হেনেছিলেন।

সাহিত্যের মহান এই পুরুষ ১৯৭৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

লেখক: শিক্ষার্থী গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ