প্রতিনিয়ত বাবা মাকে মানসিকভাবে খুন করছি

খুবি শিক্ষার্থী হাবিবা (বায়ে) এবং অগাস্ট ১৪’র ওয়েজ সিরিজের পোস্টার
খুবি শিক্ষার্থী হাবিবা (বায়ে) এবং অগাস্ট ১৪’র ওয়েজ সিরিজের পোস্টার  © টিডিসি ফটো

ক’দিন আগে ঐশীকে নিয়ে বাংলা ওয়েব সিরিজ ‘আগষ্ট ১৪’ দেখেছি। আমি শঙ্কিত হয়েছি এবং সবচেয়ে বেশি চিন্তিত হয়েছি তরুণদের নিয়ে। কোন পথে যাচ্ছে আমাদের তরুন প্রজন্ম। যারা কি-না পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ বাবা মাকেও খুন করতে এক মুহূর্তে ভাবছে না। ঠিক এমনভাবে ২০১৩ সালের আগস্টের ১৪ তারিখে নৃশংস কলঙ্কময় ইতিহাস গড়েছিল বাংলাদেশের মেয়ে ঐশী।

সেদিন রাতে নিজের বাবা-মাকে একসাথে খুন করেছিল ঐশী। এমন হাজারো ঐশী আছে আমরাই এক একটা ঐশী! কিভাবে? ঐশী বাবা-মাকে খুন করেছে শারীরিকভাবে আর আমরা অনেকই প্রতিনিয়ত মানসিকভাবে বাবা-মাকে খুন করি। শারীরিকভাবে বাবা- মাকে হেনস্তা করার খবর পত্রিকার পাতা খুললে এখনো পাওয়া যায়। তবে যেভাবে তরুণ প্রজন্ম বাবা-মাকে মানসিকভাবে খুন করছে। সে গুলোর নমুনা তুলে ধরেছি।

*বাবা আমার দামী স্মাট ফোন, ল্যাপটপ লাগবে!
*বাবা আমার সব বন্ধুরা পিকনিকে যাচ্ছে আমার টাকা লাগবে!
*এত কম দামী জামা গায়ে দিব না। বন্ধুদের সামনে যেতে পারি না লজ্জায়। আমার তো সোসাইটি আছে তাই না?!
*মা তোমাদের সন্তান হয়ে জন্ম নেয়াটাই...হইছে। কোনো শখ,আহ্লাদ পূরণ করতে পারি না!
*বাবা আমার মাসিক হাত খরচ দাও। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসতে লজ্জা পাই। সবাই খাওয়ার জন্য বায়না ধরে। ফকিরের ছেলের মত আর কতদিন এভাবে পাশ কাটিয়ে যাব?
*মা এসব কি রান্না করো প্রতিদিন। এক খাবার খেতে ভালো লাগে কারো। খাওয়া- পরার দায়িত্ব যখন ঠিকমত পালন করতে পারবা না তো জন্ম কেন দিয়েছিলে?

ইত্যাদি আরো অনেক কথা যা আমরা প্রায়শই বাবা- মা কে বলে থাকি নিঃসঙ্কোচে। কিন্তু আমরা কি একবারো ভেবে দেখেছি এতে তারা কতটা কষ্ট পান? হয়তো অনেকে ভাবিনা ভাববার প্রয়োজন ও মনে করিনা। আমরা চাই আমাদের শখ ও চাহিদা যেভাবেই হোক পূরণ হোক। এতে বাবা একটা কিডনি বেঁচলেন কি না, মা নিজের পছন্দের গহনা বেঁচলেন কি না অত ভাবার কি সময় আছে? এভাবে প্রতিনিয়ত বাবা - মা কে মানসিকভাবে খুন করছি আমরা। অজ্ঞাতসারে। তাঁরা বলেন না কখনো কিছু আমাদের । কিন্তু তাঁরা নিজেরা দূরে গিয়ে ঠিকই চোখের জলটা ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আল্লাহর কাছে আপনার শখ যে পূরণ করতে পারলেন না তার জন্য আফসোস করেন। কান্নাও করেন। কিন্তু আপনি আমি তা দেখি না। পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে। কিন্তু খারাপ বাবা একটাও নেই। যারা খারাপ করে তারা কার জন্য করে? নিজের একার জন্য তো এত কিছুর প্রয়োজন নেই। তারা করে শুধুমাত্র আপনার, আমার জন্য। এই যে কিছু হলেই দুর্নীতি দুর্নীতি বলে চেঁচান, চোরকে ঘৃণা করেন, টাকা পাচারে সরব হন আচ্ছা এসব এই লোকগুলো কাদের জন্য করে? সন্তানদের জন্য তাই না? আপনাদের সেই দামী

মোবাইল, ল্যাপটপ, ড্রেস, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি না হলে তো আবার সোসাইটি থাকে না। তো বাবা এগুলো কোথায় পাবে? টাকার গাছের কি ব্যবস্থা আছে? নেই। তাকে তো আপনার বা আমার জন্যই অনিয়মের পথটা বেছে নিতে হচ্ছে। আর যাঁরা নিচ্ছেন না তাদের সন্তানদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে সবসময়। এভাবেই আমরা বাবা-মাকে মানসিকভাবে খুন করছি।

এবার আসি সামর্থ্যবান বাবা-মায়ের দিকে। ঐশী বড়লোক ঘরের মেয়ে। কোনো কিছুর অভাব ছিল না। অভাব ছিল মূল্যবোধের, অভাব ছিল নীতি-নৈতিকতার। ঐশীর এমন হওয়ার পেছনে আদালত দুটি কারণ দেখিয়েছে —
১. মাদকাসক্তি
২. বয়ঃসন্ধিকালে সঠিক পরিচর্যার অভাব।
অবশ্যই স্বীকার করছি বাবা-মায়ের গাফিলতিতে অনেকসময় সন্তান বিপথে যায়। ঐশীর বাবা-মা দুজনই সন্তানকে সময় দিতে পারতেন না। এটা একটা বড় সমস্যা আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে। এক্ষেত্রে বাবা-মাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে তাদের ছেলেমেয়েদের দিকে।

আরেকটি দিক মাদকাসক্তি। আদালত সূত্রমতে,ঐশী এমন ঘটনা ঘটানোর সময় মানসিক বিকারগস্ত ছিল। তা না হলে এমন ঘটনা ঘটত না কখনোই। মাদকাসক্তি, খারাপ বন্ধু -বান্ধবদের সঙ্গ আজ কি দিল ঐশীকে? দেশের এমন কেউ কি বাকি আছেন এই কাজটির জন্য ঐশীকে ঘৃণা করেন না?

আর আখেরাত! সে তো বরবাদ। যারা মৃত্যুর পরের জীবনকে বিশ্বাস করেন না তাদের ব্যাপার ভিন্ন। কিন্তু যারা বিশ্বাস করেন তারা ভেবে দেখেন আল্লাহ যদি এই মেয়েটাকে ক্ষমা না করেন এর পরিণতি কুরআন হাদীসের ভাষ্যমতে কি হবে? নবী (স.) এর আমলে যুদ্ধের ময়দানে যাওয়া সেসব সাহাবিদের জন্য নিষেধ ছিল যাদের ঘরে বৃদ্ধ মা- বাবা আছেন। হযরত মুহাম্মদ (স.) এর নিষেধ ছিল বাবা- মা যদি কাফেরও হয় তবুও তুমি তাদের প্রতি উচ্চবাচ্য করবে না। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বারংবার বাবা-মার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। মায়ের পায়ের তলে সন্তানের বেহেশত সবাই জানি। মা যদি সন্তানের ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে উহ্ শব্দটিও করেন তাহলে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে। আল্লাহ ও ফেরেশতাদের লানত থাকে তাদের ওপর যার ওপর বাবা মা অসন্তুষ্ট হয়। পৃথিবীর সব মঙ্গল এক জায়গায় করা হলেও বাবা মার আপনার প্রতি যে দোয়া তার সমান হবে না। সব জানি আমরা অনেকেই। তবুও আমরা মানি ক জন?

আমাদের অনেকের মা বাবা ই বাইরে কাজ করেন। বাবা মা সময় দেন না। এজন্য খারাপ হই। এই কথাটি দয়া করে আর বলবেন না। কার জন্য এমন গাধার মত খাটেন? একটু প্রশ্ন করতে শিখুন নিজেকে। আপনার জন্য ই তো! তাই তাঁদের প্রতি সহনশীল হোন। তাঁদের কষ্টটাকেও নিজের করতে শিখুন। একটু ধর্মের দিকে মনোযোগী হন। ধর্মে বলা আছে বাবা মার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা। আমি নিজের দুয়েকটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ক্লাস সিক্স বা সেভেন পর্যন্ত ছিলাম প্রচন্ড জেদি আর একরোখা। মা যদি বলত আমাকে ডানে যেতে আমি যেতাম বামে। অর্থাৎ আমার পণ ই ছিল মা র কথা শুনব না। যত বড় ক্লাসে উঠলাম তত ইসলাম শিক্ষা বইয়ে বাবা-মার প্রতি ব্যবহার কেমন হবে তার লেখাও বাড়তে থাকল। আমাদের ঘরে হাদীসের বইও ছিল অনেক। সেগুলো পড়ে বুঝতে শিখেছি আম্মুকে কষ্ট দেয়া যাবে না। ইন্টারমেডিয়েটে ইসলাম শিক্ষা ছিল। জনাব মোস্তফা ইসলাহী স্যার খুব সুন্দর করে নোট করে এনেছিলেন বাবা-মা র প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা। তখন বাবা- মার প্রতি খেয়াল করা, তাদের ভালো লাগা মন্দ লাগার অংশীদার ভাবাও বেড়ে গেল। বুঝলাম বাবা মা কষ্ট পেলে তো আল্লাহ ও আমাকে ছাড়বেন না। এভাবে নিজেকে বাবা মা র প্রতি দুর্বল করে ফেলি। আল্লাহর রহমতে ওনারা আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। হয়ত মাঝেমধ্যে ভুল করে ফেললেও বড় ধরনের কোনো ভুল করি না।

‘আগষ্ট ১৪’ বাংলা ওয়েব সিরিজ দেখার পর আঁতকে উঠেছিলাম। প্রত্যেকের জীবনের একটা সময় থাকে বাবা মা কে সহ্য না হওয়ার। আমার মতে তার প্রধান সময়টাই বয়ঃসন্ধিকাল। তখন মন অনেক ভুল কিছু করতে চায়। কিন্তু বাবা মা তো সন্তানকে বিপথে দেখতে চান না তাই বাধা দেন। আর তখনই হয় সংঘর্ষ।

তাই কয়েকটি বিষয় সুপারিশ করতে চাই, বাবা-মায়েরা যেন সন্তানের দিকে নজর রাখেন। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিতে। এসময় খারাপের প্রতি ঝোঁকটা থাকে মারাত্মক। একবার খারাপ হলে ফেরানো মুশকিল। কাদের সাথে মিশছে তাদের চলাফেরা, সময় কাটানো ইত্যাদি নজর রাখা। সবচেয়ে ভালো হয় সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করে সন্তান যাদের সাথে মিশছে তাদের বাসায় মাঝেমধ্যে আনা এবং সেসব বন্ধুদের ধরন বোঝা।

সন্তানকে একা রুমে না রাখা। আর রাখলেও সে নিজ ঘরে কি করছে তা চেক করা। বিশ্বাস করবেন তবে অন্ধ বিশ্বাস নয়। আরেকটি কথা, তাকে সন্দেহ করেন বা চোখে চোখে রাখেন সেটা বুঝতে দেয়া যাবে না। ভালো সামাজিক শিক্ষামূলক ছবি, নাটক, কার্টুন দেখতে উৎসাহিত করা।

সন্তানকে মন খুলে কথা বলতে দিন। যা বলতে চায় শুনুন। কেনো অপরাধ সে যদি নিজে স্বীকার করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা থেকে বিরত থাকুন। তাহলে পরবর্তীতে কোনো কথা সে ভয়ে শেয়ার করবে না। আর সবার আগে ধর্মীয় মনোভাবে গড়ে তুলুন। ইসলাম জীবন গঠনমুলক ধর্ম। সন্তানকে তাই শেখান। মানতে সাহায্য করুন।

ঐশী একটাই এসেছিল। আমরা আর কোনো ঐশী চাই না। তাই আমরা সন্তানরা বাবা মায়ের কষ্ট উপলব্ধি করার চেষ্টা করব সর্বদা। একটা কথা মনে রাখব, তাঁরা নিজের জন্য কিছু ই করেন না। সামর্থ্যের মধ্যে আমাদের সবটাই দেন। আসুন বাবা-মা কে ভালোবাসি। তাহলে দুনিয়া এবং আখিরাত দুটাই সুন্দর ও স্বার্থক হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিন
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ