বঙ্গবন্ধুর বিশ্বজনীন মানবিক দর্শন
- তানভীর সালেহীন ইমন
- প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২০, ১০:১৪ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৫:৫৯ PM
বিশ্বের মুক্তিকামী, সংগ্রামী, শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস এবং মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বহুমাত্রিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম জীবন দর্শন, মানবিক মূল্যবোধের আলোকে স্বদেশ ও বিশ্ব সম্প্রীতির কল্যাণ চিন্তন। শিশু মানস থেকেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-কষ্ট-ক্লেশ বেদনা-শোকে শোকার্ত হতেন শিশু মুজিব। নিজের ঘরের গোলার ধান নিরন্নকে বিতরণ কিংবা বিবস্ত্র শিশুকে নিজের বস্ত্র দানের নজির স্থাপন করেন বাল্যবেলাতেই। কিশোর বয়সেই অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য, বঞ্চনার বিরুদ্ধে বারংবার বিদ্রোহী হয়েছেন। কারা অন্তরীণে কেটেছে কৈশোরের কষ্টের দুরন্তপনার দিবা-রাত্রি।
১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের ভাষণে “যতদিন না সমাজ থেকে শোষণের মূলোৎপাটন হবে, যতদিন না দেশের প্রত্যেক নাগরিক দলমত ও ধর্ম নির্বিশেষে অর্থনৈতিক মুক্তি ও প্রাচুর্যের আস্বাদ গ্রহণ করতে পারবে” ততদিন সংগ্রাম চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেন। ৭ মার্চের রক্তঝরা উত্তাল অগ্নিস্ফুলিঙ্গে বিক্ষুব্ধ জাতির সংগ্রামের সর্বাত্মক আন্দোলনের আহ্বানে বঙ্গবন্ধু গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্য রিকশা, গরুর গাড়ি, রেল, লঞ্চ চালানোকে হরতালের আওতামুক্ত রাখেন। সংখ্যায় একজনও যদি ন্যায্য কথা বলে সেটি মেনে নেয়ার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু মানবসত্ত্বার মর্যাদা, পরমতসহিষ্ণুতা, সামাজিক ন্যায়বিচারকে এভাবেই গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রায়শই গুন গুন করে গাইতেন-
“মানবের তরে মাটির পৃথিবী, দানবের তরে নয়।”
বঙ্গবন্ধু তাঁর সুন্দর ও নান্দনিক মন-মনন-চিন্তনের সৃজনশীলতায় মানবিক সত্ত্বার আলো ছড়িয়েছেন সর্বত্র। তাঁর উচ্চারিত প্রিয় দুটি শব্দগুচ্ছ ‘‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ।” শব্দ দুটির মধ্যে গভীর অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য রয়েছে। বাঙালি মানেই জাতিসত্ত্বার সংঘবদ্ধতা আর মানুষ মানেই সার্বজনীনতা, মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা।
স্বাধীনতা অর্জনের বছরান্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু বিশ্বনন্দিত শাসনতন্ত্র জাতিকে উপহার দিয়েছেন যেখানে অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য ও সমতার অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীর ক্ষমতায়ন, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, মুক্ত বুদ্ধির চর্চার, বাক স্বাধীনতা, সুশাসন সবকিছুই সুচারুভাবে সন্নিবেশিত।
১৯৭৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা তাঁর বক্তৃতায় দৃঢ়তার সাথে বলেন “এদেশের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান আপনারা ভাই ভাই হিসেবে বাস করবেন। কোন মতে সাম্প্রদায়িকতা যেন বাংলার মাটিতে না হয়। যারা সাম্প্রদায়িক তারা হীন, নীচ তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারে না।”
সোনার বাংলাকে শ্মশান করে যাওয়া যুদ্ধ বিধ্বস্ত ধূসর বাংলাদেশের সোনালী সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তাঁর সহযোগীরা একদিকে দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী দেশী-বিদেশী পরাজিত শক্তি দেশে অস্থিরতা অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অপপ্রয়াসে লিপ্ত ছিলো। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি বাস্তুহারাদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন “স্বাধীনতা মানে বিশৃঙ্খলা নয়, স্বাধীনতা মানে গুন্ডামি বদমায়েশি নয়, স্বাধীনতা মানে একজনের কাছ থেকে জুলুম করে পয়সা উপার্জন করা নয়, স্বাধীনতা মানে মুক্ত দেশের মুক্ত মানুষ, তারা স্ব-সম্মানে ইজ্জতের সঙ্গে বাস করবে এবং তারা মানুষের মতো বাস করবে। শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রতিজ্ঞা আমি গ্রহণ করেছি।”
মনোজাগতিক উপনিবেশবাদের শৃঙ্খল ভেঙ্গে আমলাতন্ত্রকে জাতির পিতা ঢেলে সাজাতে গিয়ে ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেন “আপনাদের জনগণের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এখন থেকে অতীতের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করে নিজেদের জনগণের খাদেম বলে বিবেচনা করতে হবে।”
পুলিশ সপ্তাহে রাজারবাগে পুলিশের উদ্দেশ্যে বলেন “তোমরা স্বাধীন দেশের পুলিশ, জনগণের পুলিশ তোমাদের কর্তব্য জনগণের সেবা করা, জনগণকে ভালোবাসা।” বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন ছিলো মানুষের মানবতাবোধ জাগ্রত করে মানবিক সমাজ বিনির্মাণ।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ, উগ্রবাদ, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে দৃপ্ত অবস্থান ব্যক্ত করে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতি প্রণয়ন করেন। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দাঁড়িয়ে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে এই অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার আহবান জানান। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন “বিশ্ব আজ দুটি শিবিরে বিভক্ত। একদিকে শোষক আরেক দিকে শোষিত, আমি শোষিত মানুষের পক্ষে।”
দেশমাতৃকার স্বাধীনতা অর্জনে এদেশের নারীদের সীমাহীন আত্মত্যাগ ও সাহসিকতা সর্বজনবিদিত। ১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাবনার এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন “আমার যে মেয়েরা পাকিস্তানী বর্বরদের কাছে ধর্ষিত হয়েছে,তোমরা যারা আদর্শ নিয়ে যুদ্ধ করেছ, তোমাদের কাছে আমার আবেদন এই ত্যাগ নিয়ে তোমাদের এগিয়ে যেতে হবে এবং এই মেয়েদের তোমাদের অনেককে বিবাহ করতে হবে। দুনিয়াকে দেখাতে হবে শুধু অস্ত্রই নিতে পারো না, মা-বোনের ইজ্জতের জন্যে এগিয়ে তোমরা যেতে পার।”
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনুষ্ঠানে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিয়ে জাতির পিতা বলেন “আমি আশা করি স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যতে ছেলে ও মেয়েরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলবেন। অন্ধ সংস্কারে আমাদের জগতের অর্ধেক অংশকে আমরা ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছিলাম। ধর্মের নামে মিথ্যা কথা বলে মা-বোনদের আমরা দমন করে রেখেছিলাম। আপনারা নিশ্চিন্তে বিশ্বাস রাখতে পারেন এই স্বাধীন বাংলাদেশের ভাই-বোনদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।”
যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভগ্ন অর্থনীতি ও অবকাঠামোর ধূসর পান্ডুর জমিতে সোনালী স্বপ্নের বীজ রোপন করেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। সাম্য, সমতা, মানবতার কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বঙ্গবন্ধু বৈষম্যের অবসান চেয়েছেন মনে-প্রাণে। ১৯৭২ সালের ৯ অক্টোবর চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় জাতির পিতা বলেন “ওয়ার্ড বয় কী? সুইপার কী? ডাক্তার বা কী? নার্স বা কী? সবাই সেবক। সবাই বাংলার মানুষ। সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে তা না হলে এদেশে মঙ্গল আসতে পারে না।”
“আপনাদের সকলের কাছে আমার আবেদন আপনাদের একটু পরিবর্তন হওয়া দরকার । মানবিক পরিবর্তন। মানবতাবোধ আপনাদের ফিরে আসতে হবে এবং মানুষকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।”
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন মানুষকে না ভালোবেসে মানুষের সেবা করা যায় না । তাঁর মানবাধিকার দর্শন, মুক্তির চেতনা, মানবিক মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ, মানবতার আদর্শ আজ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ও স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধুর হৃদয় ছিলো বিশ্বজনীন মানবিকতায় পরিপূর্ণ তাইতো তিনি দেশ-কাল-পাত্র-মানচিত্রের সীমারেখার ঊর্ধ্বে বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু।
লেখক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সদর সার্কেল, কুমিল্লা