‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ গানের মূল সুর রক্ষা কেন গুরুত্বপূর্ণ

ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার
ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার  © টিডিসি ফটো

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর সৃষ্টি ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ গানকে আমাদের রক্ষা করতেই হবে। এটি নিছক একটি গান নয়। এ গান সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।‌ গানটি কাজী নজরুল ইসলাম লেখেছেন ঐতিহাসিক এক প্রেক্ষাপটে। 

ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আটকের প্রতিবাদে কাজী নজরুল ইসলাম 'কারার ঐ লৌহ-কবাট' গানটি লেখেন। ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটি 'ভাঙার গান' বইয়ে প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। ব্রিটিশ সরকার এ গানের মর্ম বুঝতে পারে।‌ গানটি প্রকাশের পর ভারতীয় উপমহাদেশে তোলপাড় শুরু হয় শুরু হয়। টনক নড়ে ব্রিটিশ সরকারের। প্রকাশের পরপর ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার ভাঙার গান নিষিদ্ধ করে। 

কবি হুগলি জেলে থাকাকালীন অসংখ্য কারাবন্দি বিপ্লবীদের সঙ্গে বজ্রকণ্ঠে গাইতেন এই গান। যার প্রভাবে তৎকালীন স্বাধীনতাকামী ভারতীয় যুবসমাজ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আপামর মানুষকে এভাবে আর কোনো গান উদ্দীপ্ত করতে পারেনি।গানটি প্রকাশের পর একই সুর বহাল আছে। 

 ১৯৪২ সালে কবি নির্বাক হয়ে যান। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশভাগ হয়। ততদিনে গানটি বাংলাভাষী সব মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছে।

পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতে ‘ভাঙার গান’ কাব্য ফের প্রকাশিত হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৯ সালে কলাম্বিয়া রেকর্ড এবং ১৯৫০ সালে হিজ মাস্টার্স ভয়েস-তে(এইচএমভি) গিরিন চক্রবর্তীর কণ্ঠে গানটি বাণীবদ্ধ হয়। ১৯৪৯ সালে নির্মল চৌধুরী পরিচালিত 'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন' সিনেমায় গিরিন চক্রবর্তী ও তাঁর সহশিল্পীদের নিয়ে গানটি রেকর্ড করেন সংগীত পরিচালক কালীপদ সেন। এরপর ১৯৬৯-৭০ সালে জহির রায়হান তাঁর কালজয়ী চলচ্চিত্র 'জীবন থেকে নেয়া' সিনেমায়ও গানটি ব্যবহার করেন। 'কারার ঐ লৌহ-কবাট' গানটির মূল লেখক , সুরকার ও গীতিকার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটিতে অস্কারজয়ী ভারতীয় সংগীত পরিচালক এ আর রহমান নতুনভাবে সুরারোপ করেছেন। এটি ব্যবহার করা হয়েছে পিপ্পা নামের একটি হিন্দি চলচ্চিত্রে। ১৯৭১ সালে যশোরের চৌগাছার গরীবপুরের যুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া বাস্তব জীবনের ঘটনা অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন রাজা কৃষ্ণ মেনন। 

এ আর রহমান গানের কথা ঠিক রাখলেও সুরের পরিবর্তন করেছেন। এই গান নজরুলের নিজের সুরারোপিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। আমাদের সব বিপ্লব–বিদ্রোহ তথা আন্দোলন–সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’। 
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি বিদ্রোহী কবি নামে পরিচিত। তাঁর কবিতা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ। তাঁর কবিতার আসল সুর অক্ষুণ্ন রাখাটা জরুরি। 

'কারার ঐ লৌহ-কবাট’ শত বছরের এক অবিনাশী অমর গান। সময়ের প্রয়োজনে লেখা হলেও গানটির জনপ্রিয়তায় সামান্যতম। ব্রিটিশ বিরোধী লেখা গানটি সব ধরনের অন্যায়, অবিচার ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, ফলে এখনো সমানভাবে এটি প্রাসঙ্গিক। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনসহ সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে 'কারার ঐ লৌহ-কবাট’ গান গাওয়া হয়েছে। 

নিঃসন্দেহে এ আর রহমান একজন বড় সঙ্গীত শিল্পী। অস্কার বিজয়ী। কিন্তু তিনি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ও সুর করা ঐতিহাসিক গানটির সুর যেভাবে বিকৃত করেছেন তা কোনোমতেই কাম্য নয়। একই গানের একটি কাজী নজরুলের সুরে ও আরেকটি বিকৃত সুরে থাকলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে। এটা কোনোভাবেই হতে দেয়া যাবেনা। পিপ্পা সিনেমার কর্তৃপক্ষ কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার থেকে গানটি প্রকাশের জন্য অনুমতি নিয়েছেন কিনা এটা বড় বিষয় নয়।‌ 'কারার ঐ লৌহ-কবাট' গানটি শুধু কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের সম্পদ নয়। গানটি সকল প্রজন্মের ,‌ বাঙালি জনগোষ্ঠী বিশেষ করে বাংলাদেশিদের অমূল্য সম্পদ। কাজী নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। কাজী নজরুলের ঐতিহাসিক গানের বিকৃত সুর আমরা কোনোক্রমে মেনে নিতে পারি না।  এ আর রহমানের বিকৃত সুরে গাওয়া "কারার ঐ লৌহ-কবাট" গান  সকল অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে  অপসারণ করতে মহামান্য হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। রিটটি শুনানির জন্য তালিকায় রয়েছে।‌ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন আইনজীবী ও একটি মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষে জনস্বার্থে ওই রিট দায়ের করা হয়।   জাতীয় কবির অমর গান রক্ষা করার দায়িত্ব সবারই। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সবার কবি। 

১৯২১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম ঐতিহাসিক এক প্রেক্ষাপটে 'কারার ঐ লৌহ-কবাট’  গানটি লিখেন।  এরপর ১০২ বছর অতিক্রান্ত হলেও গানটির জনপ্রিয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা বিন্দুমাত্র কমেনি। একই গানের মূল সুর ও নকল সুর থাকতে পারে না। এতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে। ‌আমরা এটা হতে দিতে পারি না।‌

'কারার ঐ লৌহ-কবাট’ গানের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের আমাদের আবেগ-অনুভূতি। বিপ্লব আর আন্দোলনের ইতিহাস।‌ আমরা আমাদের আবেগ-অনুভূতি বিপ্লব ও আন্দোলনকে বিসর্জন দিতে পারি না। তাই 'কারার ঐ লৌহ-কবাট’ গানের সুর রক্ষা করতে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। বাঙালির সকল মুক্তির সংগ্রামে 'কারার ঐ লৌহ-কবাট’ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।  

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট  ও আন্তর্জাতিক আইনের গবেষক।‌


সর্বশেষ সংবাদ