সিএসইতে পড়ে মার্কেটিংয়ে, বিবিএতে পড়ে গার্মেন্টসে জব!

চাকরি প্রার্থীরা
চাকরি প্রার্থীরা  © প্রতীকী ছবি

মো: আনিসুর রহমান,২০১৪-১৫ সেশনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণী বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। সাড়ে তিন বছর যাবত বিভিন্ন সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছেন। কোথাও প্রিলিতে টিকেছেন, তো রচনা মূলক পরীক্ষায় বাদ পড়েছেন। আবার কোথাও প্রিলি, রচনামূলক পরীক্ষায় টিকলেও ভাইবায় বাদ পড়েছেন।

শিক্ষা জীবন শেষে সাড়ে তিনবছর পাড় করে ফেলেছেন। তবুও এখনো বেকার জীবনের ঘানি টানছেন। ঠিকমতো বাড়িতে আসতে পারেন না। মা-বাবার মলিন মুখ, আত্মীয় -স্বজন, পাড়া প্রতিবেশির বিভিন্ন কথা শুনতে শুনতে জীবনটা অতিষ্ঠ। এই যতনা আর বয়ে চলতে পারছেন না। হতাশায় কুঞ্জ হয়ে পড়েছেন। আনিসুরের মত এ রকম বেকার মানুষের সংখ্যা আমাদের গ্রামে -গঞ্জে, শহরে অহরহ।

উচ্চশিক্ষা এখন আর চাকুরী পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তরুণেরা যতবেশি পড়ালেখা করছেন, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ( আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থান নিয়ে এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে ১৬.৮ শতাংশ। ১০ দশমিক ৭ শতাংশ বেকারত্বের হার নিয়ে বাংলাদেশ এ অঞ্চলের ২৮ দেশের মধ্যে ২য় অবস্থানে রয়েছে। তালিকায় ৮.৪ শতাংশ নিয়ে ভারত ৩য় এবং ৭.৯ শতাংশ নিয়ে শ্রীলংকা চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।

সর্বশেষ কলেজ গ্রাজুয়েট ট্রেসার স্টাডির তথ্য উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক বলছে, কলেজ গ্রাজুয়েট পুরুষদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ বেকার। নারীদের মধ্যে এ সংখ্যা আরো বেশি ৭৭ শতাংশ। গ্রাম শহর ভেদেও রয়েছে পার্থক্য । মেট্রোপলিটন এলাকার কলেজ গ্রাজুয়েটদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫৫ শতাংশ হলেও গ্রাম অঞ্চলে তা ৭২ শতাংশ। বিভাগ ভেদেও রয়েছে এ হারের তারতম্য। মানবিক বিভাগে ৭৭ শতাংশ, সামাজিক বিজ্ঞানে ৭১ শতাংশ, বিজ্ঞানে ৫৬ শতাংশ এবং ব্যবসায় শিক্ষার ৬৯ শতাংশ কলেজ গ্রাজুয়েট বেকার থাকছেন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ বেকার। এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিত বেকারের হারই বেশি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সূত্র মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি।

বাংলাদেশে বেকার সমস্যা সৃষ্টির পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানাবিধ কারণ রয়েছে। যেহেতু কথা হচ্ছে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারদের নিয়ে তাই গ্রাজুয়েট বেকারদের সংখ্যা বৃদ্ধির নেপথ্যের কারণ বিশ্লেষণ করা যাক ।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থা আজও পরিবর্তিত হয় নি। তারা মূলত কেরানি তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। সেই শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও প্রচলিত আছে। শিক্ষিত লোক বাড়ছে অথচ কর্মমুখী শিক্ষিত লোক বাড়ছে না। ফলে শিক্ষিত বেকার সৃষ্টি হচ্ছে। এটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেকার সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ।

বাংলাদেশে বিদেশি প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও কারিগরি জ্ঞানের অভাবে সে অনুপাতে দক্ষ শ্রমিক যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে, অদক্ষ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে থাকে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলেও সেই উচ্চশিক্ষার সনদ ধারী শিক্ষার্থিদের মাঝে রয়েছে যথেষ্ট কারিগরি শিক্ষার অভাব । শিক্ষা জীবনে তারা যা শিখে বা পড়ে আসে তার অধিকাংশই কাজে লাগে না তার কর্মক্ষেত্রে ।

ইংরেজি ভাষার উপর দক্ষতা না থাকার কারণও বেকারত্বের অন্যতম কারণ। এছাড়া সবচেয়ে বড় যে গলধ রয়েছে সেটা হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে চাকুরীনিয়োগ পরীক্ষার ধরণের রয়েছে বিস্তর ফাঁড়াক। একজন মাইক্রোবায়োলজিতে অনার্স করা শিক্ষার্থীকে সরকারী চাকরি পেতে হয় উগান্ডার রাজধানীর নাম কি? মুদ্রার নামকি? কোন মহাদেশে অবস্থিত এসব মুখস্ত করে। সাধারণ জ্ঞানের জন্য এসবের প্রয়োজন থাকলেও এগুলোতো চাকুরি নিয়োগের মানদন্ড হতে পারে না।

উপরোক্ত কারণ ছাড়াও আরও নানা কারণ রয়েছে যার কারণে দেশে গ্রাজুয়েট বেকারদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ।

কর্মমুখি শিক্ষার কথা নামে থাকলেও আসলে তার বাস্তব রুপ বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে তেমন একটা পরিলক্ষিত নয় ।বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রি বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান গুলোতে নিয়মিত চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে । কোম্পানি যে ধরনের কর্মী খুঁজছে তার জন্যে হাজার হাজার এপ্লিকেশন জমা পড়লেও তারা যোগ্য প্রার্থিকে খুঁজে পাচ্ছে না । কারণ আবেদনকারী সকলের হয়ত আবেদন করার জন্যে উচ্চশিক্ষার সনদটাই রয়েছে শুধু তা ছাড়া তাদের তেমন দক্ষতা বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠনগুলোতে কি কাজ করতে হয় বা কিভাবে করতে হয় তার কোন অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান নেই । বাংলাদেশের পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী পাশ করে বের হচ্ছে কিন্তু গ্রাজুয়েশন শেষে মিলছে না চাকুরি । আর চাকরি পেলেও দেখা যায় সে যে সাব্জেক্টে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করছে চাকরির সাথে সেই সাব্জেক্ট এর কোন সম্পর্কই নেই । সিএসই তে পড়া ইঞ্জিনিয়াররা করছে মার্কেটিং এর জব আর বিবিএ কমপ্লিট করে করছে গার্মেন্টস এর জব ।

আর বাংলাদেশের এই বেকার সমস্যার অন্যতম মুখ্য কারণ হিসাবে আমি উচ্চ শিক্ষার শিক্ষা প্রদান পদ্ধতিকে দায়ী করব । একজন মানুষের গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে গেল অথচ তার ওয়ার্কিং ফিল্ড সম্পর্কে কোন ধারনা নেই বা সে যদি নাই জানে চাকরিতে গিয়ে তাকে কিভাবে কাজ করতে হবে তাহলে উচ্চশিক্ষার সনদ ধারি সেই শিক্ষার্থীর বেকার থাকাটাই স্বাভাবিক ।

বাংলাদেশে মোট বিশ্ববিদ্যালয় এর সংখ্যা ১৪৩ যার মধ্যে ৪০ টি পবলিক আর ১০৩ টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে । অথচ পুকুর খনন করা শিখতে সরকারী কর্মকর্তাদের অস্ট্রেলিয়া যেতে হয়, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা দেখতে ওয়াসার কর্মকর্তাগণ উগান্ডা যায়, একটা সেতু বানাতে হলেও বিদেশ থেকে ইঞ্জিনিয়ার আনতে হয়। তারমানে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে দক্ষ জনশক্তি আসছে না। হচ্ছে না কোন গবেষণাধর্মী পড়ালেখা।

কেননা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা গদবাধা। এখানে পড়ালেখা সব শীট নির্ভর । বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজন মত ইন্ডাস্ট্রি ওরিয়েন্টেড লেখা পড়া হয় বলে আমার জানা নেই । যা হয় তার আসলে বাস্তব ওয়ার্ক ফিল্ডের সাথে তেমন কোন মিল নেই । আসলে সরকারের পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা প্রদান পদ্ধতি সিরিয়াসলি আমলে নেয়া উচিৎ। বাংলাদেশে নিয়মিত হাড়ে বেড়ে চলেছে প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যা অধিকাংশই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে খুলে বসেছে এই সকল প্রতিষ্ঠান । চকচকা ঝকঝকা ক্যাম্পাস দেখে অনেকেই গর্বের সাথে ভর্তি হয় প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কিন্তু গ্রাজুয়েশন শেষে অধিকাংশের ভাগ্যে মেলে না উপযুক্ত চাকরি ।

ক্যাম্পাসের রঙ্গিন লাইফের মধ্যদিয়ে সে যেই স্বপ্ন দেখেছিলো বাস্তবে শিক্ষা জীবন শেষে তার সামনে একরাশ হতাশা ছাড়া আর কিছুই থাকে না । অনেক ওয়েল ড্রেসড হয়ে থাকা সিএসইতে সেই ছেলে বা মেয়েটিকেই যৎসামান্য সেলারির বিনিময়ে করতে হয় মার্কেটিং এর জব । এমন হাজার উদাহরণ দেয়া যায় যে, চাকরি করছে যেই সেক্টরে তার সাথে সে যে সাব্জেক্টে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে তার কোন সম্পর্কই নেই । আর অধিকাংশ ভালো চাকরির একটি প্রাইমারি ডিমান্ড হচ্ছে অভিজ্ঞতা ।

চাকরিতে সবাই যদি অভিজ্ঞতা চায় তাহলে ফ্রেশারদের অভিজ্ঞতা হবে কিভাবে? তারা কোথা থেকে জব ফিল্ডের অভিজ্ঞতা পাবে? একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষা জীবনে যে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন করে বাস্তবে তা কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে তা শিখিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আসলে কার?

দায়িত্ব নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে । বাবা মায়ের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে আমরা যে শিক্ষা অর্জন করছি তা আমাকে কতটুকু উপার্জনক্ষম করে তুলছে? উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমরা আসলেই কি দেশের উৎপাদনে অংশগ্রহন করতে পারব তা ভাবতে হবে। ট্রেন্ড এর স্রোতে গা ভাসিয়ে লাখ লাখ টাকা অপচয় করে আমি যে শিক্ষা অর্জন করছি তা কি আমাকে শুধুই একটা সার্টিফিকেট দিবে নাকি আমাকে আমার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যে প্রস্তুত করে তুলবে ?


সর্বশেষ সংবাদ