যুক্তরাষ্ট্রের মুখে মানবাধিকার ও বাস্তবতা
- মো. মোফাজ্জল হক
- প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ০৫:২৮ PM , আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫, ০৫:২৮ PM

‘বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন’ প্রকাশকারী পরাশক্তির দেশ যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের চোখে রঙিন চশমা লাগিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকারের অস্তিত্ব খুঁজে নিজেদের স্বচ্ছতা জানান দিতে চায়। নিজেদের স্বার্থ আর মতের অমিল হলেই নিষেধাজ্ঞা দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাদের মুখে মানবাধিকারের বুলি ফোটালেও বাস্তবতায় তা কতটা কার্যকর তা বিশ্ববাসী কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পেরেছে। নিজেদেরকে মানবাধিকার রক্ষক দাবিদার যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই আজ ফিলিস্তিনে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে।
এরাই ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের পেটে জোরপূর্বক ইউরোপ থেকে নিয়ে আসা ধর্মান্ধ জায়নবাদী ইহুদিদের জন্য ইসরায়েল নামক একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করার পর সেই অঞ্চলে বিরামহীনভাবে গণহত্যা আর তার আদি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ চালিয়ে আসছে। মানবতার তকমা সর্বজনীন নাকি দেশ কাল পাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে তা এখন সর্বমহলে প্রশ্ন উঠেছে। যেখানে স্বার্থের জয় সেখানেই বসন্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্র মুখে মানবাধিকারের কথা বললেও কাজে কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ হত্যার পেছনে যাদের সমর্থন থাকে তারাই আবার পৃথিবীতে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মুখে মুখে বুলি ফোটায়। এমনকি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গণহত্যার দায়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে একটি প্রতীকী বিলে গত বছরের ৪ জুন ভোট দিয়েছেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা। আইসিসি কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া, তাদের ভিসা বাতিল করা এবং যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সম্পদ হস্তান্তরে বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা বলা হয়েছে। নেতানিয়াহু ও তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করার পর হোয়াইট হাউস থেকে আইসিসির সমালোচনা করা হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বাইডেন ওই আবেদনকে ‘আপত্তিকর’ বলেছেন। নিজের মিত্রকে সমর্থন দিতে স্বাধীন বিচার বিভাগকেও নিষেধাজ্ঞা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না তারা। মার্কিনিদের এরকম দ্বিমুখী নীতিতে মানবাধিকারের সর্বজনীনতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে মানবাধিকার রক্ষার উদ্ধারকর্তা হিসেবে দাবি করে সেই যুক্তরাষ্ট্রেই আর্থিক দুর্নীতি, বর্ণবৈষম্য, অস্ত্র এবং পুলিশি সহিংসতাসহ সম্পদ কুক্ষিগত করার ঘটনা অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্দুক নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেকের বেশি স্টেটে শৈথিল্য অবলম্বন করা হয়। বিশ্বে বন্দুকের মালিকানা, বন্দুককেন্দ্রিক হত্যাকাণ্ড এবং এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যার ঘটনার দিক দিয়েও যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে অবস্থান করছে।
চীনের স্টেট কাউন্সিল ইনফরমেশন অফিস এর তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে এসব ঘটনায় ৮০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ঐ বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০টির বেশি ‘ম্যাস শুটিং’ এর ঘটনা ঘটেছে। বন্দুককেন্দ্রিক সহিংসতা ‘যুক্তরাষ্ট্রের মহামারি’তে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বাড়ছে এবং জাতিগত সংখ্যালঘুরা সেখানে ব্যাপকভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ২০২০ থেকে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে হিংসাত্মক অপরাধ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাফেলো সুপারমার্কেটে ১০ জন আফ্রিকান-আমেরিকানের বর্ণবাদী গণহত্যা বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে, ১৮ বছরের কম বয়সি ৫৮০০টিরও বেশি শিশুকে গুলি করে আহত বা হত্যা করা হয়েছে এবং স্কুলে গুলি চালানোর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০২টিতে। এ সংখ্যা ছিল ১৯৭০ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ।
গুয়ানতানামো কারাগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। এই কারাগারে বন্দীদের বিনা বিচারে আটক রাখা হয় এবং তথ্য আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে বন্দীদের ওপর যৌন অত্যাচার, ওয়াটার বোর্ডিং-সহ বিবিধ আইনবহির্ভূত উপায়ে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের প্রকার ও মাত্রা এতই বেশি যে এই কারাগারকে ‘মর্ত্যের নরক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই কারাগারটিকে অব্যাহতভাবে নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করতে থাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে একে মার্কিনিদের ‘লজ্জা’ হিসাবে অভিহিত করা হয়।
শুধু তাই না, মোবারক নামের এক বাংলাদেশের নাগরিককে পাক-আফগান সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা থেকে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই অক্টোবর তারিখে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে গুয়ানতানামো কারাগারে আটক রাখা হয়। তাকে কোনরূপ বিচার ব্যতিরেকে ২০০৬ সালের ১৫ই ডিসেম্বর তারিখ অবধি সেখানে তাকে আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ দমনের নামে বিভিন্ন স্বাধীন দেশের উপর ও সাঁড়াশি অভিযান আক্রমণ চালানো হয়েছে। আফগানকে ২০ বছর জিম্মি করে রেখেছে এবং ইরাকে ব্যাপক মানববিধ্বংসী অস্ত্রের অভিযোগ এনে সাদ্দাম হুসাইনকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে অথচ মানবতার সবচেয়ে বিপজ্জনক বিধ্বংস অস্ত্র এই মার্কিনরাই সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় এবং ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট নাগাসিকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে একটা জাতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে যার করুণ ফলাফল জাপানিরা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পুলিশের উপর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসছে। অথচ বিভিন্ন সময় লক্ষ্য করা যায় মার্কিন পুলিশ কর্তৃক ও মানবাধিকার লঙ্গন এর ঘটনা ঘটছে। ২০২০ সালের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস শহরে জর্জ ফ্লয়েড নামের ৪৬ বছর বয়সী একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানকে অবৈধ মুদ্রা রাখার দায়ে গ্রেফতার হওয়ার সময় নিহত হন। গ্রেফতারের সময় হাতকড়া পরিয়ে শোয়ানো অবস্থায় ডেরেক চাউভিন নামের এক পুলিশ কর্মকর্তা ফ্লয়েডের ঘাড়ে প্রায় ৯ মিনিট ৩০ সেকেন্ড হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক এরকম ঘটনা ইতিহাসের লজ্জাজনক ।
গত ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে দুর্বৃত্তের গুলিতে আবির হোসেন (৩৮) নামে বাংলাদেশি এক যুবককে হত্যা করা হয়েছে। নিহত আবীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক শিক্ষার্থী। তিনি পিএইচডি করতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন।
যেই যুক্তরাষ্ট্র গণমাধ্যমকর্মীদের মানবাধিকার রক্ষায় সহানুভূতি দেখায় তারাই কিছুদিন আগে গাজায় ইসরায়েলি অভিযান ও গণহত্যা নিয়ে সাংবাদিকতায় ‘সাহসী’ ভূমিকা পালন করার জন্য মার্কিন সাংবাদিকদের সংগঠন আইউব্লিউএমএফ থেকে পুরস্কৃত হয়েছিলেন ফিলিস্তিনি নারী সাংবাদিক মাহা হুসেনি। কিন্তু কয়েকদিন পরেই পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মাহার করা প্রতিবেদনগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন আদালতে মামলা করার সময়ে ব্যবহার করেছিল দক্ষিণ কোরিয়া।
গাজা গণহত্যার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করার প্রস্তাব দেয়ায় এক মার্কিন অধ্যাপককে বরখাস্ত করার ঘটনা ঘটেছে। ওই অধ্যাপক আমেরিকার শিকাগো অঙ্গরাজ্যের ডি পল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করতেন। তিনি ছাত্রদেরকে একটি ঐচ্ছিক অ্যাসাইনমেন্ট করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে অ্যাসাইনমেন্টের বিষয় ছিল, ‘গাজায় চলমান ইসরায়েলি গণহত্যার প্রভাব’। বরখাস্ত হওয়া ওই অধ্যাপকের নাম অ্যান ডি'অ্যাকুইনো। তাকে গত বছরের জুন মাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিভাগে পড়াতে নিষেধ করা হয়।
নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার আমেরিকা কতটা ধর্মবিদ্বেষী তা এখন স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার। ড. আফিয়া সিদ্দিকী যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিখ্যাত একজন মুসলিম স্নায়ুবিজ্ঞানী। পিএইচডি ডিগ্রি ধারী এই মহিলাকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ২০০৩ সালে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় আল কায়েদার সাথে যোগাযোগ থাকার অভিযোগে পাকিস্তানের করাচির রাস্তা থেকে তার তিন সন্তানসহ গ্রেফতার করে। পরে প্রচলিত আইনের আওতায় না এনে পাকিস্তানের কারাগারে গ্রেফতার না রেখেই তাকে আফগানিস্তানের সামরিক ঘাঁটিতে ৫ বছর বন্দি করে রাখা হয়। মার্কিন আদালত তাকে ৮৬ বছর কারাদণ্ড দেয়। বন্দি অবস্থায় তার ওপর ব্যাপক অমানবিক নির্যাতন করা হয়।
বাগরাম কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিরা অভিযোগ করেছে “নির্যাতনের সময়ে আফিয়ার আর্ত-চিৎকার অন্য বন্দির পক্ষে সহ্য করাও কঠিন ছিল।” ওই নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধ করার জন্য অন্য বন্দিরা অনশন পর্যন্ত করেছিলো। তাকে মানসিক, যৌন ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হত এবং তাকে দিনের মধ্য কয়েকবার করে ধর্ষণ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়। ২০০৮ সালে তাকে স্থানান্তর করা হয় নিউইয়র্কের এক গোপন কারাগারে। বর্তমানে তিনি পুরুষদের সাথে ওই কারাগারে বন্দি। কারাবন্দি নম্বর ৬৫০। চলমান নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। বিশ্ব জুড়ে সব জায়গাতেই অভিযুক্তরা “বেনিফিট অব ডাউট” বা সন্দেহাতীতভাবে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগে পর্যন্ত নির্দোষ বলে বিবেচিত হয়। ফলে সকল সুবিধা পায়। কিন্তু ড. আফিয়া তা পাননি বরং নির্যাতনের শিকার হন। তার ওপর অমানবিক নির্যাতনের বিষয়টি আলোচিত হয় কারাগার থেকে তার বহুল আলোচিত চিঠিটি লেখার পর। চিঠিটিতে আফিয়া দাবি করেন তার ওপর শারীরিক, পাশবিক নির্যাতনের পাশাপাশি একের পর এক ধর্ষণ করা হয়। তার একটি কিডনিও বের করে ফেলা হয়েছিলো ফলে তিনি হাঁটতে পারতেন না। একজন নারীর সাথে এমন আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারকে কলুষিত করেছে।
এমনকি ইসরায়েল যখন ফিলিস্তিনে সন্ত্রাসী হামলা চালায় তখন পশ্চিমারা এটার নাম দেয় আত্মরক্ষা। আর হামাস যখন প্রতিহত করে তখন সেটার নাম হয় সন্ত্রাসী জঙ্গি হামলা। এটাই তাদের মানবতা আর মানবাধিকারের ভুলি। ২০০৮, ২০১২, ২০১৪, ২০২১ ও ২০২২ সালেও পশ্চিমা মদদপুষ্ট ইসরায়েলিদের বর্বরোচিত ভয়াবহ হামলার শিকার হয়েছে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার হতভাগ্য মানুষ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আদালত এবং জাতিসংঘের সভায় যখন যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো তখন মানবতাকে কলঙ্কিত করছে। তখন নিষেধাজ্ঞা আর মানবাধিকার যেন মার্কিনিদের লালফিতার ফাইলে আটকা পড়ে গেছে। মানবতা এ যেন দেশকাল পাত্রভেদে স্বার্থের জয়গান গাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারের এরকম দ্বিমুখী আচরণে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে মানবাধিকার সর্বজনীন নাকি জিওপলিটিক্স।