০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০:১৫

একদিন মবই বাংলাদেশকে গিলে খাবে, তখনও কি নীরব থাকবেন?

শরিফুল হাসান  © টিডিসি সম্পাদিত

একটা দেশের মানুষ কতোটা বর্বর হলে কবর থেকে লাশ তুলে মহাসড়কে নিয়ে আগুন দেয়? পৃথিবীর আর কোথায় এই ২০২৫ সালে এমন ঘটনা ঘটে? মাঝেমধ্যে স্তব্ধ হয়ে যাই! আমাদের চেয়ে বর্বর আর কোন জাতি আছে কি এখন এই পৃথিবীতে? আচ্ছা, একটা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতোটা খারাপ হলে দিনের পর দিন দরবার শরিফে হামলা হয়? কতোটা খারাপ হলে কবর থেকে লাশ তুলে আগুন দেওয়ার সাহস পায় জনতা? রাজবাড়ীর এই ঘটনায় কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোন দায় নেই? এই যে দিনের পর দিন যখন মাজারে হামলা হয়েছে, কোথায় ছিল সরকার? একটা ঘটনাতেও কি কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?

খেয়াল করুন, রাজবাড়ীর নির্মম ঘটনার পর নিন্দা জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সেই পুরোনো বিবৃতি, ‘এ ধরনের বর্বরতা কোনো অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না!’ অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারের জন্য আমার এখন করুণা হয়। কারণ, আপনারা এক বছর ধরে এসব ঘটনা শুধু সহ্য করছেন তাই নয়, আপনার উৎসাহ বা নির্লিপ্ততায় গত এক বছর ধরে মব হামলার অপসংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আর আপনি নিন্দা জানিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন—কোনো ব্যবস্থা নেননি।

গত এক বছরে অনেকবার সরকারের উদ্দেশ্যে লিখেছি, ফেসবুকে বা প্রেস রিলিজ দিয়ে নিন্দা জানানো এনজিও বা সিভিল সোসাইটির কাজ, রাষ্ট্র বা সরকারের না। রাষ্ট্র ও সরকারের কাজ যে কোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেই কাজে ব্যর্থ হয়ে ঘটনার পর নিন্দা বিবৃতি দেওয়া, একেক ঘটনার ওপর একেক আচরণ—এ শুধু ব্যর্থতা নয়, সংবিধান, আইন ও দায়িত্বের লঙ্ঘন।

আরও পড়ুন: মাজার ভাঙা থেকে লাশ পোড়ানো, কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ?

দেখুন, আজীবন এই মবের বিরুদ্ধে বলেছি। গত এক বছরে বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। ঘরে, বাইরে, অফিসে, আদালতে, স্কুল-কলেজে—সর্বত্র এই মব দেখবেন। এই মব একদিন বাংলাদেশ গিলে খাবে! এই দেশের নানা পদে যারা আছেন, আপনাদের দোহাই—দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করুন! আর না পারলে বিদায় নিন। কিন্তু দয়া করে বাংলাদেশটাকে ধ্বংস করবেন না! এই মবকে আর প্রশ্রয় দেবেন না। আল্লাহ আপনাদের বোধ দিন! বোধ দিন এই দেশের প্রতিটি মানুষকে! বিবেক ও মানবতার বোধ ছাড়া এই দেশকে বাঁচানোর আর কোন পথ নেই!

০২

‘আমার ছেলে তো কোনো দোষ করেনি। সে কেবল নুরুল হকের ভক্ত ছিল। দরবারে থাকায় ওরা আমার ছেলেকে মেরে ফেলল। ওরা আমার ছেলেকে হাসপাতালে নিতে দেয়নি। হাসপাতালে নেওয়ার জন্য গাড়িতে তোলা হলে গাড়ি থেকে নামিয়ে আবার পিটিয়ে হত্যা করেছে। আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম।’

বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দরবার শরিফে হামলায় নিহত রাসেল মোল্লার মা আমেনা বেগম। নিহত রাসেল মোল্লা (৩০) পেশায় ট্রাকচালক ছিলেন। নুরাল পাগলার ভক্ত হিসেবে তাকে সবাই চিনতেন। পাঁচ বছর আগে তিনি হাসি আক্তারকে বিয়ে করেন। তাদের চার বছরের এক মেয়ে ও দুই বছরের এক ছেলে রয়েছে। এখন তাঁর দুই সন্তান এতিম।

দরবারে হামলার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাসেলের ছোট ভাই সাজ্জাদ মোল্লা (২২)। তিনিও গুরুতর আহত হয়েছেন। হামলা থেকে বাঁচতে তিনি দরবারের তিনতলা ভবনের ছাদ থেকে লাফ দেন। এতে তার বাঁ পায়ের গোড়ালি ভেঙে যায়।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাজ্জাদ মোল্লা সেই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘হামলাকারীরা যখন ভাঙচুর ও লুটপাট চালাচ্ছিল, আমি বাধা দিতে গিয়েছিলাম। তখন তাদের ওপর হামলা করা হয়। চাপাতির কোপ ঠেকাতে গিয়ে আমার ডান হাতে গভীর ক্ষত হয়েছে। একপর্যায়ে হামলাকারীরা ভবনে আগুন ধরিয়ে দিলে আমি প্রাণ বাঁচাতে ছাদ থেকে লাফ দিয়েছি।’

কথাগুলো পড়তে পড়তে ভাবি, এই দেশের মানুষ কী বর্বর! আচ্ছা, একটা দেশের মানুষ কতটা বর্বর হলে কবর থেকে লাশ তুলে মহাসড়কে নিয়ে আগুন দেয়? কতটা বর্বর হলে কুপিয়ে মানুষ হত্যা করে? রাসেলকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হলো—এর কোন বিচার হবে কি?

‘দেখুন, গোটা পৃথিবীর বিনিময়ে একজন মানুষের জীবন পাওয়া যায় না। সব ধর্মে মানুষ হত্যা নিষিদ্ধ। ইসলামে সব রকম হত্যা, রক্তপাত, অরাজকতা, সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন, ‘কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারও প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সমস্ত মানুষের প্রাণরক্ষা করল (সুরা মাইদা, ৩২)।’

আসলে সব ধর্মের মূল কথা এমনি। রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান কাজ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া। অথচ সরকার মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারছে না। বরং সরকারের উৎসাহ বা নির্লিপ্ততায় এইসব হত্যার ঘটনা ঘটছে। কোন বিচার হচ্ছে না। এর থেকে পরিত্রাণ জরুরি। আচ্ছা, আর কত মানুষ মরলে আমাদের হুশ হবে?

বর্তমান সরকার নিন্দা জানানো ছাড়া আর তো কিছু করতে পারে না, পারবেও না  মনে হয়। দেশের প্রত্যেক মানুষের কাছে করজোড়ে আহ্বান—চলুন সব ধরনের মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে সরব হই! এই দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচাই। আল্লাহ আমাদের বিবেকবোধ দিন! এই দেশটাকে রক্ষা করুন!


শরিফুল হাসান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক