০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:২৮

কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়: হাওর জনপদের উচ্চশিক্ষায় নতুন প্রভাত

লেখক জামিন মিয়া ও কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো  © টিডিসি সম্পাদিত

উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতি বিজড়িত কিশোরগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ। প্রতাপশালী বারো ভূঁইয়ার ঈশাখার অস্থায়ী বা দ্বিতীয় রাজধানী ছিলো এই কিশোরগঞ্জেই। ১৩ উপজেলা নিয়ে গঠিত এই জেলার বড় একটি অংশ হাওরাঞ্চল দ্বারা পরিবেষ্টিত। হাওরভিত্তিক এ অঞ্চলের মানুষ বহুদিন ধরেই উচ্চশিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। অবশ্য অলওয়েদার সড়ক নির্মাণ হাওরবাসীর দুর্দশা কিছুটা হলেও লাগব করেছে। এতে হাওরের সম্ভাবনাময় খাত (যেমন পর্যটন ও মৎস্য খাত) কেবল কিশোরগঞ্জ নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশে শিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়নের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

তারই ধারাবাহিকতায় কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন প্রণয়ন করা হয় ২০২০ সালে কিন্তু কার্যক্রম শুরু হয় ২০২২ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়টি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলাই ইউনিয়নে স্থাপিত হচ্ছে। ক্যাম্পাসটি প্রায় ১০৩.৮৭ একর ভূমি বিশিষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ছয়টি অনুষদ রয়েছে। এগুলো হলো- কলা অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ, জীববিজ্ঞান অনুষদ, প্রকৌশল অনুষদ, ভূগোল ও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা (প্রস্তাবিত)।

বর্তমান চাহিদা বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ইনস্টিটিউট সমূহ হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়করণে বুদ্ধিমান ব্যবস্থা ইনস্টিটিউট, তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট। আধুনিক যুগের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করার জন্য কিছু সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এগুলো হলো দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া অধ্যয়ন কেন্দ্র, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র, ন্যানোবিজ্ঞান ও প্রকৌশল কেন্দ্র, বায়োসিস্টেম বিজ্ঞান ও প্রকৌশল কেন্দ্র, যোগাযোগ, নেটওয়ার্কিং, সিগন্যাল ও ইমেজ প্রসেসিং কেন্দ্র, অবকাঠামো, টেকসই পরিবহন ও নগর পরিকল্পনা কেন্দ্র,আন্তঃবিষয়ক গণিত বিজ্ঞান কেন্দ্র, সমাজ ও নীতি কেন্দ্র, জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্র।

হাওর অঞ্চল একসময় অবহেলিত জনপদ ছিলো। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে যাতায়াত করা বেশ অসুবিধাজনক ছিলো। এছাড়া নানা কারণে হাওরের মানুষের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই কম। শত প্রতিকূলতা কাটিয়ে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা ছাড়াও অন্য বিভাগীয় শহরেগুলোতে যাওয়া একদিকে যেমন ছিলো ব্যয়বহুল, অন্যদিকে কষ্টসাধ্যও বটে। কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা নিজ এলাকায় থেকেই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন। 

হাওরাঞ্চল কৃষি, মৎস্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি, মৎস্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করা গেলে হাওরের সম্পদকে আরও টেকসইভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে ধান উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ এবং জলাবদ্ধতা মোকাবিলায় কার্যকর গবেষণা হাওরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করবে। হাওরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার সুযোগ তৈরি হবে।

আমি মনে করি, এখানকার লোকসংগীত, কবিতা, খাদ্য সংস্কৃতি এবং লোকজ জ্ঞান সংরক্ষণ করলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ হবে। সর্বোপরি এতে হাওরের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। তাই বলা যায় কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় অদূর ভবিষ্যতে হাওরের জনপদের জন্য সম্ভাবনার এক নতুন দ্বার খুলতে যাচ্ছে। 

আরও পড়ুন: পাবিপ্রবিতে দুই শিক্ষার্থীকে র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ সিনিয়রদের বিরুদ্ধে

কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ও বুদ্ধিজ স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার বড়ুয়া। এই বিভাগটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের অধীনে এবং আমি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ছাত্র (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ) ছিলাম। সে সুবাদে উপাচার্য মহোদয় সম্পর্কে কিছু তথ্য ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সময়ে জেনেছিলাম। 

যাহোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীদের সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে, শিক্ষার্থীদের সাথে উপাচার্যের এক আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠেছে যা বর্তমান সময়ে খুবই বিরল। তাই তারা এমন উপাচার্যকে পেয়ে বেশ খুশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় সমস্যা হলো ভূমি অধিগ্রহণ। উপাচার্য মহোদয়ের সুদক্ষ নেতৃত্বের কারণে তা আজ বাস্তবায়ন হওয়ার পথে। কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় একটি নবীন বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠু পরিচালনার নিমিত্তে কোনো নীতিমালা ছিলো না। ইতোমধ্যে উপাচার্যের একান্ত উদ্যাগে অনেক বিধি-সংবিধি প্রণয়ন হয়েছে এবং সম্পূর্ণ সংবিধি প্রণয়নের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। 

শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় তিনি উদ্যোগে গ্রহণ করেছেন। শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমকে স্বচ্ছতার নিমিত্তে উপাচার্য ডি-নথি চালু করতে যাচ্ছেন। কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো আবাসিক হল ছিল না। ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য ১টি করে হলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুনেছি, মানবতাবাদী শিক্ষক অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার বড়ুয়া কিশোরগঞ্জের মানুষের জন্য ব্লাড ব্যাংক ও অক্সিজেন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন।

আরও পড়ুন: বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শীতের আমেজ

উপাচার্য মহোদয়ের নিরলস পরিশ্রম সার্থক হোক- আমরা এই কামনা করি। কিশোরগঞ্জবাসীর প্রতি আমার আহবান থাকবে, আপনারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে যথাযথ সহায়তা করুন। তাহলে উপাচার্য মহোদয় কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যে স্বপ্ন বুনছেন, তা সহজেই বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হবেন। কেননা দ্রুত স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়টির অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত হবে।

দেখতে দেখতে কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় ৫ বছর পাড়ি দিয়েছে। আমার প্রত্যাশা বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন জ্ঞান সৃজন ও মুক্তবুদ্ধির চারণভূমিতে পরিণত হয়। কেবল ভালো ছাত্র নয়, ভালো মানুষ হওয়া- এটিই হোক আমাদের আজকের স্লোগান। নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত এই বিদ্যাপীঠ দক্ষতা ও জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র হয়ে উঠুক- এই কামনা করছি।

লেখক: গবেষণা সহযোগী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।