করোনায় ছুটছে হ্যাকারদের জয়রথ

  © টিডিসি ফটো

হঠাৎ করে অন্যের মেশিনে একটু উঁকি দিয়ে আসা, অন্যের গোপন নথিপত্র চুপচাপ পড়ে নেয়া বা অন্যের ডিভাইস হ্যাক করে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেয়া। এভাবেই হ্যাকাররা জায়গা করে নিয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে। করোনাকালে হ্যাকারদের দৌরাত্ম যেন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

পৃথিবীর এমন কোন দেশ বা সংস্থা নেই যারা হ্যাকারদের সাইবার হামলার স্বীকার হয়নি। একের পর একদেশের সার্ভার হ্যাক করে গবেষণা তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠছে প্রতিপক্ষ দেশের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই হ্যাকিংয়ের ইতিহাসও অনেক লম্বা।

১৯০৩ সালের ঘটনা। রয়েল একাডেমি অফ সায়েন্সের সায়েন্টিস্টরা প্রচন্ড উত্তেজিত। লন্ডন এবং কওনবেলের মধ্যে দুরাভাসে কথা হবে। এই নতুন যন্ত্রটি আবিষ্কার করেছে মার্কনি। সভ্যতার এক নতুন দিগন্ত তৈরি করবে এ যন্ত্র।অন্যদিকে কোথাকার এক জাদুকর রয়েল একাডেমি অফ সায়েন্সের সামনে চিৎকার করে যাচ্ছে। তার কথায় মার্কনির ওই যন্ত্র মোটেই সুরক্ষিত নয়।

ক্ষ্যাপা, আধপাগল বলে প্রতিবার তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। লন্ডনের বড় বড় সায়েন্টিস্টদের সামনে যখন যন্ত্রের ডেমোন্সট্রেশন শুরু হবে ঠিক তখনই যন্ত্র থেকে ভেসে এল অদ্ভুত এক শব্দ। রাডস রাডস বলে কেউ চিৎকার করছে। এরপরই মার্কনিকে ব্যঙ্গ করে আবৃত হল এক বিচিত্র কবিতা। কিছুক্ষণ পর ওপার থেকে ভেসে এল আরেকটি আওয়াজ। সেই জাদুকর জানালেন, তিনি আগেই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন এই বার্তালাপ সুরক্ষিত বা গোপন নয়। সঙ্গে সঙ্গে মার্কনির সাথে তার নামও উঠে এলো ইতিহাসের পাতায় মানব সভ্যতার প্রথম হ্যাকার হিসেবে।

এরপর প্রযুক্তির অগ্রগতির চেয়ে বেশি দ্রুত ছুটেছে হ্যাকারদের জয়রথ। তথ্য সুরক্ষার ব্যাপারটি এমনভাবে ধাক্কা খেয়েছিল যে নাসা একসময় তাদের তথ্য সুরক্ষার দায়িত্ব দেন এক দুর্ধর্ষ হ্যাকারকে। হাজার হোক দুষ্টুর দমনে দুষ্টুরই তো দরকার হয়। কখনো কখনো এই হ্যাকিং হয়েছে নিছক মজা করার জন্য কখনও বা করা হয়েছে প্রতিপক্ষকে সায়েস্তা করার জন্য। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক ফরাসি সৈনিক নাৎসি বাহিনীর কার্ড পাঞ্চিং সিস্টেম হ্যাক করে শুধু নাৎসিদের গতিবিধি জানার জন্য।

হ্যাকাররা কখনও ঘুরে বেড়িয়েছে রাশিয়ার মহাকাশ কেন্দ্রের মুল সার্ভারে, কখনও পেন্টাগনে, কখনও নাসার হেড কোয়ার্টারে কখনও বা ইরাক যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের সেনা দফতরে।

একবার আমেরিকার এক ব্যক্তি বহু চেষ্টা করেও চাকরি জোগাড় করতে পারছিলো না। শেষমেষ বাধ্য হয়ে ম্যারিওট ইন্টারন্যাশনালের সার্ভার হ্যাক করে তাতে লিখলেন, ‘আমাকে চাকরি দাও না হলে সকল প্রকার গোপন তথ্য লোপাট করে দেব’।

ঠান্ডা মাথায় কর্তৃপক্ষ একটি অফার লেটার দিয়ে ওই ব্যক্তিকে অফিসে নিয়ে এলেন। কাজে যোগ দিয়ে সমস্ত সিস্টেম ঠিক করে দেয়ার পর তাকে তুলে নিয়ে যায় US secret service। তবে অপরাধী হিসেবে নয়। US Secret service এর তথ্য সুরক্ষায় মোটা বেতনের চাকরি পান তিনি। তবে সব হ্যাকার যে এরকম শিশু সুলভ তেমনটা নয়।

২০১২ সালে একদল মার্কিন এবং ইসরায়েল হ্যাকার ইরানের একটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে ঢুকে পড়ে। চোখের নিমিষেই পাল্টে যায় ইলেকট্রিকাল কানেকশন। কখনও AC-DC, কখনও DC-AC। আর কিছুক্ষণ দেরি হলে হয়তো পরমাণু বোমার আঘাতে মুছে যেত গোটা মানব সভ্যতা।

২০১৩ সালে British intelligence service ছদ্মনামে একদল হ্যাকার একটি মুসলিম ম্যাগাজিনের সার্ভার হ্যাক করে বসে। সেখানে ফলাও করে ছাপানো হয় কীভাবে বোমা তৈরি করা যায়। পুরো বর্ণনা অনুযায়ী বোমা বানাতে গেলে আসলে তা থেকে তৈরি হবে এক সুস্বাদু চকলেট কেক।

তবে সানফ্রান্সিসকো বাসী মনে হয় হ্যাকিংকে আর কখনো রসিকভাবে নেবে না। একবার কিছু তরুণ হ্যাকার হ্যাক করে বসে পুরো সানফ্রান্সিসকো শহরের ট্রাফিক ম্যানেজম্যান্ট সার্ভার। ফলে নিজেদের ইচ্ছে মতো বোর্ডে সাইন বসিয়ে দেয় তারা। একসঙ্গে বোর্ড গুলোতে ভেসে ওঠে- ‘গডজিলা অ্যাটাক, টার্ন ব্যাক’।

মুহূর্তেই হট্টগোল বেজে যায় পুরো শহরে। আতঙ্কে মানুষ দিকবিদিক ছুটতে শুরু করে। একসময় হ্যাকাররা তাদের কন্ট্রোল ছেড়ে দেয়। ততক্ষণে পুরো শহর ঘরে দরজা দিয়ে ভয়ে কাঁপছে।

বাংলাদেশও হয়েছে এরকম সাইবার হামলার স্বীকার। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার পাচার করে হ্যাকাররা। এর মধ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যায় ফিলিপাইনের জুয়ার বাজারে।

এই করোনাকালে আরো শক্ত হয়েছে হ্যাকারদের জয়রথ। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে হ্যাকিং নিয়ে রীতিমতো শুরু হয়েছে হট্টগোল। প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রনায়কেরই অভিযোগ শত্রু দেশ তাদের গবেষনার তথ্য হ্যাকের মাধ্যমে লোপাটের চেষ্টা করছে।

ইতিমধ্যে Federal Bureau of Investigation অভিযোগ করেছে, চীনা হ্যাকাররা তাদের জীবন অতিষ্ট করে তুলেছে।করোনা ভ্যাকসিন গবেষণার গোপন তথ্য চলে যাচ্ছে চীনা হ্যাকারদের কাছে। এমনকি বিভিন্ন হাসপাতালে কোন রোগীকে কোন ওষুধ দেয়া হচ্ছে, তাদের রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট অবদি তাদের হাতে। তাদের অভিযোগ, এই হ্যাকারদের সাহায্য করছে চীনা সরকার। তবে চীন এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি।

জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল কয়েকদিন আগে রীতিমতো কেঁদেই ফেলেন। তার অভিযোগ, ‘যতবারই রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ঠিক করতে যাই ততবারই কষ্ট পাই। রাশিয়ার সেনাবাহিনী প্রতিদিনই আমার সরকারের সমস্ত তথ্য হ্যাক করছে। এমনকি আমার কোন মেইল আসলে আমি পড়ার আগেই সেটা তারা পড়ে নেয়।’ তবে রাশিয়া এ ব্যাপারে কেন মন্তব্য করেনি।

কয়েকদিন আগে ভারতের মধ্য প্রদেশ সরকার তৈরি করেছিল কোভিড ড্যাস বোর্ড। যেখানে ছিল করোনা রোগীর যাবতীয় সকল তথ্যাদি। এসব তথ্য দেখতে পেত শুধুমাত্র প্রশাসন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ডাক্তাররা। একজন ফরাসি হ্যাকার পুরো ড্যাসবোর্ড তুলে নিয়ে টুইট করে দেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন ড্যাসবোর্ড বন্ধ করে দেন। এতে আরো মজা পায় হ্যাকার। সঙ্গে সঙ্গে সেই হ্যাকার আরেকটি টুইটে তুলে ধরেন কয়েকজন রোগীর নাম, লোকেশন, এমনকি তারা কি ফোন ইউজ করে তার তথ্য। অবস্থা বেগতিক দেখে পুরো সার্ভার বন্ধ করে দেয় মধ্যপ্রদেশ সরকার।

কয়েকদিন আগে ইরান-চীনাদের একদল হ্যাকার হ্যাক করে বসে ইসরায়েলের নাগরিকদের পানি পরিসেবার মূল সার্ভার। যার সার্ভার আবার খোদ আমেরিকায়। একে করোনার তান্ডব তারপর হ্যাকারদের দৌরাত্মে মাথায় হাত ইসরায়েলের।

হ্যাকাররা হয়তো বুঝিয়ে দেয় কোন সার্ভারের সুরক্ষা ব্যবস্থা কতটা দুর্বল। এখন দেখার বিষয় আর কি কি অভিযোগ উঠে আসে এই হ্যাকারদের হাত ধরে।

লেখক: শিক্ষার্থী আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস আ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সিলেট


সর্বশেষ সংবাদ