০২ মার্চ ২০২৪, ১২:৩২

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সমস্যা দূর করা যায় যেভাবে 

নোমান বিন হারুন  © টিডিসি ফটো

দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে আলোচনা পযার্লোচনা ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের নির্দেশনার পর ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবারের মতো গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে কৃষি ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। গুচ্ছ পদ্ধতিতে সবচেয়ে বড় ভর্তি পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয় ৩৫টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে। পূর্বের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে অভিভাবক, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই ‘সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা’ আয়োজনের দাবি ওঠে। বর্তমানে গুচ্ছ পদ্ধতিতে আগের চেয়ে ভোগান্তি কমলেও ভর্তি নিয়ে সংকটগুলো রয়েই গেছে। 

এখনো পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির এ উদ্যোগের সঙ্গে থাকবে কি না— তা এখনও নিশ্চিত করেনি। কোনো সমীক্ষা বা গবেষণা পরিচালনা না করেই ইউজিসি এতো বড় একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা তো কোনো গবেষণাক্ষেত্র না। অভিভাবকদের দাবির প্রেক্ষিতে সাধারণ ধারণার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা নিয়ে এতো বড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় না। যারা ইউজিসির উদ্যোগ সমর্থন করছেন তারা মেডিক্যালের সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়াকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, শুরু তো করতে হবে। তারপর সমস্যা হলে সেটা সমাধান করা যাবে। 

এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কয়েক ধাপে দীর্ঘ সময় ধরে ভর্তি কার্যক্রম চলমান রাখতে হয়। ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কারণে আসন পূরণ করতে দীর্ঘসূত্রিতায় পড়তে হয় তাদের। ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক অবস্থানগত কারণে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান সমান নয়। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন ধারণা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিসর বিবেচনায় মেডিকেল কলেজগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ। সেটাকে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া ঠিক হবে না।

আরো পড়ুন: জাবি ভর্তি পরীক্ষার ফল পুনঃনিরীক্ষণের নিয়ম নেই, ক্ষোভ ভর্তিচ্ছুদের

গুচ্ছভুক্ত ৩৫টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (জিএসটি গুচ্ছভুক্ত) ভর্তির পরীক্ষায় কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথম যে সমস্যাটি উঠে এসেছে তা হলো, এখানে প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় বেশ দেরিতে; ভর্তির প্রক্রিয়াটিও দেরিতে শেষ হয়। ফলশ্রুতিতে নির্ধারিত সময়ে ক্লাস শুরু করা যায়নি। এরপরও দীর্ঘ সময় দিয়ে মাইগ্রেশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ রাখা হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা যেমন সমস্যায় পড়েন, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও নিধার্রিত আসন পূরণ নিয়ে সমস্যায় পড়ে।

অভিভাবকদের দাবি, সমন্বিত পরীক্ষার ফলে ছাত্র-শিক্ষক উভয়েরই কষ্ট কমেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিযোগ, ইউজিসি এ ব্যাপারে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কখনো কথা বলেননি। তাঁরা সবগুলো মিটিং করেছেন উপাচার্যদের সাথে। আপাতদৃষ্টিতে ইউজিসির পক্ষ থেকে বিষয়টি চাপিয়ে দেয়া বলে মনে হয়েছে। পর্যাপ্ত নির্দেশনা না পাওয়ায় টেকনিক্যাল কমিটিও বলতে পারছে না তারা কী করবে। গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিচ্ছে কিছু নামহীন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক ক্ষেত্রেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তির আগেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সেমিস্টার শেষ হয়ে যাচ্ছে। এতে করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা বাড়ছে; মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা। 

এসব সমস্যা সমাধানে ইউজিসির পক্ষ থেকে একটি একাডেমিক ক্যালেন্ডার নিধার্রণ করা জরুরি। নিধার্রিত সময়ে ভর্তি কার্যক্রম শেষে ক্লাস শুরুর সম্ভাব্য সময় আগেই বলে দিতে হবে। গুচ্ছভুক্ত প্রতিষ্ঠানসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়কে মোটামুটি কাছাকাছি সময়ে ভর্তি পরীক্ষা নিতে হবে। এ ব্যাপারে ইউজিসি পরামর্শ দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বউদ্যোগে সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি ইউজিসির সক্ষমতা নিয়েও অনেকেই কথা বলছেন। 

আরো পড়ুন: চবির ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন

ইউজিসির মূল যে কাজ— বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর্থিক ও সামগ্রিক তদারকির মধ্যে রাখা; সেটা করতেই তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার উপর ভর্তি পরীক্ষার মতো বিষয়েও তাকে দায়িত্ব পালন করতে হলে তা সাধ্যের বাইরে চলে যাবে। বলা হচ্ছে, রোটেশন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দায়িত্ব নিবে। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কি এ দায়িত্ব পালন করার সক্ষমতা আছে?  সবকিছু ছাপিয়ে এক্ষেত্রে পৃথক কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার কথা ভাবা যেতে পারে। 

এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এ বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার গন্তব্য ঠিক করে দেয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো গড়ে উঠেনি। এটি পরিচালনা করার দক্ষতা বিদ্যমান কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। এ ভাবনা থেকেই দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করার বিষয়ে দ্রুত একটি অধ্যাদেশ জারির সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে ইউজিসি। এই অধ্যাদেশ জারি হলে ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ) গঠনের আগ পর্যন্ত এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে। এই উদ্যোগ নিয়েও দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেননা এর আগে ইউজিসির গুচ্ছ পদ্ধতি অকার্যকর পদ্ধতি প্রমাণিত হয়েছে। এ পদ্ধতি সর্ব মহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ালেও আবেদন ফি বৃদ্ধি, পরীক্ষার ফলে ভুল, মেরিট পজিশন না দেয়া এবং সবশেষ বিষয় পছন্দের জন্য বাড়তি ফি নির্ধারণ করায় এই পদ্ধতির পরীক্ষা আয়োজনের সফলতা ঢাকা পড়েছিল ব্যর্থতায়।

একই সাথে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ধারণার দিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বতন্ত্র কাঠামো রয়েছে, একক পরীক্ষার মাধ্যমে এই স্বতন্ত্র নিয়মাবলি ক্ষুণ্ন হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কোনো বোর্ড বা পাবলিক পরীক্ষা নয়। এটি একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরীক্ষা। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এর আয়োজন করা হয়। সে জন্যে পরীক্ষার ধরণ আলাদা। শিক্ষার্থীদের বাছাই করে ভর্তি করার ক্ষমতা তাদের নিজেদের হাতে থাকা উচিত। অন্যরা কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে যায় না। 

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে অনেক যুক্তি আছে। শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা দিতে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়। যাতায়াতসহ অন্যান্য আর্থিক খরচ, ভোগান্তি এসব বিবেচনা করেই হয়তো এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে কেন্দ্রীভূত পরীক্ষার মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি হয়। ঝুঁকির কারণটি প্রতিষ্ঠানের সুশাসনের ধারণার সাথে সম্পর্কিত। এর ফলে শিক্ষার্থীদের সুযোগ কমে আসবে। 

উচ্চশিক্ষার জন্য অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে শিক্ষার্থীদের জন্য তার দ্বার সংকুচিত হয়ে যাবে। এসব কথা শুনলে অনেকেই ভর্তি পরীক্ষা তুলে দেয়ার কথা বলেন। তবে সেটাও কোন কাজের কথা নয়। যোগ্যতমকে বাছাই করতে হলে একটি যাচাই পদ্ধতির মধ্য দিয়েই আসতে হবে। সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে সমন্বয় সাধনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কার্যক্রমের মানের উপর সমানভাবে দৃষ্টিপাত করতে হবে। নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয় খুলে সংখ্যাবৃদ্ধি না করে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যথাযথ মানে উন্নীত করতে হবে। শিক্ষার্থীদেরও কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’র পেছনে না ছুটে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের দিকে সকলের নজর পড়বে। এটাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।