শুধু নাম নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি স্থান তাঁকেই মনে করিয়ে দেয়

মো. এনামুল হক
মো. এনামুল হক  © টিডিসি ফটো

লেখাটি ক্ষুদ্র বলে কেউ অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখবেন না। ক্ষুদ্র কিছুতেও বৃহৎ পরিসরের কিছু অন্তর্নিহিত থাকতে পারে। যারা এই অন্তর্নিহিতের রস উপলব্ধি করবে তারাই লেখাটি উপভোগ করবে।

এমন এক বীরের কথা বলতেছি যে শুধুই এক জন বীর নয় বরং বীরত্ব আর মনুষ্যত্বের সংমিশ্রণে গড়া ব্যক্তি। তিনি কোটি বাঙালীর হৃদয়ে আজও আছেন শ্রদ্ধাভরে, শেখ মুজিবর রহমান। তার নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোর একটি। এটি গোপালগঞ্জ শহরের অদুরে প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্যময় স্থানে অবস্থিত। এই আধুনিক সময়েও শহরের কোলাহল মুক্ত পরিবেশে শিক্ষার্থীরা খুঁজে পায় সেই জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা।

এই বিদ্যপীঠের নাম করণ করা হয়েছে তাঁরই নামে। শুধুই কি নাম, বরং বাঙালি জাতি ভালোবেসে তাঁকে যে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিল তাও বাদ যায়নি। তাইতো নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। যে নাম বারবারই তার আদর্শ আর নীতির স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নয় বরং এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি স্থান প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে শুধু তাঁকেই মনে করিয়ে দেয়।

প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশের পর প্রথম যে চত্বরটি দেখি সেটার নাম ‘জয় বাংলা চত্বর’। এই শব্দটি বঙ্গবন্ধুর বজ্র কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ৭ মার্চের ভাষণে। যে ভাষণকে মনে করা হয় বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। এই শব্দ টা মনে করিয়ে দেয় স্বাধীনতা যুদ্ধকে। জাতির পিতার অসহযোগ আন্দলোনের ডাক, বাঙালির রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা।

আর এই যুদ্ধের নেতৃত্ব যিনি দিয়েছিলেন তিনি যে কতটা আপোষহীন ছিলেন বাঙালির মুক্তির ক্ষেত্রে তা ইতিহাস জানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর নাম ‘একুশে ফেব্রুয়ারি লাইব্রেরি ভবন’। এই শব্দটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভাষা আন্দোলন নামের আরেক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের কথা।

ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে এমন দৃষ্টান্ত আর পৃথিবীতে নেই। এখানেও বৃহৎ পরিসরে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর নাম। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল ফরিদপুর জেলার কারাগারে। সেখানে বসেও তিনি আন্দোলন থামিয়ে রাখেন নি। কারাগারে বসেও করেছিলেন আমরণ অনশন। নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে ভেবেছিলেন জনগণের কথা, বাঙালির মুখের মধুর ভাষার কথা।

তখনকার কারাজীবনের দূর্বিষহ জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন নিজের হাতে লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটিতে। তার যে ত্যাগ সেটা যে কখনোই ভুলবার নয় তা যেন আরো একবার মনে করিয়ে দেয় এই লাইব্রেরি ভবন।

এবার যদি ছেলেদের থাকার হলের কথা বলি, তিনটি হল দেখতে পাই। সেগুলো হলো বিজয় দিবস হল, স্বাধীনতা দিবস হল ও শেখ রাসেল হল। মেয়েদের হলের কথাটা পরেই বলি। কারণ পাঠকগণ যেন মনে না করে লেখকের মেয়েদের প্রতি গুরত্ব বেশি। কারণ মানুষ্য জাতি ত্রুটি খুঁজতে ওস্তাদ। ত্রুটি ছাড়া মানুষও জগতে পাওয়া যাবে না। তবে যথাসম্ভব ত্রুটি এড়াবার চেষ্টা তো সবাই করে। আমিও সেটার ব্যতিক্রম নই।

এবার কথায় আসি। স্বাধীনতা দিবস শব্দটি আমাদের নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে। যেদিন শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন। তারই নির্দেশে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। আর ঐ দিনই বঙ্গবন্ধুকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। আরেকটি হল ‘বিজয় দিবস হল’ এটি মনে করিয়ে দেয় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিনটি।

দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এই দিনেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয় আর জন্ম হয় বাঙালি নামক জাতির। এই রাষ্ট্র কিংবা জাতির জন্মের মূলে বা কেন্দ্রে যিনি রয়েছেন তিনি শেখ মুজিবর রহমান। যার নেতৃত্ব ছাড়া আজও এদেশ স্বাধীন হতো কিনা সন্দেহ। এ কথা এজন্য বললাম যে, তার পূর্বেও অনেক নেতার জন্ম হলেও কেউ স্বাধীনতার ডাক দিতে পারে নি।

সর্বশেষ যে হলটি রয়েছে সেটি হল শেখ রাসেল হল। এই নামটি মনে হলে মনে পড়ে যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট দিনটির কথা। যেদিন ঘাতকদের হিংস্র থাবা থেকে রেহাই পায় নি ফুলের মত ফুটফুটে শিশুটি,বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল। মনে পড়ে যায় সেই বর্বরতার দিন যেদিন পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের প্রায় পুরো পরিবার।

দেশের জন্য যার এত কীর্তি তার প্রতিদান যে মানুষ এত নিষ্ঠুরভাবে দিতে পারে তার সাক্ষী আগষ্টের সেই দিনটি। তবে এই খুনিদের মানুষ বলা মোটেও ঠিক নয়। কেননা এরা কখনোই মানুষ নামের প্রাণীর দলভুক্ত হতে পারে না। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর খুনীরা পশু অপেক্ষাও নিকৃষ্ট। পৃথিবীতে এমন নেতার দৃষ্টান্ত খুবই নগন্য।এবার আসি মেয়েদের হলগুলোর কথায়। মেয়েদের হল গুলো হলো-

‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল’ এবং ‘শেখ রেহেনা হল’ এই হলগুলোও মনে করিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কথা। ক্যাাম্পাসে কেন যেন বারবারই খুঁজে পাই শুধু বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা। পুরো ক্যাম্পাস জুড়েই যেন তাঁর উপস্থিতি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে নিজের ভেতর কেমন যেন একটা প্রতিবাদী মনোভাব তৈরি হয়েছে ভেতরে।

কেননা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়েই রয়েছে সেই প্রতিবাদী বীরের নানা স্মৃতির ইঙ্গিত। যেগুলো শুধু তার আদর্শ, নীতি আর সংগ্রামী স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এবার যদি এই বীরের কথা লিখতে শুরু করি তবে হয়তো কোনো ভাবেই শেষ করতে পারব না। কেননা ইনি এমন এক ব্যক্তি যার পুরো জীবনেই রয়েছে শুধু ইতিহাস। যেটা আমার এই সামান্য লেখায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে যত গুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে তিনি সকল দলের উর্ধ্বে। সকল দলেরই আদর্শ। তিনি কোনো দলের নয় বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বাঙালি জাতির নেতা। যার জন্ম না হলে হয়তো জন্ম হতো না বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশের। আর রাজনৈতিক দল তো দুরের কথা। আজও সকলের হৃদয়ে লালিত হয় মুজিবের আদর্শ।

এখনকার সময়ে নেতার অভাব নেই, শুধু স্বার্থান্ধ নেতা। স্বার্থহীন ত্যাগী, শুধু জনগণের কল্যাণকামী নেতা খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। আর অনেক লোকই আছে যারা শুধু মুখে মুখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে। তারাও অনুকূল পরিবেশে থাকার জন্যই এই মিথ্যা রুপ ধারন করে আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো সব সময় লড়াই করেছেন প্রতিকূলতার সাথে। তাই যারা বঙ্গবন্ধুর সত্যিকারের আদর্শ ধারণ করে তারা শুধু অনুকূল পরিবেশে নয় বরং প্রতিকূল পরিবেশেও তাঁর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগনের কল্যাণ করে যাবে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষ হয়ে গেলেও তার স্বপ্নের কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে। আজও কি পেয়েছি আমরা সেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা? মানুষ কি সব জায়গাতে পেয়েছে তাদের ন্যায্য অধিকার? যে ন্যায্য অদিকার আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন ‘আমি এদেশের প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমি এদেশের মানুষের মুক্তি চাই’।

তিনি কিসের মুক্তি চেয়েছেন? অধিকার ফিরে পাবার মুক্তি যেটা ছিল পাকিস্তান সরকারের অধীনে। যিনি আমাদের অধিকারের কথা ভেবেই নিজের জীবন টা কাটিয়েছেন সংগ্রাম, আন্দলোন আর কারাগারে। আর আমরা বিনা পরিশ্রমে পাওয়া স্বাধীন দেশটাকে নিজেদের ক্ষমতায় আধিপত্য বিস্তারের চর্চা করছি। এটা তো কখনোই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা নীতির মধ্যে ছিল না। তবে কিভাবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হলো। অধিকার প্রসঙ্গে ছোট একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করতে চাই।

সাধারণ মানুষের প্রথম আশার আশ্রয়স্থল হলো পুলিশ। যাদেরকে মনে করা হয় জনগনের বন্ধু। সেই বন্ধুই টাকা ব্যতীত থানায় সাধারণ ডায়েরি করে না আর মামলা তো দুরের কথা।

এমনকি জনগনের টাকায় পেট্রোল না ঢুকালে তাদের গাড়িখানা ও চলে না। যদিও সরকারের কাছ থেকে তারা সব কিছুর জন্য টাকা পায়। কথা গুলো অপ্রাসঙ্গিক মনে করতে পারেন অনেকে। বলার উদ্দেশ্য হল যে, বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষতেও দাঁড়িয়েও আমরা কতটুকু দিতে পারলাম তার স্বপ্নের প্রতিদান। যিনি জনগনের জন্য সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন। আজও সেই জনগন কতটা অধিকার পাচ্ছে? শুধু কথায় নয় ভেতর থেকে ধারণ করতে হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ।হতে হবে ত্যাগী, স্বার্থান্ধ নয়।

‘যতদিন রবে বাংলা,বাঙালি
যতদিন জ্বলবে বাংলার বুকে প্রদীপ;
ততদিন তুমি রবে অমর
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ