চলে গেলেন প্রেরণার বাতিঘর

ব্যাংকার ও তরুণ উদ্যোক্তা মোঃ রিদুওয়ানুল হক
ব্যাংকার ও তরুণ উদ্যোক্তা মোঃ রিদুওয়ানুল হক  © টিডিসি ফটো

যার নাম শুনা মাত্রই শিক্ষার্থীরা উচ্চারণ করতেন ‘ডিয়ার স্টুডেন্টস, আমার মেসেজটা পৌঁছে দিবেন’। যে মেসেজে মিশে থাকতো শিক্ষা-দীক্ষা, স্বাস্থ্য ও ক্যারিয়ার গড়ার অসংখ্য তথ্যাবলি। যিনি মেসেজ দিতেন, স্নেহ-মাখা কন্ঠে ডিয়ার স্টুডেন্টস বলতেন, তিনি হলেন কক্সবাজারের টেকনাফস্থ মঈন উদ্দীন মেমোরিয়াল কলেজের সম্মানিত ট্রাস্টি, এসআইবিএল খাতুনগন্জ শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার, বিশিষ্ট সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী প্রয়াত মোঃ রিদুওয়ানুল হক।

তিনি কক্সবাজারের টেকনাফ মৌলভী বাজারে, ১৯৮৩ সালে এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার হাত ধরেই পারিবারিক পরিবেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয় হ্নীলা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। মাধ্যমিক হ্নীলা উচ্চ বিদ্যালয় এবং উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

মানুষ মরণশীল হলেও কর্মগুণে অমরত্ব লাভ করা সম্ভব। মানুষ তার সৎ কর্মের মাধ্যমে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন রিদুওয়ান স্যার। সকলের প্রিয় এই মানুষটি মাত্র ৩৭ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন যা বর্তমান সমাজে দুর্লভ।

তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে শেষ করা যাবে না। মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজের সম্মানিত চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন প্রফেসর ড. ফরিদ উদ্দীন আহমেদ বলেন, মানুষের মৃত্যু অবধারিত। তারপরও কিছু মৃত্যু প্রচণ্ড নাড়া দিয়ে যায়। এমন তরতাজা প্রাণের বিদায় মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়।

মো. রিদুওয়ানুল হক, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার, ৩৯ তম ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষাথী, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৩৭ বছর। তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে গত ১৫-২০ দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

গত মাসে তাঁর বাবাও করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অত্যন্ত মিশুক ও পরোপকারী এই ভাইটির অকাল মৃত্যুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন’র পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করছি। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসীব করুন আর শোকাহত পরিবারের সদস্যদের এই উপর্যুপুরি শোক কাটিয়ে উঠার শক্তি দান করুন।

মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজের আরেকজন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নুরুল হোসাইন ভুট্টো বলেন, আমি তাকে খুব কাছ থেকেই দেখেছি, তীব্র স্বপ্নচারী, কর্মঠ ও ত্যাগী মানুষটি কলেজের জন্য অনেক কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি ছিলেন কলেজের জন্য নিবেদিত প্রাণ এছাড়াও সামাজিক, ধর্মীয়, জনকল্যাণমূলক যে কোন কাজের জন্য স্বেচ্ছায় নিঃসার্থভাবে এগিয়ে আসতেন। আমাদের বন্ধুদের মাঝে তিনি ছিলেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর কর্ম নিঃসন্দেহে তাঁকে অমর করে রাখবে।

যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন তাদের আর একজন হলেন রাবেয়া বিনতে বাদশা, প্রভাষক, মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজ। তিনি বলেন, দিন যায়, কথা থাকে। সময়ের এই অবিরাম স্রোতধারায় কিছু কথা, কিছু স্মৃতি কখনো মুছে ফেলা যায় না। শ্রদ্ধেয় রিদুওয়ান স্যার, যাকে আমি প্রতিষ্ঠানে স্যার সম্বোধন করলেও অন্যসময় ভাই বলে ডাকতাম। উনার মাধ্যমেই আমি কলেজে জয়েন করি। আমাদের মধ্যে পারিবারিকভাবে একটা পরিচয় ছিলো। চট্টগ্রামে যখন ছিলাম তখন আমাদের পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উনি আসতেন। অনেক সময় নিজের হাতে অতিথিদের আপ্যায়ণ করতেন। কলেজে জয়েন করার পরেও সবসময় আমার পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন।

আমরা সহকর্মীরা যখন কলেজ-প্রাঙ্গণে চারারোপণ করতাম, ফুলের গাছ লাগাতাম তখন যে মানুষটি সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন আজ সেই মানুষটিই ফুলের মতো অকালে ঝরে গেলেন। মহান আল্লাহর কাছে এখন শুধু একটিই চাওয়া উনি যেন পরপারে ভালো থাকেন এবং আমরা যেন তাঁর কলেজকেন্দ্রিক অসমাপ্ত কাজগুলো করে যেতে পারি।

মানুষ চলে যাওয়ার পর তার রেখে যাওয়া আচরণগুলো কথা বলে, সব বিষয়ে একমত না হলেও তাঁর কিছু স্মৃতি উল্লেখ করার মত। তিনি মমতার বন্ধনে আবদ্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের যে উপদেশগুলো দিতেন তা ছিল বিরল ও ব্যতিক্রম। স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়ার জন্য তিনি শিক্ষার্থীদের বিশেষ উপদেশ দিতেন। তিনি খুব জোর দিয়ে বলতেন, তোমরা ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে অবশ্যই দুই গ্লাস পানি পান করবে। শিক্ষার্থীদের সুন্দর ও শুদ্ধ উচ্চারণ, সরব পাঠপঠন এবং দ্রুত অথচ সুন্দর লিখন, মার্জিনকৃত উত্তরপত্র লিখতে তাগাদা দিতেন।

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে সাহস যোগাতেন। কেউ ভালো রেজাল্ট করলে স্যার খুশি হতেন, কাছে ডেকে নিয়ে আসতেন, ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখাতেন। সম্ভব হলে যোগাযোগ রাখতে স্যারের ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিতেন। দুর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ নজর রাখতেন।তাদের আলাদা পাঠদানের জন্য বারবার পরামর্শ দিতেন।

পেশাগত জীবনে তিনি একজন ব্যাংকার হলেও শিক্ষকতা পেশাকে উচ্চভাবে মূল্যায়ণ করতেন। তিনি বলতেন, আমি শিক্ষক হতে পারিনি সেটা আমার বড় আপসোস, আমার বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন, আমার ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমার বোন একজন শিক্ষিকা। তাই শিক্ষকদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা থাকবে আজীবন।

তিনি আমাদের বলতেন, আপনাদের পাঠদান সহায়ক কোনো বই লাগলে আমাকে বলবেন, আমি পাঠিয়ে দিব।" তাঁর আরো একটি পরিচয় আছে।তিনি খুব প্রকৃতি প্রেমী মানুষ ছিলেন। হাজারো ব্যস্ততার মাঝে একটু ফুরসত পেলেই ছুটে আসতেন প্রকৃতির কাছে। তিনি 'মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজকে প্রকৃতির লীলাভূমি মনে করতেন, তাই তিনি গ্রামে আসলেই ছুটে চলতেন কলেজপানে।

কলেজের প্রকৃতির প্রতি তাঁর মমত্ববোধ প্রকাশ পায় তাঁর সর্বশেষ মন্তব্যে-Nature always gives us liveliness and vivacity. Missed it badly. My heart is there and body is here. Just want to go to take fresh breath.

প্রকৃতি প্রেমী এই মানুষটি সবাইকে সবসময়ই গাছ লাগানোর জন্য উজ্জীবিত করতেন। যেমন সর্বশেষ কলেজ-পরিদর্শনকালে তিনি শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন, সবাই যেন কলেজপ্রাঙ্গনে একটি করে গাছ লাগায় যাতে কলেজপ্রাঙ্গন ফুলে-ফলে-গন্ধে ভরে উঠে৷

তিনি দেশ, জাতি ও সমাজ নিয়ে ভাবতেন। কিছুদিন আগে তাঁর বাবার জানাজা-নামাযের পূর্ব মুহুর্তে হাজারো মানুষের সামনে তিনি শোকাভিভূত হয়ে বলেছিলেন, আমাদের চরম দুর্ভাগ্য আমরা আজ একজন সৎ, যোগ্য, চৌকস নেতৃত্বকে হারালাম।আমার বাবা শুধু বাবা নয়, তিনি ছিলেন একজন যোগ্য অভিভাবক এবং সমাজের জন্য আলোর দিশারী।

তিনি সামাজিকভাবে অনেক কর্ম কান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। চট্টগ্রামস্থ টেকনাফ সমিতির কোষাধ্যক্ষ এবং 'হ্নীলা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র পরিষদের' স্থায়ী সদস্য ছিলেন। তাঁর মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা এবং সততার কারণে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক অঙ্গসংগঠনের দায়িত্বে পালন করেন। আজ তিনি শারিরীকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর কর্ম, চিন্তা, চেতনা এবং সামাজিক মুল্যবোধগুলো অটুট থাকবে আজীবন।

লেখক: প্রভাষক, মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজ,  টেকনাফ, কক্সবাজার


সর্বশেষ সংবাদ