র‌্যাঙ্কিং মানে না ঢাবি, কারণ তাদের শেখানো হয়— আমরাই সেরা!

আমিনুল ইসলাম
আমিনুল ইসলাম  © ফাইল ফটো

সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিত্তিক সেন্টার ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিংয়ের বিশ্বসেরা দুই হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ১ হাজার ৭৯৪তম হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয় এই র‌্যাঙ্কিংয়ে স্থান পায়নি। পাশের দেশ ভারতের ৬৪টি এবং পাকিস্তানের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় এ তালিকায় স্থান পেয়েছে। র‌্যাঙ্কিং নিয়ে না হয় পরে কথা বলা যাবে।

জানতে পেরেছি, নিউজিল্যান্ড নাকি সম্পূর্ণ ভাবে করোনা মুক্ত দেশ হিসেবে নিজদের ঘোষণা দিয়েছে। দেশটিতে গত ১১ দিনে কোন করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি। এই নিয়ে এখন আমরা বাংলাদেশিরা অনেক আক্ষেপ করছি। আমার পরিচিত অনেকেই লিখেছে- আহা, আমাদের যদি জেসিন্ডার মতো একজন নেতা থাকতো ইত্যাদি!

মেনে নিচ্ছি জেসিন্ডার মতো একজন নেতা আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের কোন নেতা যদি জেসিন্ডার মতো হতো, আপনারা কি সেটা মেনে নিতেন? জেসিন্ডা তো বিয়ে না করেই তার পার্টনারের সাথে থাকছিল। তাদের বাচ্চাও হয়েছে। এমন নেতা হলে আপনারা কি মেনে নিতেন?

জেসিন্ডা তো তার পুরো জীবনে সমকামীদের আধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে আন্দোলন করেছে। এমন নেতা হলে আপনারা মেনে নিতেন? তখন অবশ্য আপনারা ওই নেতা কতোটা ভালো নেতৃত্ব দিচ্ছে এই নিয়ে কোন আলাপ-আলোচনাই করতেন না। আপনারা তখন ব্যস্ত থাকতেন তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে।

ভালো নেতৃত্ব কি আকাশ থেকে উড়ে আসবে? আমরা সবাই তো একটা সমাজ ব্যবস্থার প্রোডাক্ট। সমাজ ব্যবস্থা যেমন, প্রোডাক্টও তো তেমনই হবে। একটা উদাহরণ দেই। গত পরশুই একটা সাময়িক ভাবনা লিখেছিলাম। আমি যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই; আর আমার এখানে যেহেতু করোনা ভাইরাসের সময়ও অনলাইনে ক্লাস নিতে হয়েছে।তাই ব্যস্তই ছিলাম এতো দিন। তো, দুই মাসের জন্য সামার ভ্যাকেশন শুরু হয়েছে এই সপ্তাহ থেকে। এই নিয়ে একটা পোস্ট করে লিখেছিলাম- ভাবছি কি কি করা যায় এই দুই মাসে। অন্যান্য বছর তো ঘুরে বেড়াতাম। এইবার তো সেই সুযোগ নেই। তাই ভাবছি একটা উপন্যাস লিখে ফেলার চেষ্টা করা যেতে পারে কিংবা নতুন কোন বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখা যেতে পারে। এরপর লিখেছি- আপনাদের কি মনে হয়, কি করা যেতে পারে?

ওই স্ট্যাটাসের কমেন্ট বক্সে অনেকেই অনেক রকম মন্তব্য করেছে। এর মাঝে কয়েকজন লিখেছে- কোরান শরিফের বিশ্লেষণ শিখতে পারেন। হাদিস-কোরানের বিশ্লেষক হয়ে যেতে পারেন ইত্যাদি।

আমি ঠিক ওই মুহূর্তে নামাজ পড়ছিলাম। নামাজ পড়ে এসে এই মন্তব্য গুলো দেখে স্রেফ লিখলাম- সবাইকে কেন হাদিস-কোরান বিশ্লেষক হতে হবে? আমার এই বিষয়ে আগ্রহ নেই। যাদের আছে, তারা না হয় হোক। এরপর যিনি মন্তব্য করেছেন, তিনি এসে আমাকে লিখেছেন- আপনাকে ভালো ভেবেছিলাম। আপনি দেখছি নাস্তিকদের মতো কথা বলছেন। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা! অথচ দেখা যাবে, যেই লোক এই মন্তব্য করেছে, সে হয়ত ঠিক মতো নামাজটাও পড়ে না! আমি অন্তত প্রতিদিন পাঁচবার নামাজ পড়ার চেষ্টা করি।

তিনি যে হাদিস-কোরান পর্যালোচনা করতে আমাকে বলেছেন; সেটা আসলে ঠিক আছে। তিনি তার মতামত জানাতেই পারেন। কিন্তু আপনার মতামতের সাথে কারো না মিললেই তাকে যা ইচ্ছে তাই ভাবতে শুরু করে দিবেন কেন? এটা কোন ধরনের মানসিকতা!

আমি স্রেফ লিখলাম- আমার এই বিষয়ে আগ্রহ নেই। যাদের আগ্রহ আছে তারা করুক না, সমস্যা তো নেই। অথচ ওই ভদ্রলোক আমাকে এমন একটা মন্তব্য করে বসেছেন- যেটা হয়ত আমার ধারণা ধর্মের সাথেও যায় না! না জেনে তো আপনি কাউকে এমন মন্তব্য করে বসতে পারেন না। অথচ তিনি মনের আনন্দে করে বসলেন! আমি অবশ্য এদেরও দোষ দেই না। আমাদের পুরো শিক্ষা এবং সমাজ ব্যবস্থাটাই আসলে এমন। কারণি আমাদের যারা শিক্ষা দেয়; সেই দেশ সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও আমাদের এইসবই শেখায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন পৃথিবী সেরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর তালিকায় আসতে পারছে না, এই নিয়ে বছর পাঁচেক আগে পত্রিকায় একটা লেখা লিখেছিলাম। তো এর উত্তরে তৎকালীন উপাচার্য লিখেছিলেন- আমরা এইসব তালিকা মানি না! কি অবাক কাণ্ড! হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড এই সব র‌্যাঙ্কিং শুধু মানেই না, এমনকি ওদের ওয়েবসাইটে পর্যন্ত দিয়ে রেখেছে। আর আমাদের দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয় বলছে- আমরা এইসব মানি না!

তো, উনারা কি শিক্ষা দিচ্ছে?

উনারা শেখাচ্ছে আমরাই সেরা! উনারা কারো মতামত নেয়ার মতো অবস্থাতেই নেই! অর্থাৎ উনারা যা বলেন-সেটাই হচ্ছে শেষ কথা! এর উপর আবার কার এতো বড় সাহস কথা বলার! আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমালোচনা করে দেখুন; আপনাকে কতো রকম সমালোচনা শুনতে হবে; তার কোন ঠিক নেই!

অর্থাৎ এই জনপদে মতামত প্রকাশ করাটাই হচ্ছে অপরাধ! সেটা আপনি সরকারের বিরুদ্ধে করুন কিংবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অথবা ইউনিভার্সিটিগুলোর সম্পর্কে লিখুন! কারো সম্পর্কেই কিছু বলা যাবে না। এই যখন আমাদের হাল, তখন আমরা ভালো নেতা পাব কি করে?

দেখুন আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হতে পারে; কিন্তু সামাজিক ভাবে যদি আপনি পিছিয়ে থাকেন; তাহলে সেই অর্থনীতিও বেশি দিন টিকবে না। অবশ্য সামাজিক ব্যবস্থা আবার কি! আমাকে তো একবার বুয়েট থেকে পাশ করা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রশ্ন করেছিল- আপনি সমাজ বিজ্ঞান পড়েছেন কেন? এইসব কেউ পড়ে? যেই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মন-মানসিকতা এই রকম; সেখানে পুরো সমাজের সাধারণ মানুষগুলোর মানসিকতা কেমন হবে সেটা বুঝাই যায়। সমাজ এবং সমাজের মানুষগুলো যদি না পাল্টায়; তাহলে কোনভাবেই একটা দেশ এগুবে না। যদি একটু আগায়ও; সেটা টেকসই হবে না।

একবার চিন্তা করে দেখুন- করোনা ভাইরাসের সময় যেখানে সৌদি আরবের মতো দেশ তাদের মসজিদ থেকে শুরু করে সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছে খুব দ্রুত সময়ে। সেখানে বাংলাদেশে মসজিদ বন্ধ করতে অনেক সময় লেগেছে। এমনকি মসজিদ বন্ধ করার ঘোষণা দেয়ার পর অনেকে আবার রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে। আমি এদের কাউকে দোষ দিচ্ছি না। কারন এরা তো এই সমাজ এবং শিক্ষা ব্যবস্থারই ফসল। এরা এভাবেই চিন্তা করতে শিখেছে। এরা এভাবেই সব কিছুকে ধারণ করতে শিখেছে। তাই এরা কখনোই নিজদের মতের বাইরে কোন কিছু নিতে পারে না।

আমরা এদেরকে সঠিক শিক্ষাটা দিতে পারিনি। যাদের দেবার কথা ছিল; দেশ সেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য বড় প্রতিষ্ঠানগুলো; যারা হয়ত পুরো দেশের সকল শিক্ষক এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে একটা পথ দেখাতে পারত; যারা নিজেরা মনে করে- তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে, প্রগতির চর্চা করে; তারা নিজেরাই আসলে ভিন্ন মত নিতে পারে না। কারণ এদেরকে প্রথমেই শেখানো হয়- আমরাই সেরা!

এবার দশ টাকায় চপ, সিঙ্গারা পেয়ে সেরা নাকি অন্য কারনে সেরা; এটা অবশ্য জানার চেষ্টা করলেও দোষ! বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা যদি এমনই থেকে যাই; তাহলে আসলে আমরা পৃথিবীর সকল দেশগুলো থেকে আস্তে আস্তে পেছনে পড়ে যাবো। করোনা ভাইরাসে কথাই চিন্তা করুন। কতো দিন লেগেছে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে?

দুই মাসের মাথায় এটি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। পৃথিবী এখন এতোটাই গ্লোবাল। আপনি উত্তর মেরু একটা বরফে ঢাকা স্থান থেকে দক্ষিণ মেরুর আমাজান জঙ্গলে কি হচ্ছে জেনে যাবেন।

এই যখন অবস্থা- তখন যদি স্রেফ আপনার নিজের মতকেই সেরা ভেবে বসে থাকেন আর অন্য কারো কোন কিছুই আপনি শুনবেন না; গ্রহণ করবেন না; এই অবস্থায় থাকেন; তাহলে আপনি কেবল'ই পেছাবেন। আপনি থাকুন আপনার মতামত নিয়ে। কোন আপত্তি নেই। কিন্তু অন্য আরেক জনের মতামত পছন্দ না হলে- তাকে যা ইচ্ছে তাই ভাবতে হবে কেন? এভাবে আর কয়দিন?

আজই পত্রিকায় পড়লাম- জাপান সরকার বাংলাদেশ থেকে সব রকম ফ্লাইট বাতিল করেছে। কোন বাংলাদেশিকে তারা ঢুকতে দিবে না। কারণ কি জানেন? চার বাংলাদেশি ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট নিয়ে জাপানে চলে গিয়েছে! এদের সবার করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে জাপানে। একই অবস্থা দক্ষিণ কোরিয়াতেও।

আজই জানতে পেরেছি আমাদের উত্তর ইউরোপের দেশ গুলো বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের আপাতত ভর্তি করাবে না বলে সিদ্ধান দিতে যাচ্ছে। কারন কিন্তু ওই একই! খুব বেশি করোনা রোগী সেখানে! অথচ অল্প কিছুদিন আগেও ইউরোপের অবস্থা কতোটা খারাপ ছিল। এখন এখানে সব কিছু খুলে যাচ্ছে। আমার এখানে তো সব কিছুই এখন খোলা। আমরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

আর বাংলাদেশে? নতুন নতুন করে লকডাউন তত্ত্ব আসছে! তিন মাস আগে যখন বলেছিলাম— কারফিউ দিন, কেউ শুনেনি। এখনও চলছে এমন করেই! এভাবে চলতে থাকলে কতো লম্বা সময়ের জন্য আমরা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবো- সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানে না।

যেই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থা আপনারা সবাই মিলে গড়ে ছিলেন- সেটা যদি না বদলান; তাহলে যতই ডিজিটাল হন, যতই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসুক; সেটা টেকসই হবে না। কারণ মানুষগুলো যে ঘুণে ধরা! এরা সবাই মিলে- সেটাকে আবার টেনে নিচে নামাবে।

হাজার রকম শিক্ষাব্যবস্থা; সেখানেও নানান সব ঘাপলা! আমারা মনে করি- সবাই আমরা সেরা! অথচ পৃথিবীর কোথাও আমাদের নাম-গন্ধও খুঁজে পাওয়া যায় না!

আগে মানব সম্পদের উন্নয়ন করুন। এরপর এরাই পুরো দেশটাকে উন্নত বানিয়ে দেবে।

লেখক: আমিনুল ইসলাম, বর্তমানে ইউরোপে শিক্ষকতা করছেন।


সর্বশেষ সংবাদ