করোনাভাইরাস: যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে পরিবর্তিত বিশ্ব
- মো: হাসান তারেক
- প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২০, ০২:২০ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:১৫ PM
সারাবিশ্বের নেতারা করোনাভাইরাস সংক্রমণকে একটি মহাযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করছেন। এটি এমন একটি যুদ্ধ, যা নিয়ে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্য নেই কোন মতপার্থক্য। সরকারি দল এবং বিরোধীদল একই সুরে কথা বলছে করোনার সংক্রমণ থামাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম বিশ্ব দেখছে, মেরুকরণ রাজনীতিবিহীন এক বিশ্বকে। ছোট-বড়, ধনী-গরীব, সকল রাষ্ট্র কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক করোনামুক্ত বিশ্বের কল্পনা করছে, এক সঙ্গে সেজন্য কাজ করছে।
আন্তজার্তিক রাজনীতি অঙ্গনে জাতীয় সংহতি সৃষ্টির এক অনন্য নজীর প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব যে সামনের দিনগুলোতে এক নতুন বিশ্বের স্বপ্ন দেখাচ্ছে তা ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হচ্ছে। লকডাউন,জনতার সান্ধ্য আইন বা জরুরী অবস্থা সারাবিশ্বের মানুষের জীবনাচরণে সত্যিই এনেছে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। মানব জীবনাচারণের এই পরিবর্তনগুলো মানুষকে করেছে আগের চেয়ে অনেক সচেতনভাবে। শহর থেকে গ্রাম সব জায়গায় এখন এক মহামারির আতঙ্ক।
সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক সরকার সকলের কণ্ঠে একবাণী ‘করোনা ঠেকাও’। সামনের দিনগুলোতে করোনা পরবর্তী বিশ্বে বাজারব্যবস্থায় এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন আমরা দেখতে পাবো। করোনার কারণে, অনলাইন বাজারের দিকে ঝুঁকে পড়েছ বিশ্ব এবং হয়ে উঠেছে এক জনপ্রিয় মাধ্যম আগের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রকৃতির নেতিবাচক পরিবর্তন মানবসভ্যতাকে কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ করতে পারে তা সম্পর্কে মানুষকে বাস্তবিকভাবে ভাবাতে শুরু করেছে।
করোনার সংক্রমণ ধনী-গরীব সকলকে একই লাইনে নিয়ে এসে দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায়। চিরবৈরী দেশ চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক লাইনে এনে করোনা দেখিয়েছে বিভেদ নয়, ঐক্যই শক্তি। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরে নরেন্দ্র মোদী সার্ক শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো, সার্ক তহবিল গঠণের চিন্তা আসলো। ব্রিটেনের চলে যাওয়া নিয়ে যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন চিন্তিত, সেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই চরম দুর্দিনে এক থাকার গুরুত্ব খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছে এখন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরবর্তী বিশ্বে আমরা দেখবো, চিকিৎসা ও বিজ্ঞানে আসবে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। টেলিমেডিসিন বা দূর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে গুণগত চিন্তা ভাবনার বিকাশ ঘটবে। এরকম প্যানডামিক বা মহামারির সময় টেলিমেডিসিনই হতে পারে যথাযোগ্য সমাধান। বিজ্ঞান ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ বাড়ানোর চিন্তা নতুন করে শুরু করবে বিশ্ব নেতারা। শিক্ষাপদ্ধতিতেও আসবে পরিবর্তন। দূরশিক্ষণ, ই-লানিংয়ে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলো চাইবে নিজেদেরকে শক্তিশালী করতে।
জাতীয় সংহতির পাশাপাশি পারিবারিক সংহতি বা পারিবারিক বন্ধনকে শক্তিশালী করে দেখিয়েছে করোনাভাইরাস। অনলাইন যোগাযোগ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টিনের দিনগুলোতে দেখিয়েছে তাদের আধিপত্য। সামাজিক দুরত্বের দিনগুলোতে অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম হয়েছে একমাত্র আর্শীবাদ। করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্বে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি চিকিৎসক সম্প্রদায়ের মর্যাদাও বাড়বে পূর্বের চেয়ে বহুগুণ। সেনাবাহিনী যেমন তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়ে দেশকে রক্ষা করে, ঠিক তেমনি চিকিৎসকরা তাদের জীবন দিয়ে রক্ষা করে মানবসভ্যতাকে।
করোনা সংকটকালে পুজিঁপতিরা, মহাজনরা দেখলো শ্রমজীবী, খেটে খাওয়া লোকগুলো ছাড়া তারা কত অসহায়। জনগণ ছাড়া সরকার যেমন মূল্যহীন, তেমনি রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া জনগণও কত অনিরাপদ। জনগণকে রক্ষা করার জন্য সরকার বা রাষ্ট্র কত ভাবনা-চিন্তা না করে নিরন্তরভাবে। করোনা সংক্রমণ পরবর্তী বিশ্বে জয় জয়াকার ঘটবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের, উদারতাবাদের। এই মহামারির দিনে সারাবিশ্বের জনগণ দেখছে কেউ এখন আর দূরে নয়।
‘নগর পুড়িলে যে দেবালয় এড়ায় না’ তা শিক্ষা দিয়ে দিল করোনাভাইরাস। পরিবর্তন আসবে সামনে ধর্মীয় আচার পদ্ধতিতেও। গুজবের গজব আর যে কার্যকরী নয় এই প্রযুক্তিকর যুগে তা প্রতীয়মান হবে। সংকটের এই দিনগুলো আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে দুর্যোগমূর্হুতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা হচ্ছে মূলকথা। উন্নতবিশ্ব উন্নয়নশীল ও অনুন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মানুষকে শিক্ষা দিচ্ছে যে, অন্যের ছিদ্রান্বেষণ না করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে সকল বিপদ প্রতিহত করা সম্ভব। দুর্যোগকালে একতাই বড় বল। আশা করাই যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরবর্তী বিশ্ব হবে, আরো বেশি সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ঐক্যের। জয় হোক মানবতার, উদারতার।
লেখক : প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা