বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস এবং প্রাণী চিকিৎসার অগ্রগতি

সাদাফ তাজবীর
সাদাফ তাজবীর  © সংগৃহীত

শনিবার বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস। প্রতিবছর সারা পৃথিবীব্যাপী এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার ভেটেরিনারি দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রাণীদের স্বাস্থ্য সচেতনতায় অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধার সমন্বয় করে এই খ্যাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং আমিষ ও প্রোটিনের যোগানে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থেকে কাজ করছে ভেটেরিনারিয়ানরা। একটি দেশের পুষ্টি বিশেষ করে প্রোটিন ও আমিষের চাহিদার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন এই ভেটেরিনারিয়ানরা।

সারা দেশে যথাযথ মর্যাদাসহ সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিনামূল্যে প্রাণীর চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান, টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো, Veterinarians are essential health workers" বা "ভেটেরিনারিয়ানরা অপরিহার্য স্বাস্থ্যকর্মী"।

১৯০৬ সালে ৮ম বিশ্ব ভেটেরিনারি কংগ্রেস এ বিশ্ব ভেটেরিনারিয়ান নেতৃবৃন্দ একটি কমিটি গঠন করে যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো নিজেদের মধ্যে সাংগঠনিক যোগাযোগ রক্ষা করা। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন বর্তমানে ওয়ার্ল্ড অরগানাইজেশন ফর এনিমেল হেলথ (ওআইই), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা (ডব্লিওএইচও), ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন(এফএও) এর সাথে এক হয়ে সারা বিশ্বে কাজ করছে।

২০০১ সালে বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন, ভেটেরিনারি পেশার সাথে কর্মরত সকল ভেটেরিনারিয়ানদের জন্য একটি বিশেষ দিন আয়োজনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। যা প্রতি বছরের এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার। এর মূল লক্ষ্য হলো ভেটেরিনারি পেশাকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া এবং প্রাণি ও মানুষের উন্নয়নে কাজ করা, পরিবেশের উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রাণী পরিবহন ও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরনে ভুমিকা রাখা। বিশ্বের সকল সদস্য দেশের বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস উৎযাপনের উপর ভিত্তি করে এওয়ার্ড ও দিয়ে থাকে বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন।

বাংলাদেশে ২০০৮ সালে প্রথম দি ভেট এক্সিকিউটিভ আয়োজন করে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবসটি। বর্তমানে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন (বিভিএ), দি ভেট এক্সিকিউটিভ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি ছাত্র সমিতি যৌথভাবে দিনটি নানা আয়োজনের সঙ্গে উদযাপন করে থাকে।

পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যতো মহামারী দেখা দিয়েছে তার অধিকাংশই প্রাণী থেকে মানুষে স্থানান্তরিত হয়েছে। এইতো কিছুদিন আগের কোভিড-১৯ ভাইরাসসহ সোয়াইন ফ্লু, নিপাহ, ইবোলা, মার্স, সার্স, র‌্যাবিস, অ্যানথ্রাক্স, বোভিন টিবি, মারবুর্গ, লেপটোসিরোসিস এই সকল বড় বড় মহামারির উৎস প্রাণী। এসব মহামারিতে অতীতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে। এসব ভাইরাসঘটিত রোগকে জুনোটিক ডিজিজ বলা হয়।

মানবকল্যাণে ভেটেরিনারিয়ানরা এইসব রোগের উপর গবেষণা করছে। পৃথিবীর প্রাণিকুলের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত না থাকলে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে না কারণ মানুষ আমিষ এবং প্রোটিনের জন্য প্রাণীকুলের উপরই শতভাগ নির্ভর। মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রাণিকুলের সুস্থতা প্রয়োজন সবার আগে।

এজন্য প্রাণী স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিওভিএ) যৌথভাবে ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর এনিমেল হেলথ (ওআইই), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা (ডব্লিওএইচও) এবং ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) এর সঙ্গে সারাবিশ্বে কাজ করে যাচ্ছে।

ভেটেরিনারিয়ানরা অনেক আগে থেকেই ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, র‍্যাবিস, ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজের মতো বিভিন্ন জুনোটিক ডিজিস নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, রোগপ্রতিষেধক টিকা এবং প্রতিকারের উপায় বের করতে ভেটেরিনারিয়াদের অবদান অনস্বীকার্য। এ পর্যন্ত যতগুলো টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে তার সবই প্রাণিসম্পদের ওপরই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল।

বাংলাদেশে ভেটেরিনারি শিক্ষার গোড়াপত্তন কুমিল্লাতে, ১৯৪৭ সালে ৭ আগস্ট কুমিল্লাতে প্রথম ৩ বছরমেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয়। পরে ১৯৫০ সালে কলেজটি ঢাকার তেজগাঁও স্থানান্তরিত হয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৫ বছরমেয়াদি পশুপালন ডিগ্রি চালু করা হয়।

১৯৬২ সালে ময়মনসিংহে সবর্প্রথম ইস্ট পাকিস্থান অ্যাগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যেটি পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে নামকরণ হয়। এখানে ১৯৬৩ সালে পশুপালন এবং প্রাণী চিকিৎসা ডিগ্রি পৃথকীকরণ করা হয়। ২০০৬ সালের ৭ আগস্ট দেশের একমাত্র বিশেষায়িত ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদে রয়েছে ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পটুয়াখালী, হাজী দানেশ, মাওলানা ভাসানী, যশোর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদ। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই রয়েছে ভোটেরিনারি টিচিং হসপিটাল যা, ভোটেরিনারি শিক্ষাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । 

প্রানীসম্পদকে এগিয়ে নিতে যেসব যুগান্তকারী ভ্যাকসিন চালু হয়েছে তার মাঝে এনথ্রাক্স, হেমোরহেজিক সেপটিকেমিয়া, ব্লাক কোয়ার্টার, এফএমডি, র‍্যাবিস, গোট পক্স, পিপিআর  উল্লেখযোগ্য। এসব ভ্যাকসিন সহ বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক, ফাইটোবায়োটিক, কৃমিনাশক, জীবাণুনাশক, অ্যান্টিহিস্টামিন, ব্যাথানাশক, ভিটামিনসহ যাবতীয় মেডিসিন প্রাণিসম্পদকে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এছাড়াও প্রাণী মোটাতাজাকরণ, দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি , ডিম উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে আসছে ভেটেরিনারি ডাক্তারগণ।

২১ শতকের  স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে এবং স্মার্ট লাইভস্টকের যারা ধারক ও বাহক রূপে খামারীদের সহায়তা করে আসছে, সেসব ডাক্তারগণের জন্য থাকবে কৃতজ্ঞতা। দেশের এই খাতকে আরও বৃদ্ধিতে ইউনিয়ন/প্রান্তিক পর্যায়ে ভেটেরিনারিয়ানদের কার্যক্রম বৃদ্ধিতে বর্তমান সরকারের মনোযোগী হওয়া জরুরি। সেইসাথে প্রান্তিক পর্যায়ে কোয়াকমুক্ত  চিকিৎসা সেবা চালু করে খামারীদের প্রাণী মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করাও বর্তমান সময়ে জরুরী।

লেখক: শিক্ষার্থী, ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন, পবিপ্রবি

 

সর্বশেষ সংবাদ