ধূমপান ও মাদকের পরিণতি: মুক্তির উপায়

‘ফায়ারফ্লাই’ ক্যাম্পেইনের লোগো
‘ফায়ারফ্লাই’ ক্যাম্পেইনের লোগো  © সৌজন্যে প্রাপ্ত

‘সময়ের সাহসী যোদ্ধারা জেগে উঠো, সময় হয়েছে,
ছাড়ো নেশা, ধরো কলম, সুসভ্য সমাজ বিকাশে।’

ভূমিকা:
সুসভ্য সমাজ ব্যবস্থায় সকলেই বসবাস করতে চায়। সুন্দরের প্রত্যাশীরা সবসময় সুন্দরকেই আহ্বান করে, সত্যকেই সংকল্প করে, পবিত্রতাকেই ধারণ করে। আন্তরিকতা, কৃতজ্ঞতা, সম্মান, ধন্যবাদ সুসভ্য সমাজেরই অনন্য উপাদান। একটা সুন্দর পরিকল্পনা নিয়েই পৃথিবীতে সকলের জন্ম। সম্মান নিয়ে আপন ভুবনে আলোকিত হয়ে, থাকতে চাওয়ার স্বপ্ন প্রায় প্রত্যেকের মাঝেই দেখতে পাওয়া যায়। এই স্বপ্ন, সাথে আবেগ মানুষকে নিয়ে যায়, দূরে বহুদূরে। আবেগ আছে বলেই মানুষ এত সৃজনশীল। আবেগ আছে বলেই মানুষের এত প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির হিসাব।

মানুষের এই প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির ভারসাম্যের মধ্যে যখনই অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়, ঠিক তখনই এক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। যার ফলশ্রুতিতে প্রথমে পরিবার, পরে সমাজ এবং রাষ্ট্রে এর প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হয়। বর্তমান সময়ে ধূমপান ও মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার সেই বিশৃঙ্খলার প্রধান অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধূমপান ও মাদক আন্তর্জাতিক আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। কেননা ধূমপান ও মাদকের প্রতি আসক্তি তড়িৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র যন্ত্র।

দৃষ্টি আকর্ষণ: 
নিবন্ধটির শিরোনাম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ধূমপান ও মাদকের পরিণতি: মুক্তির উপায়’। লক্ষণীয় যে, নির্ধারিত শিরোনামে দুটো অংশ রয়েছে। প্রথম অংশটুকু হচ্ছে, ‘ধূমপান ও মাদকের পরিণতি’ এবং দ্বিতীয় অংশটুকু হচ্ছে, ‘মুক্তির উপায়।’ নির্ধারিত বিষয়টিকে তথ্য উপাত্তের বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে প্রাধান্য দিয়ে বৈশ্বিক এই সমস্যাটি উপস্থাপনের প্রয়াসে...

ধূমপান ও মাদকদ্রব্যের ধারণা:
মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত হওয়ার জন্য ‘ধূমপান’ সূচনা হিসেবে কাজ করে। সিগারেটে রয়েছে নিকোটিন যা চরম আসক্তিকর মাদক এবং নেশার জগতে বিচরণ করার জন্য আগ্রহী করে তুলে প্রত্যেক ধূমপায়ীকে। এই ধূমপান তথা নিকোটিনের, প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পরবর্তী সময়ে মদ, ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, তামাক, জর্দা, পেথিডিন, হেরোইন, কোডিন, আফিম, মরফিন, বুপ্রেনরফিন, ডান্ডি, ট্রাংকুলাইজার প্রভৃতি মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমান সময়ে প্রত্যেক সমাজ ব্যবস্থায় এই চিত্রটি লক্ষণীয়।

ধূমপান ও মাদকাসক্তির কারণ: 
দর্শন শাস্ত্রের ভাষায়, প্রতিটি কার্যেরই সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ থাকে। ধূমপান এবং মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত হওয়ার পেছনেও রয়েছে সুনির্দিষ্ট কারণ। ধূমপান ও মাদকাসক্তির কারণগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হলো-

ক) হতাশা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং সামাজিক উৎসবে অতি উৎসুকতা:
নেতিবাচক ও ইতিবাচক আবেগ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মাদকাসক্তির কারণ হিসেবে চিহ্নিত। নেতিবাচক আবেগ যেমন- হতাশা, বিষণœতা, একঘেয়েমি লাগা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, রাগ-অভিমান, ক্ষোভ প্রভৃতি অনুভূতি নেশার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে ইতিবাচক আবেগ যেমন- আনন্দ-উদ্‌যাপন, জন্মদিন, নববর্ষ, বনভোজন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ঈদ-পূজা, উৎসব প্রভৃতি আনন্দ উল্লাসের সময় মাদক গ্রহণ করে সেই আনন্দের তুঙ্গে উঠতে চায়। ফলে দেখা যাচ্ছে, নেতিবাচক ও ইতিবাচক এই উভয় ধরনের আবেগ মাদকাসক্তির কারণ হিসেবে অন্যতম।

খ) সঙ্গদোষ:
সঙ্গ নিয়ে দুটো বিখ্যাত প্রবাদ বাক্য রয়েছে। এর মধ্যে একটি,“সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ” অন্যটি “সঙ্গদোষে লোহাও ভাসে”। ভালো বন্ধুদের সঙ্গ যেমন জীবনকে পরিপূর্ণ করতে সহায়তা করে, তেমনি খারাপ সঙ্গ জীবনকে ধ্বংসের পথে ধাবিত করে। নেশাযুক্ত বন্ধুদের সঙ্গ নেশামুক্ত বন্ধুটিকে নেশাযুক্ত করতে বাধ্য করে। আর এই সঙ্গদোষের কারণে মাদকাসক্তি এবং এর কু-প্রভাব দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়ে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে।

গ) ভৌগোলিক অনুকূলতা:
মাদকদ্রব্যের জোগান তখনই বৃদ্ধি পায়, যখন ভৌগোলিক অনুকূলতা বিরাজ করে। ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে অনুক‚লতার সুযোগে মাদকদ্রব্যের বিচরণে মাদকাসক্তির সংখ্যা রাতারাতি বাড়ছে। ভৌগোলিক কারণে মাদক পাচারকারী চক্র বাংলাদেশকে মাদকদ্রব্য চোরাচালানের করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

আরও পড়ুন: তরুণদের হতাশার বৃত্ত ভাঙ্গবে কী?

বিশ্বের প্রধান মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলো গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজ বাংলাদেশের পাশে অবস্থান করছে এবং বাংলাদেশে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকায় আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাচালানকারীরা এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে মাদকাসক্তি পোক্তভাবে জেঁকে বসেছে।

ঘ) মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা:
মাদকাসক্তির অন্যতম প্রধান কারণ, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা। মাদকদ্রব্যের জোগান এখন হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় চাল, তেল, সাবানের মতো। তাছাড়া মাদকদ্রব্যের সরবরাহকারীরা বিভিন্ন কৌশলে সাধারণ মানুষদেরকে আকৃষ্ট করছে। তাদের এই ফাঁদে পা বাড়াচ্ছে সমাজের বৃহৎ শক্তি, তরুণ সমাজ। 

ঙ) রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা:
ক্ষমতা হল রাষ্ট্রের প্রাণ। ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করার জন্য এবং দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে। এই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যখন আদর্শগত মত পার্থক্য দেখা দেয় তখনই দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক এই অস্থিতিশীল পরিবেশের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত হয়। এর মধ্যে মাদকদ্রব্যের চোরাচালান সংক্রান্ত অপরাধসমূহ উল্লেখযোগ্য। আর মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়ি মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ।

চ) অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থানের অভাব:
“অর্থই অনর্থের মূল” প্রবাদ বাক্যটি সবসময় পরিষ্কার, পরীক্ষিত সত্য। অর্থনৈতিক মুক্তিই, মানবমুক্তি। অর্থনৈতিক মুক্তি লাভের আশায়, মানুষ ঘর থেকে পা বাড়ায় দূরদূরান্তে। অর্থনৈতিক মুক্তি যারা পায় তারা তো পেলোই। আর যারা পায়না, তারা একরাশ হতাশা নিয়ে ঘরে ফিরে আসে।

এই হতাশা, বেকারত্ব গ্রাস করে তাদের মনোজগত। হতাশা বেকারত্বে করুণ দিনগুলোতে কালো বন্ধু হয়ে কাছে আসে ধূমপান ও মাদকদ্রব্য। এর ফলে ঐ হতাশাগ্রস্ত মানুষরা মাদকাসক্তির আচ্ছাদনে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারত্বের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বেকারত্ব মানে হতাশা, অলসতা। আর হতাশা, অলসতা উভয়ই মাদকাসক্তি কারণ।

ছ) পারিবারিক মূল্যবোধের যথাযথ অভাব:
ছোটকালে আমরা পড়েছি ‘পরিবার শাশ্বত বিদ্যালয়’। পরিবার থেকেই আমরা শিক্ষা, সংস্কৃতি, নৈতিকতা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, পারস্পরিক সম্পর্ক মূল্যায়ন, মূল্যবোধ শিখি। পরিবারের বড় কেউ যদি ধূমপান ও অন্যান্য মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয় তবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আসক্ত হওয়ার উৎসাহ পায়। তাই পারিবারিক মূল্যবোধের এই যথাযথ অভাব মাদকাসক্তির অনন্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত। 

জ) আইনের উদাসীনতা:
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইন বলবৎ রয়েছে। বাংলাদেশের আইনি কাঠামোয় এই আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগে দেখা যায় উদাসীনতা। ফলে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারের সাথে জড়িত অপরাধীরা বিভিন্ন ফাঁক ফোকরে বেরিয়ে গিয়ে তাদের অপরাধ পুনরায় সংগঠিত করছে। আইনের উদাসীনতা মাদকাসক্তের অন্যতম প্রধান কারণ। 

ঝ) সুশিক্ষার অনগ্রসরতা:
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার হালচাল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, শিক্ষার হার বাড়ছে ঠিকই কিন্তু সুশিক্ষার অগ্রসরতা ব্যাপক হারে লোপ পাচ্ছে। সুশিক্ষা মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করে, নৈতিকতা জাগ্রত করে। সুশিক্ষার এই মূল্যবোধ ও নৈতিকতা দ্বারা মানুষ “প্রকৃত মানুষ” হয়ে রূপান্তরিত হয়। সুশিক্ষার অনগ্রসরতার ফলে পরোক্ষভাবে মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ায়। কেননা সঠিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষ সর্বনিম্নে যেতেও পেছনে ফিরে তাকায় না।

ঞ) বিশ্বায়ন:
বিশ্বের এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের পারস্পরিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সম্পর্কের মেলবন্ধনের মাধ্যমে ‘বিশ্বায়ন’ ধারণাটি বর্তমান সময়ে আলোচিত। এর একদিকে যেমন রয়েছে সু-প্রভাব, ঠিক অপরদিকে রয়েছে কু-প্রভাব। বিশ্বায়নের কু-প্রভাবের দরুন মাদকদ্রব্যের বিস্তার হচ্ছে বড় পরিসরে। এর কারণে মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে।

উপরিউক্ত কারণগুলো ছাড়াও মাদকাসক্তির পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো- বৈষম্য, দরিদ্রতা, শিক্ষা জীবনের অনিশ্চয়তা, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, প্রেমঘটিত ব্যাপার, সেলিব্রেটি আদর্শ অনুসরণ এবং স্মার্টনেস প্রভৃতি।

ধূমপান ও মাদকের পরিণতি:
বিভিন্ন পর্যালোচনা, সমীক্ষা এবং গবেষণায় ধূমপান এবং মাদকের পরিণতি ভয়ানকভাবে প্রতীয়মান। নিচে বিস্তরভাবে ধূমপান ও মাদকের পরিণতি তুলে ধরা হলো-

সাধারণত সিগারেট বা তামাকের মাধ্যমে মাদকাসক্তদের সংখ্যা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। ধূমপানের মাধ্যমে যে ক্ষতির দিকগুলো গবেষণায় উঠে এসেছে সেগুলো হলো-

* সিগারেটে রয়েছে নিকোটিন। যা অত্যন্ত আসক্তিকর। সিগারেটের এই উপাদানটি নেশার

   মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয় তীব্রভাবে।

* একটি সিগারেটে মানুষের ৫.৫ মিনিট আয়ু কমে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।

* একটি সিগারেটের ধোঁয়ায় ১৫ বিলিয়ন পদার্থের অণু থাকে যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর।

* ধূমপান মানুষের হৃদযন্ত্রকে অকেজো করে ফেলে আর শরীরের শক্তিকে দুর্বল করে দেয়।

* ধূমপান থেকেই শুরু হয় অন্যান্য মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি।

* ধূমপান নিজের ক্ষতির সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী লোকেরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

* ধূমপানকারী সম্পদ ধ্বংস করে।

* ধূমপান ক্যান্সার, যক্ষ্মা প্রভৃতির মতো ধ্বংসকারক রোগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ।

* ধূমপানে দাঁতগুলো হলুদ, কালচে হয়ে যায়, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়, স্নায়ুবিক দুর্বলতা দেখা দেয় এবং
   চেহারার লাবণ্য নষ্ট হয়। 

* ধূমপানে কাশি, বক্ষব্যাধির সৃষ্টি হয়, খাবারে অরুচি দেখা যায়, হজমে ব্যাঘাত ঘটে এবং
   রক্ত সঞ্চালনে বাধা প্রাপ্ত হয়।

এছাড়া অন্যান্য মাদক যেমন ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, মদ, ফেনসিডিল, ঘুমের ঔষধ, আফিম, পেথেডিন, মরফিন প্রভৃতি মাদক গ্রহণে কিডনি সমস্যা, যকৃতের তীব্র প্রদাহ, এইডস, হেপাটাইটিস-বি, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, রক্ত দূষণ, প্রজননতন্ত্রের সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভোগেন মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা।

আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে মাদকের প্রভাব:
অর্থনীতিতে প্রত্যেকটি ধারণার সাথে ‘অভাব’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতিনিয়ত প্রতিটি মানুষকে অসংখ্য অভাবের সম্মুখীন হতে হয়। অভাব থাকার কারণে অনেক সময় মানুষ তার ন্যায় অন্যায় একসাথে করে ফেলে। মানুষের এই অভাবের মানসিকতাকে পুঁজি করে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র তাদের দুষ্ট চক্রের ফাঁদে অভাবগ্রস্ত মানুষদের আটকে রাখে।

আরও পড়ুন: চাকরির বাজার নিয়ে তারুণ্যের হতাশার সঙ্গে ছিল ক্ষোভও

এছাড়াও দুর্নীতি; বৈদেশিক মুদ্রা পাচার; চোরাচালান; আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারসাম্যে অসামঞ্জস্যতা; চিকিৎসা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি; আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়াপনা; দারিদ্র্য বিমোচনে অধিক ব্যয়; আইনশৃঙ্খলা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি; আমদানি রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব; মানবসম্পদ উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত; কালো টাকার ছড়াছড়ি; নারী ও শিশু পাচার; জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান; রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মাদকের প্রভাব:
আমরা যা, তাই আমাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতি ব্যক্তি তথা সমাজ, রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি বস্তুকে স্পর্শ করে। যুগে যুগে রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত, শিক্ষাগত, আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়ে থাকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ভূমিকায়। কেননা রাষ্ট্রের যাবতীয় সকল কিছুই সংস্কৃতির অংশ। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মাদকের প্রভাব দেখা যাচ্ছে ভয়ংকরভাবে।

সংস্কৃতির ওপর মাদকের উল্লেখযোগ্য প্রভাব যেমন- অধিকাংশ তরুণ সমাজ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যস্ত না রেখে, ব্যস্ত রাখে নেশায়; কলম না ধরে, হাতে উঠছে অস্ত্র; জাতীয়তা বোধের প্রতি অশ্রদ্ধা; দেশপ্রেমের অভাব; সুস্থ বিনোদনের প্রতি আগ্রহী না হয়ে, আগ্রহী হচ্ছে নোংরা বিনোদনের প্রতি; নোংরা আদর্শ অনুসরণ করা; বিশ্বায়নের আচ্ছাদনে অপসংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক ইত্যাদি মাদকাসক্তির প্রতি ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

মাদক ক্যান্সারের ন্যায় ছড়িয়ে দিচ্ছে তার বিষাক্ত শাখা প্রশাখা। একটি দেশের উন্নয়নের ধারক এবং বাহক সে দেশেরই তরুণ বা যুব সমাজ। উন্নয়নের এই ধারক এবং বাহক তরুণ বা যুব সমাজ বর্তমান সভ্যতায় মাদকের হাতছানি, সন্ত্রাসের কু-কার্যক্রম এবং জঙ্গিবাদের মগজধোলাই নীতির প্ররোচনায় প্রভাবিত হচ্ছে, যা উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ এই তিনটি ধারণা বিকৃত মানিসকতা প্রসূত।

আরও পড়ুন: অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষায় দেশের অর্থ ও মেধার অপচয়

তবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টিতে মাদকাসক্তি সরাসরি উৎসাহিত করছে। বর্তমান সময়ে তরুণদের সুস্থ বিনোদনের অভাব রয়েছে। বিনোদনের বড় একটি অংশ হিসেবে অনেকেই মুঠো ফোন আর ইন্টারনেটকে বেছে নিয়েছে। এটা সুস্পষ্ট যে, ইন্টারনেট আর মুঠো ফোনের ব্যবহার আজ অনেকাংশেই মাদকের সহজ প্রাপ্যতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। যা তরুণ সমাজের সৃজনশীলতাকে ধ্বংস করছে। মাদককে ঘিরে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস, সংঘাত-দ্বন্দ, কলহ, দুর্ঘটনা, আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, ধ্বংস ও মৃত্যুর যে খেলা চলছে, তা প্রমাণিত সত্য।

নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভবান ব্যবসা ও বেশি আলোচিত। ধনী-দরিদ্র, উন্নত-উন্নয়নশীল কোনো দেশই মাদক সন্ত্রাস থেকে মুক্ত নয়। বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভ‚ত উন্নতি সাধিত হওয়ার কারণে মাদকের মারাত্মক ক্ষতি সর্বজন স্বীকৃত। সকল অপকর্ম ও অশ্লীলতার মূলে রয়েছে মাদক, মদ, জুয়া। মাদকাসক্তির প্রসারিত জালে আটকা পড়ছে তরুণদের ভবিষ্যৎ, সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থা, বোধ শক্তি, নৈতিকতা ইত্যাদি। মাদকাসক্তির প্রসারণে সমাজে সৃষ্ট হচ্ছে ভারসাম্যহীনতা। যার ফলশ্রুতিতে ঘটছে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, কুৎসিত দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞান সংকোচন, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারস্পরিক অশ্রদ্ধা, অন্যায় অপরাধসহ নানান অসংগতি।

মুক্তির উপায়:
মাদকাসক্তি, সুস্থ সমাজ ব্যবস্থার অসুস্থ অধ্যায়। এই অসুস্থ অধ্যায়কে সুস্থ করতে হলে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে জোরালোভাবে। মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির জন্য করণীয় দিক সমূহ বিশ্লেষণ করা হলো-

ক) ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা:
প্রত্যেক ধর্মেই সত্য, সুন্দর, পবিত্র হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে মানুষের মনোজগতে ভালো গুণগুলোর উন্মেষ ঘটে এবং মন্দ দিকগুলো বর্জনের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। শিশুকাল থেকে ছেলে মেয়েদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে হবে, যাতে তারা ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে সংযত থাকতে পারে, সকল খারাপ জিনিস থেকে।

খ) সুশিক্ষা অর্জন:
সুশিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের বিবেক, বুদ্ধি, সুবোধশক্তি অর্জিত হয়। সুশিক্ষা মানুষকে গড়ে তোলে মানবিক ধারায়। সুশিক্ষায় যারা শিক্ষিত, তারা সবসময় মন্দকে বর্জন করে। সুশিক্ষা অর্জনের মধ্য দিয়ে মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

গ) কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব হ্রাস:
নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব কমিয়ে আনলে মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। সেজন্য যুগোপযোগী প্রযুক্তি নির্ভর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা, শিল্পকারখানা স্থাপন প্রভৃতিতে অগ্রসর হলেই, কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং বেকারত্ব হ্রাস পাবে। 

ঘ) দেশপ্রেম:
একটি দেশের প্রত্যেক নাগরিকই স্ব স্ব ভ‚মিকায় তাদের নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। সেক্ষেত্রে তাদের দায় দায়িত্ব অনেক। তারা যদি তাদের দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকে তাহলে, দেশের জন্য কোনটা মঙ্গল আর কোনটা অমঙ্গল, সেটা উপলব্ধি করতে পারবে। আর এই উপলব্ধিটাই হচ্ছে, দেশপ্রেম। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাদককে ঘৃণা করতে হবে।

ঙ) আইনের কঠোর অনুশীলন:
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন চালু রয়েছে। এ সকল আইনের কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে অভিযান সচল রাখলে, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধ হবে।

চ) লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা:
লাইব্রেরি হচ্ছে সকল জ্ঞানের আধার ও জ্ঞানচর্চার স্থান । জ্ঞানরূপ অস্ত্রের মাধ্যমে অজ্ঞানরূপ সন্দেহ দূর হয়। জ্ঞান সুপ্রকাশিত করে ব্যক্তির সুবোধ বুদ্ধি। সেই পরম জ্ঞানকে অর্জন করতে চর্চা করতে হবে প্রতিনিয়ত। দেশের আনাচে কানাচে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে মাদকাসক্তি, অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে। 

ছ) প্রচার প্রচারণা:
ধূমপান ও মাদকের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে হবে ব্যাপকভাবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ধর্মীয় স্থাপনায়, জন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিভিন্ন মাধ্যমে ধূমপান ও মাদকের কুফল সম্পর্কে প্রচার করতে হবে। বর্তমানে বিজ্ঞাপনের অনন্য মাধ্যম বিলবোর্ড। বিলবোর্ডে অন্যান্য খাদ্য পণ্যের বিজ্ঞাপন সীমিত করে মাদকের কুফল সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে। টেলিভিশন, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা একান্ত কাম্য। পাঠ্যসূচীতেও ধূমপান ও মাদকের কুফল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

জ) সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি:
যেখানে সংস্কৃতির বেশি চর্চা হয়, সেখানে অশুভ কিছু ঘটতে পারে না। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যেমন- সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয়, রচনা, কবিতা, বাদ্যযন্ত্র, ঐতিহ্য প্রভৃতি শিল্পকলার সাথে সম্পৃক্ত হতে পারলেই মাদক থেকে দূরে থাকা সম্ভব। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই, ধূমপান ও মাদক থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

ঝ) খেলাধুলার সম্প্রসারণ:
খেলাধুলার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, মন উৎফুল্ল থাকে, কর্ম-চাঞ্চল্য লক্ষ করা যায়, শারীরিকভাবে সুস্থতা অনুভব হয়। খেলাধুলার সম্প্রসারণের মাধ্যমে ধূমপান ও মাদকমুক্ত সমাজ নির্মাণ সম্ভব। কেননা খেলাধুলার মধ্য দিয়ে তরুণের তারুণ্য জেগে উঠে, যা পৃথিবীর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলোর কাঙ্ক্ষিত।

ঞ) সঠিক আদর্শ নির্বাচন:
প্রায় প্রত্যেকেই আদর্শ নিয়ে চলতে পছন্দ করে। আদর্শের ভালো-মন্দের ওপর, ব্যক্তির ভালো-মন্দ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য সঠিক আদর্শ নির্বাচন করে, ভালো হওয়ার প্রচেষ্টাই, ধূমপান ও মাদক থেকে ব্যক্তিকে দূরে রাখবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কিছু কার্যকরী ভূমিকা:
মাদকদ্রব্যের কুফল সম্পর্কে পুরো বিশ্ববাসীকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ২৬ জুন, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ প্রণয়ন করা হয়। তাছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক বিভিন্ন সম্মেলন আয়োজিত হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে।

উপসংহার:
মহালগ্নে মহাজীবনের স্বপ্ন প্রায় সকলেই দেখে। সে-ই মহাজীবন পায়, যে মহালগ্নে নিজেকে আবদ্ধ রাখে। মহাজীবন পেতে মাদককে ‘না’ বলতে হবে। ‘না’ বলায় স্মার্ট হতে হবে। মনের মধ্যে যখন বুদ্ধি জাগে তখনই মন চলতে শুরু করে। আর যখন চেতনার বিকাশ ঘটে, তখন মন কাজ করতে শুরু করে। মনের এই স্থিত অবস্থা থেকে সামনে এগিয়ে চলার অবস্থাই হচ্ছে, মনের মানস। এই মানসকে সৃজনশীলতা দিয়ে সাজাতে হবে। তবেই আসবে আনন্দ।

আরও পড়ুন: বেড়েছে শিক্ষার পরিমাণ, কমেছে গুণগত মান

এই আনন্দ চেতনাকে জাগবার, এই আনন্দ সকল অশুভ বস্তুকে ধ্বংস করবার। মানুষের এই চেতনার জাগরণে দলিত হোক ধূমপান ও মাদকের কালো অধ্যায়। উদিত হোক সুন্দর পৃথিবীর নতুন সূর্য। পরিশেষে বিখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর একটি কবিতার তিনটি চরণ দিয়ে ‘ধূমপান ও মাদকের পরিণতি: মুক্তির উপায়’ শীর্ষক বিশ্লেষিত নিবন্ধটির ইতি টানছি।

“হে বিষাদ, তুমি যাও
এখন আমার সময় নেই
তুমি যাও”

প্রসঙ্গত মাদকের অপব্যবহার প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘পাপেল স্টোরি’ প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে গত পহেলা জুলাই সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘Be firefly in the dark’ এ মূলমন্ত্র ‘ফায়ারফ্লাই’ ক্যাম্পেইনের যাত্রা শুরু হয়। গ্রামীণ এবং শহর উভয় এলাকায় মাদক এখন সহজলভ্য যা একটি বহুমুখী চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে যার ভয়াবহতা প্রতিদিনকার খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়। এর উত্তরণে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সামাজিক উন্নয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণে ‘পাপেল স্টোরি’ কাজ করে যাচ্ছে।


সর্বশেষ সংবাদ