মানবিকতার অন্তরালে রক্তাক্ত তিতুমীরের প্রাঙ্গণ
- মালেকা আক্তার চৌধুরী
- প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২০, ১০:৫৮ PM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৩২ PM
পেশাগত জীবনের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে প্রায় শেষপ্রান্তে উপনীত আমি নিজের অবস্থা-অবস্থান, দায়িত্ববোধ, সচেতনতা এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার দিক থেকে কোনো বিষয় যেনো সারাজীবন নিজেকে অপরাধবোধের কাঠগড়ায় না দাঁড় করায় সেই অন্তর্দহনের জায়গাটি থেকেই আজকের লিখাটি শুরু করছি।
"Hats of to the front fighters" স্যালুট! বিশ্বজুড়ে অগনিত কোভিড যোদ্ধাদের প্রতি। সময়ের নিরিখে এখনও বেঁচে থাকা এবং অদৃশ্য কোভিডের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া পৃথিবীর সব মানুষই আজ জীবনযোদ্ধা। পেন্ডেমিক দুনিয়ার অসহায়ত্ব বড়ো নির্মমভাবে, বড়ো নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। মানুষ আতঙ্কে উৎকন্ঠায় মানসিক শক্তি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছে মূহুর্তে মূহুর্তে। সর্বস্তরের মানুষ যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী আপন পর ভেদাভেদ না করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে একে অপরের পাশে থাকছেন, সাহস যোগাচ্ছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরলস প্রচেষ্টায় আমরা এখনও ঐক্যবদ্ধ থেকে তাঁর সফল ও দক্ষ নেতৃত্বে আর্থ-সামাজিক পটভূমি থেকে শুরু করে কৃষি, শিক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্যসহ জীবন যাপনের প্রতিটি পর্যায়ে সুসমন্বিত ধারা অব্যাহত রাখতে পেরেছি। অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা সত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোভিড-১৯ এর মতো মহামারীকে সামাল দিচ্ছেন উর্বর মস্তিস্কের সৃষ্টিশীল মেধার নিরঙ্কুশ বিকাশ ঘটিয়ে।
এরই ধারাবাহিকতায় সরকারি তিতুমীর কলেজ ক্যাম্পাসকেও করোনা নমুনা সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ০৬.০৪.২০২০ তারিখে জেকেজি হেলথ কেয়ারকে অনুমতি প্রদান করেছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের সম্মানিত অধ্যক্ষ মহোদয় প্রফেসর মো. আশরাফ হোসেন। বেসরকারি প্রকল্প জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ এবং তাঁর স্বামী প্রতিষ্ঠানটির সিইও জনাব আরিফ উদ্দিন।
আমরা তিতুমীর পরিবার এমন মহৎ একটি সেবাধর্মী কাজের সাথে নিজেদের যুক্ত করতে পেরে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছিলাম এটা ভেবে যে, রাষ্ট্রকে পরোক্ষভাবে হলেও সহযোগিতা করার একটা সুযোগ ঘটেছে। দীর্ঘ দুমাস যাবৎ তারা ক্যাম্পাসে অবস্থানকালে প্রয়োজনীয় নানান আনুষঙ্গিক কার্যাদি মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয় তাদের সম্মান এবং সুবিধার্থে লকডাউনের নিষেধাজ্ঞার ভেতরেই সম্পন্ন করে দিয়েছেন।
এক পরিবারে অবস্থান করতে গেলেও মতের অমিল হয়, মনোমালিন্য হয়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্ত বিষয়টা হলো, কারো ওপর আপনার ক্ষোভ থাকতেই পারে কোনো কারণে ক্ষুদ্ধ হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই বলে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় আকস্মিক নারকীয় হামলা-নৃশংসতা কেনো?
পৃথিবীর যেকোনো মহামারী বিপর্যয়ে মানবিক মন স্বভাবতই দুর্বল হয়। কোভিডের ক্ষেত্রেও তাই। মানব ইতিহাসে সম্পূর্ণ নতুন এই করোনাভাইরাসের আতঙ্ক যেমন সর্বগ্রাসী তেমনি সর্বজনবিদিত। প্রতিদিন নিত্য নতুন মৃত্যু, প্রিয়জনের আকস্মিক বিয়োগে মানুষ পাগলপ্রায়। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা এই মূহুর্তে সবচেয়ে আপনজন, উদ্ধারকর্তা। কিন্ত তাই বলে বিষয়টা ন্যায় অন্যায় বহির্ভূত নয়। স্পর্শকাতর এই বিষয়টিকে নিয়ে কেউ যদি পরিস্থিতি ঘোলা করেন, জন সমর্থন সহানুভূতি আদায় করতে চান তাহলে এর মহত্ব যেমন নষ্ট হয় তেমনি প্রকৃত সত্যও আড়ালে থেকে যায়।
সরকারি তিতুমীর কলেজ ঢাকা শহরের ঐতিহ্যবাহী পুরনো একটি কলেজ। এর ইতিহাস ঐতিহ্য, গৌরব ও সম্মান রয়েছে। প্রায় অর্ধলক্ষ শিক্ষার্থী অধ্যুষিত তিতুমীর কলেজ পরিবারের রয়েছে অগণিত কৃতি সন্তান, যাঁরা দেশবরেণ্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব; আছেন সুশীল সমাজের সম্মানিত নাগরিকবৃন্দ। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই হতভম্ব-স্তম্ভিত।
তিতুমীরের বর্ষীয়ান কর্মচারী আমাদের সাত্তার ভাই আজ কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘আপা আমরা পরাজিত হয়ে গেছি, পরাজিত হয়ে গেছি’। নৃশংসতার হাত থেকে তিনিও রেহাই পাননি। তিতুমীরের সাবেক বর্তমান, কর্মকর্তা-কর্মচারী, শত শত শিক্ষার্থী মিলে তিতুমীর এক যৌথ পরিবার। অথচ এই পরিবারের কিছু দুর্বল কর্মচারীর ওপর ‘জেকেজির তথাকথিত স্বাস্থ্যকর্মীসহ তাদের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ এমন নোংরা, অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ কটুক্তি করেছেন যা পুরো তিতুমীর পরিবারের জন্য মর্যাদা হানিকর, নিন্দনীয়ও বটে।
ঘটনার পেছনের ঘটনা বলতে গেলে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে হয়। প্রিয় পাঠক, ধৈর্য ধরে একটু সঙ্গেই থাকুন। গত ১ জুন ২০২০ সোমবার দিবাগত রাতে একজন নারী স্বাস্থ্যকর্মী তার নিজের ভবন থেকে মাঠ পাড়ি দিয়ে তিতুমীরের কলাভবনের দিকে রাত ১:০০ টার পর অশালীন পোশাকে একজন পুরুষ সহকর্মীর কাছে যাচ্ছিলেন। পথে নৈশ প্রহরীর বাদানুবাদ উপেক্ষা করেই সে যখন ওই ভবন পর্যন্ত চলে আসে তখন পুরুষ সহকর্মীটি নেমে এসে মেয়েটিকে ওপরে নিয়ে যান। এক পর্যায়ে রাত তিনটা বেজে গেলেও যখন তারা নীচে নেমে আসছিলেন না তখন কর্তব্যরত নৈশপ্রহরী ভেতরে অবস্থানরত তিতুমীরের কর্মচারীদের সাহায্যে অনন্যোপায় হয়ে পুলিশে খবর দেয়।
পরে বনানী থানার পুলিশের সহযোগিতায় সে রাতেই বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘটে। তিতুমীরের কর্মচারীরা আমাদের অধ্যক্ষ মহোদয়কে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি ‘জেকেজি হেলথ কেয়ারের দুজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সারাদিনে আর কোনো ধরণের উচ্চবাচ্য না হওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিলো বলেই ভেতরে অবস্থানরত কর্মচারীরা জানিয়েছেন।
জানা যায়, কথিত স্বাস্থ্যকর্মীরা নানান ছলছুতোয় বিবাদে জড়ান রাতের প্রথম প্রহরেই। এক পর্যায়ে নিজেরাই থানায় ফোন করে পুলিশ সদস্যদের ডেকে নিয়ে আসেন। পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতেও দুপক্ষের মারমুখো অবস্থা অবশেষে সংঘর্ষে রুপ নেয়।
২য় ধাপে রাত আনুমানিক ১১:০০ টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত চলে নৃশংসতম হৃদয়বিদারক ঘটনা। জানা যায়, সিইও জনাব আরিফ সস্ত্রীক ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন এবং কর্মচারীদের ভাষ্য অনুযায়ী এ সময় প্রায় দেড় দুইশত বহিরাগত সন্ত্রাসী লাঠি-সোটা, রড, চাপাতি নিয়ে কলেজের ভেতরে প্রবেশ করে। বহিরাগত সন্ত্রাসী মহিলাদের প্রধান ফটকের মুখে দাঁড় করিয়ে ফটক ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে জেকেজি হেলথ কেয়ারের দুই প্রধানের নির্দেশে নৃশংস মধ্যযুগীয় কায়দায় বহিরাগতরা গ্রুপে গ্রুপে কর্মচারীদের কোয়াটারে ঝাঁপিয়ে পড়ে অমানবিক অত্যাচার নির্যাতন, ভাংচুর চালায়।
সরেজমিন অনুসন্ধানেও সেই চিত্রের দেখা মেলে। জানের ভয়ে লুকিয়ে থাকা কর্মচারীরা তাদের পরিজনেরা বের না হলে ঘরে আগুন দেবারও হুমকি দেয়া হয়। জীবনের ভয়ে কর্মচারীরা প্রাণভিক্ষা চান আবার কেউ কেউ বাউন্ডারী প্রাচীরের ওপর কাঁটাতার ডিঙিয়ে ওপারে পড়ে রক্তাক্ত হয়ে হাত পা ভেঙ্গে ফেলেন। মডারেট মানবিক পৃথিবীর বাসিন্দাদের কী করুণ নিয়তি; তারওপর স্থানটি যখন পবিত্র একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাঙ্গন। মৃত্যু ভয়ে ভীত কর্মচারীদের কেউ কেউ লুকিয়ে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ম্যাডামসহ যাকে যেভাবে পেরেছেন ফোনে চাঁপা আর্ত কন্ঠে বাঁচান স্যার! জানে বাঁচান স্যার বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কলেজ ক্যাম্পাসে এ নৈরাজ্য ও ভয়ংকর পরিস্থিতি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাত্রিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
জানা যায়, পূর্বেই উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের তখনও অডিটোরিয়াম থেকে বের হতে দেয়া হয়নি। ততোক্ষণে ক্যাম্পাসের ভেতরের আর্তনাদে মহল্লাবাসী, রাস্তার সাধারণ মানুষ এবং মিডিয়াকর্মীরাও উপস্থিত হন। কিন্ত কোনো এক অজানা রহস্যের কারণে কাউকেই ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি।
তিতুমীর কলেজের আঁখি ছাত্রাবাসের সহকারী সুপার জনাব আল- নূর (রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ) অধ্যক্ষ মহোদয় কর্তৃক নির্দেশিত হয়েও নিজের ক্যাম্পাসে, নিজের কর্মচারীদের উদ্ধারে ভূমিকা রাখতে পারেন নাই। অথচ ‘জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফকে কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় বারবার ফোনে অনুরোধ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলেন। কিন্ত তিনি পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে বলে জনাব আল নূরের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারিতার অভিযোগ আনেন।
অভিভাবক পর্যায়ের দুজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির উপস্থিতি এমন একটি ন্যাক্কারজনক-ঘৃণ্য ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। উল্লেখ্য, জেকেজি হেলথ কেয়ারের সাথে তিতুমীর পরিবারের কোনো বিরোধ নেই। বরং তাদের সেবার ব্রতকে প্রতিপদে সম্মান জানিয়েছে তিতুমীর পরিবার এবং তিতুমীর কর্তৃপক্ষ।
এক পর্যায়ে কলেজের প্রধান ফটকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো তথাকথিত স্বাস্থ্যকর্মীসহ বহিরাগতরা রাস্তায় বেরিয়ে এসে পাল্টা বানোয়াট অভিযোগ শুরু করে দেয় যেটি মিডিয়ার কল্যাণে পুরো দেশবাসী দেখেছেন।
প্রসঙ্গত, ৭১ টিভি চ্যানেল গতকাল (০৪.০৬.২০২০) সরকারি তিতুমীর কলেজের হামলার বিষয়ে জানতে চেয়ে আমাকে সংযুক্ত করেছিলেন এজন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি প্রিয় চ্যানেল ৭১ কর্তৃপক্ষকে। একাত্তর নামের সাথেই মহান স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত একদল প্রগতিমনা আলোকিত মননের ধারক বাহককেই প্রতিকায়িত করা হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামে-আদর্শে স্বোপার্জিত মহান একাত্তর।
চলমান ঘটনার সূত্র ধরেই বলতে চাই ম্যাডাম মিথিলা ফারজানা (সংবাদ পাঠিকা) অত্যন্ত চমৎকার করে আমার কাছে তিতুমীরের হামলার বিষয়টি জানতে চেয়েছেন। কিন্ত সময় স্বল্পতার দরুণ তিনি আমার কথার ভুল ব্যাখ্যাও করেছেন যেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। সম্মানের সাথেই ম্যাডামকে জানাতে চাই, আমি ব্যক্তিগতভাবে দর্শনের শিক্ষক। তিতুমীরের শিক্ষক সম্প্রদায়ই শুধু নয় জাতিগতভাবেই শিক্ষকেরা উদার এবং বিবেচক মনের অধিকারী হয়ে থাকেন। একথা বলছি না যে, আর কোনো পেশাজীবী বা সাধারণ মানুষ উদার বিবেচক নন।
সব শ্রেণি পেশার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই কথাটি আমাকে বলতে হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে নারী স্বাধীনতায় আমিও বিশ্বাসী। সেজন্য মত বিনিময়ের যথেষ্ট সুযোগ থাকা জরুরী। যে কোনো সূক্ষ্ম বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন পড়ে, সে সুযোগটি সংযুক্ত থাকাকালে আমার বেলায় ঘটেনি। তিনি আমার ‘বিচ্যুতি’ কথাটির দ্বিরুক্তি করে তার যথাযথ অর্থ অনুধাবনে জটিলতায় জড়িয়েছেন। যেহেতু আমি একজন শিক্ষক সেহেতু ‘বিচ্যুতি’ ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকুক বা না থাকুক আমি বিশ্বস্ততার সাথেই আপনাকে জানাতে চাই আমি যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়েই ‘বিচ্যুতি’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। যেটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবী রাখে।
এখানে ভোরের কাগজের সাবেক সম্পাদক শ্যামল দত্ত দাদার কথাগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ‘সৌজন্যতা, সহজ সমাধান, টিন এজের ভুল’ বিষয়গুলি উল্লেখ করেছেন। শ্যামল দাদার মতের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আমিও পুরো বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত দাবী করছি।
তারপরও কিছু বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়-
জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী বরাবরই পানি, বিদ্যুতের সমস্যাগুলি সামনে নিয়ে এসেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, তথাকথিত স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্মানাধীন যে দুটো ভবনে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো সে দুটি ভবনের একটি একাডেমিক কাম এক্সামিনেশন ভবন আর অন্য ভবনটি বিজ্ঞান ভবন হিসেবে পাঠদানের সাথে সম্পৃক্ত। কোনো আবাসিক ভবনের কাঠামোয় তৈরি নয় ভবন দুটি। তদুপরি পূর্বেই বলেছি দুটি ভবনই নির্মানাধীন। যেজন্য পানির যে ব্যবস্থা ছিলো সেটি তাদের প্রায় দু’শ স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য পর্যাপ্ত না হলেও সাময়িক সমাধান দেওয়া হয়েছে প্রতিবারই।
দুমাসে বেড়েছে বিদ্যুৎ বিলও, প্রায় দুলক্ষ টাকা বিদ্যুৎ বিল এসেছে। তবুও রাষ্ট্রীয় মানবিক কাজ বিবেচনায় অধ্যক্ষ মহোদয় সে দায়িত্বও কলেজের পক্ষ থেকে গ্রহণ করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে।
সরেজমিনে দেখা যায় ‘ইথার সাউন্ড’ থেকে ভাড়ায় নিয়ে আসা ৬০ (ষাট) টি এল ই ডি টিভি এবং ১৬ টি উচ্চক্ষ মতাসম্পন্ন স্পিকার স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যবহার করেছেন। যে বক্সগুলোর একটি অংশ তিনটি পিকআপ ভ্যানে করে গতকাল (০৪.০.৬.২০২০) দোকানে ফিরিয়ে নিয়েছে। পুরো রমজান মাস জুড়েই তারা এসব ব্যবহার করে মহল্লাবাসীকে যেমন বিরক্ত করেছেন তেমনি ব্যাঘাত ঘটেছে তারাবীহ নামাজেও।
জানা যায়, জনৈক স্বাস্থ্যকর্মী গভীর রাতে ক্যাম্পাস থেকে ড্রাইভিং শিখতে বেরুলে মহাখালীতে গাউছুল আযম মসজিদের সামনে আকস্মিক দূর্ঘটনায় পতিত হলে এলাকাবাসীর রুদ্র রোষেও পড়েছিলেন বলে কথিত রয়েছে।
লকডাউন সীমিতকরণের প্রেক্ষিতে সকলেই জীবিকার সন্ধানে নেমেছেন। তিতুমীরের নির্মানাধীন ভবনের কাজ শুরু করার জন্য অধ্যক্ষ মহোদয়ের ওপর ঠিকাদারের অনবরত চাপ থাকলেও তিনি মহামারী এবং কোভিড যোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে নির্মান কাজও বন্ধ করে রেখেছেন। অথচ সেই সহজ সরল মানুষটিকে কী নির্মমতার চিত্রই না আজ দেখতে হচ্ছে। তাঁর নিরীহ কর্মচারীরা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।
লকডাউনের সুযোগে কলেজের প্রধান ফটকের চাবিটিও তাদের কব্জায়। নিজেদের কলেজে অবাধে বিচরণ প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। মূল গেইটে পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করতে হয় নিজের প্রিয় কর্মস্থলে। দূর্ঘটনার দিন সকালে অধ্যক্ষ মহোদয়ের ডাকে কলেজে আসার পথে গেইটে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে দেড় ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকেন বর্ষীয়ান প্রফেসর মো. ময়েজ উদ্দিন (বিভাগীয় প্রধান, মার্কেটিং বিভাগ)। গত ০৩.০৬ তারিখে ‘মূল গেইটের চাবি’ চেয়েও চাবি ফেরত পাননি অধ্যক্ষ মহোদয় নিজে। নিজ ঘরে পরবাসী তিতুমীর পরিবার। কোথায় জানাব এ দুঃখ! অধ্যক্ষ স্যারের ব্যবহৃত গাড়ি এবং উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মোসা. আবেদা সুলতানার গাড়িও ভেতর থেকে বের করতে ঘাটে-ঘাটে কৈফিয়ত দিতে হয়েছে।
তিতুমীর কলেজের সাংবাদিক সংগঠন একটি শক্তিশালী সংগঠন। খবরে প্রকাশ এসব স্বাস্থ্যকর্মীরা আমাদের সাংবাদিক সমিতির সদস্যদের সাথেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। এ বিষয়ে সাংবাদিক সমিতি সমন্বিতভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়াও কথিত স্বাস্থ্যকর্মীদের নানাবিধ অসামাজিক- অসৌজন্যমূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার বিষয়টিও সকলের মুখে মুখে।
সম্মুখ যোদ্ধাদের আমরা বিনয়াবনত চিত্তে স্মরণ করি, শ্রদ্ধা করি। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা অন্যের জীবন রক্ষা করে চলেছেন জাতি তাদের কৃতজ্ঞ চিত্তে আজীবন স্মরণ করবে। প্রকৃত যোদ্ধার আদলে কৃত্রিমতার মোড়কে যারা মানুষের সহানুভূতি সহমর্মীতা অর্জন করতে নিত্য নিয়ত নানারুপ পরিগ্রহ করে চলেছেন পৃথিবী কোন দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের বিচার করবে?
এ পর্যায়ে মূল্যবোধের বিষয়টিও বড়ো প্রাসঙ্গিক। এটি কখনই বিভাজিত নয়। প্রকৃত মানুষ মূল্যবোধের চর্চা যেমন করেন তেমনি বিদ্যমান সমাজের প্রতিটি শিক্ষক মূল্যবোধের চাষও করে থাকেন। ঐতিহ্যবাহী তিতুমীর কলেজ মানুষ গড়ার কারিগরী প্রতিষ্ঠান। কর্মচারী, এম এল এস এসসহ পিয়ন পর্যন্ত যারাই আমাদের সহযোগী হয়ে কাজ করেন তাদের মধ্যে উচ্চমাত্রার মূল্যবোধ না থাকলেও সাধারণ বিবেচনাবোধটি জেগে থাকে অহর্নিশ। সেক্ষেত্রে এসব শ্রেণির কর্মচারীরা এমন নোংরা অনৈতিক কাজে জড়াতে পারেন না। তাদের সামাজিক অবস্থান, বয়স, মাত্রাজ্ঞান প্রেক্ষিত এসবও যখন বিচার্য বিষয়।
দেশে বিদেশে অবস্থান উৎকন্ঠিত তিতুমিরিয়ানদের প্রশ্নবানের মুখে আমরা নিরুত্তর, বিস্মিত। তবে ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ বনানী জোনের ডিসি জনাব সুদীপ চক্রবর্তী এবং বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ জনাব নূরে আজম এসি সহকারে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে জিডি করার পরামর্শ প্রদান করেছেন। তাছাড়া আমাদের অধ্যক্ষ মহোদয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মাউশির ডিজি মহোদয় এবং সচিব মহোদয়ের মাধ্যমে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং উপমন্ত্রী মাননীয় মহিবুল হাসান চৌধুরীকেও পুরো বিষয়টা অবহিত করেছেন। তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি মো. রিপন মিয়া সার্বক্ষণিক সাথে থেকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন সাধারণ সম্পাদক জুয়েল মোড়লও নানাভাবে পাশে থেকে পুরো কার্যক্রমে সহযোগিতা করেছেন।
তিতুমীর কলেজের নৈসর্গিক সবুজের ঘাস, লতা পাতা, ফুল পাখি, ধূলিকণার সাথে তিতুমীরের বৃহত্তর পরিবারের রয়েছে গভীর আত্মিক এক সম্পর্ক। তাই কোনো বিবাদ নয়, বিচার নয়, ক্ষতিপূরণ নয়, প্রতিশোধেও নয়। তিতুমীর পরিবারের একাংশের ওপর যে নৃশংসতা, কালিমা লেপন করা হয়েছে সেই কালিমা মোচনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। আহত কর্মচারীদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে প্রিয় ক্যাম্পাসের সবুজ আঙিনাখানি।
লেখক: দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ও শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, সরকারি তিতুমীর কলেজ