জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ কোথায় ছাত্রলীগ নেই?
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৫:২৭ PM , আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০২:২৯ PM
বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া স্বপ্নের সংগঠন ছাত্রলীগ এখন খেই হারিয়ে বিপথগামী। সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ছাত্রলীগ এসময়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে। যে অতীতের গৌরব আর অর্জন ছিল ছাত্রলীগের আকাশ ছোঁয়া। সেই অর্জন আজ ম্লান। ছাত্রলীগের বিপথগামী নেতৃত্বের কারণে ছাত্রলীগ হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন একটি সংগঠন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১১ দফা আন্দোলন,৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন স্বাধীকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল যে ছাত্রলীগ সেই ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি এখন চরম সংকটে। এমনকি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগ মুজিব বাহিনী গঠন করে,তারা যুদ্ধে অংশগ্রহন করে এবং বাংলাদেশের বিজয় অর্জনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সাড়ে ১৭ হাজার ছাত্রলীগের নেতাকর্মী জীবন দিয়েছেন।একাত্তর পূর্ববর্তী ছাত্রলীগের ছিল গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা তৎপরবর্তী ছাত্রলীগের ভূমিকা জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ ও যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করেছে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের একটানা প্রায় এগারো বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার এ সময়ে ছাত্রলীগের কার্যক্রমে সরকার যেমন বিব্রত হয়েছে জনগণ তেমনি হয়েছে ভুক্তভোগী। ছাত্রলীগ প্রায় সময় ধর্ষণ,অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ভর্তি-বাণিজ্য, শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাংবাদিক-পুলিশের ওপর হামলা, খুন, লুটপাট,ইভটিজিং, যৌন সন্ত্রাস সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য হয়েছে পত্রিকার শিরোনাম। ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা দুর্ধর্ষ ক্যাডার জসিমউদ্দিন মানিক ১০০ ছাত্রীকে ধর্ষণের ‘সেঞ্চুরি উৎসব’ পালন করেছিল।
গণমাধ্যমের সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, দৈনন্দিন রুটিনে ছাত্রলীগ অপহরণ, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ভর্তি-বাণিজ্য, ছাত্রী উত্ত্যক্ত,প্রশ্নফাঁস, ছাত্রাবাসে কক্ষ দখল, ঠিকাদারি কাজে বাধা দেওয়াসহ বিভিন্ন অপকর্ম যেন ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।
ছাত্রলীগ নামটির সঙ্গে সন্ত্রাস, ভীতি, আতঙ্ক, দৌরাত্ম্য, দাপট প্রভৃতি শব্দ যেন সমার্থক হয়ে গেছে। দলীয় কোন্দল থেকে সহকর্মীকে খুন, নির্মাণকাজের টেন্ডারের বখরা নিয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অফিসকক্ষ ভাঙচুর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা-এহেন কোনো কাজ নেই যার সঙ্গে ছাত্রলীগের সমপৃক্ততা পাওয়া যায়নি। অসংখ্য বীভৎস ঘটনার নিচে চাপা পড়ে আছে ছাত্রলীগের ইতিবাচক সকল কর্মকাণ্ড। ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে দূরবীক্ষণ যন্ত্রে দেখাটাও আজ কষ্টকর। বারবার ভেসে উঠে ছাত্রলীগের বর্তমান কুৎসিত কদর্য চেহারা।
বিশ্বজিৎ কে কোপানোর সেই ভয়াল দৃশ্য যা এখনো জনগণকে আতঙ্কিত করে। রোমহর্ষক সেই ঘটনা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। বর্তমান ছাত্রলীগের দুজনকে অপসারণ কিংবা পদত্যাগ করানো যায় বলি না কেন এটি ছাত্রলীগের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা সুযোগ সন্ধানী ও সহমত ভাইদের জন্য অবশ্যই সতর্ক বার্তা। এই শুদ্ধি অভিযান ছাত্রলীগের শীর্ষ পর্যায়ে কিছুটা প্রভাব বিস্তার করবে তা হলফ করে বলা যায়।বেশ কিছুদিন ধরে শোভন ও রাব্বানীর বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে। যার মধ্যে রয়েছে বিতর্কিত ব্যক্তিদের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা করে দেওয়া, অনৈতিক আর্থিক লেনদেন, সম্মেলনের করেও একাধিক শাখায় কমিটি না দেওয়া, বিলাসী জীবনযাপন, ছাত্রলীগের পদ পাওয়ার পর থেকেই শোভন রাব্বানী রাজধানীর কাঁঠালবাগান ও হাতিরপুলে যথাক্রমে ৭০ হাজার ও ৪০ হাজার টাকার ভাড়া ফ্লাটে জীবনযাপন শুরু করে।
তাদের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ হলো দুপুরের আগে ঘুম থেকে না ওঠা, সংবাদকর্মীদের এড়িয়ে চলা কিংবা ফোন রিসিভ না করা,বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েও নির্ধারিত সময়ের অনেক পর উপস্থিত হওয়া অথবা অনুপস্থিত থাকা ইত্যাদি অভিযোগ চলছিল কয়েক দিন ধরে। এরমধ্যে ছাত্রলীগ সভাপতির বিয়ের অভিযোগের সত্যতা যেন হাটে হাড়ি ভাঙ্গে।এছাড়া দু'জনের বিরুদ্ধে সংগঠনের নেত্রীদের সঙ্গে অবৈধ অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার অভিযোগও চাউর হয়। মানবতার ফেরিওয়ালা রাব্বানী গত বছর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরদিন থেকে টয়োটা কোম্পানির নোয়া মডেলের একটি মাইক্রোবাস ব্যবহার করতে শুরু করেন। ছাত্রলীগ মানেই যেন তাদের কাছে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ যেখানে ঘষা দিলেই মেলে শান শওকত আলিশান জীবনযাপনের উপকরণ, উপাদান।
সর্বশেষে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক রাব্বানী শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে বাধ্য হলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে গিয়ে চাঁদা দাবির গুরুতর অভিযোগ নিয়ে কয়েকদিন ধরেই পত্র পত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনা চলছিল। এই দুই শীর্ষ ছাত্রলীগ নেতা ভিসির সঙ্গে দেখা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশন আদায় করে দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও তারা দুজনেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল।
ছাত্রলীগের বর্তমান সাধারণ ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে নিজেদের আখের গোছানোয় যেন বেশি তৎপর। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে যে সংগঠনের এতো অর্জন সেই সংগঠনে আদর্শহীন বিপথগামী নেতৃত্ব যেন সংগঠনটির গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে ম্লান করে দেয়। এই ছাত্রলীগের ব্যানারে নাম দিয়ে লম্পট মানিক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক'শ বোনের ইজ্জত হরণ করে ধর্ষণের সেঞ্চুরির উৎসব পালন করেছে,এই সংগঠনের কিছু কুলাঙ্গার বিশ্বজিৎকে দিনে দুপুরে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তাদেরই পূর্বসুরী থার্টি ফাস্ট নাইটে ঢাবির টিএসসিতে বাঁধন নামে একটি মেয়ের বস্ত্র হরণ করে নিউ ইয়ার পালন করেছে।
এসব জঘন্য ঘটনা সংগঠনটিকে করেছে বিতর্কিত ও করেছে সাধারণ শিক্ষার্থী বিমুখ। চরিত্রহীন লোভী নেতৃত্ব সংগঠনকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারে না। নির্লোভ সত্যিকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিবেদিত নেতৃত্ব পারে প্রায় সত্তর বছরের পুরনো সংগঠনটির ইমেজ ফিরে দিতে। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে ছাত্রলীগের বাধা প্রদান সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে সংগঠনটির ইমেজ সংকট তৈরি করেছে।
এতো পুরনো সংগঠনটির আদ্যোপান্ত পর্যবেক্ষণ করলে কৃতিত্ব অবদান বর্তমানের বীভৎস কার্যক্রমের কারণে আবরণে ঢাকা পড়েছে। কখনো কখনো এই ছাত্রলীগ ও বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি ছাত্রলীগের মিল খুঁজতে গিয়ে মনে খটকা লাগে! এটি কি সেই সংগঠন যে সংগঠন একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ছিল সম্মুখ সমরে! এটি কি সেই সংগঠন যে সংগঠনটি মায়ের ভাষা আদায়ে অকুতোভয়! তবে সেই সংগঠনের নেতৃত্বের কেন এই বেহাল দশা? জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের সব জায়গায় আজ আমরা ছাত্রলীগকে পাচ্ছি। পাচ্ছি ধর্ষণের সেঞ্চুরিতে, তরুণীর বস্ত্র হরণে, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ অনৈতিক কার্যকলাপে?