আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা: মাস্টার্সে কীভাবে ফান্ডিং পাওয়া যায়
আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা - মাস্টার্স লেভেলে কীভাবে ফান্ডিং পাওয়া যায়
আমেরিকায় গ্রাজুয়েট লেভেলে শিক্ষার ক্ষেত্রে পিএইচডি আর মাস্টার্স দুইটি অপশন থাকে। এর মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রিটি যে আসলে সবার দরকার নাই, সেটা নিয়ে কয়েকদিন আগে লিখেছি। যারা পিএইচডি করতে চান এবং সেটা করার মত ক্ষমতা এবং ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার প্ল্যান আছে, তারা অবশ্যই পিএইচডিতেই অ্যাপ্লাই করবেন।
কিন্তু অনেকের ক্যারিয়ার প্ল্যানের সাথে মাস্টার্স ডিগ্রিটি সামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ (১) মাস্টার্সে মাত্র দেড়-দুই বছর লাগে (২) রিসার্চ একেবারেই লাগে না বা অল্প লাগে (থিসিস বেইজড হলে) (৩) মূলত কোর্সওয়ার্ক বেইজড এবং (৪) অনেক* সাবজেক্টের জব মার্কেটে একাডেমিক জব ও রিসার্চ জব বাদে বাকি অনেক ইন্ডাস্ট্রি জবে মাস্টার্সই যথেষ্ট।
সমস্যাটা হলো, পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির সাথে সাথে ফান্ডিং নানা ভাবে সহজে মিললেও মাস্টার্সে ফান্ডিং পাওয়া বেশ কঠিন। কারণ নানা ইউনিভার্সিটি পিএইচডি শিক্ষার্থীদেরকেই অগ্রাধিকার দেয় ফান্ডিং এর ক্ষেত্রে।
তাহলে মাস্টার্স পর্যায়ে ফান্ডিং এর উপায় কী? নানা জনে এটা নিয়ে লিখতে অনুরোধ করায় কিছু উপায় এখানে বলছি।
(১) খেয়াল করে অ্যাপ্লাই করা- অনেক ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স প্রোগ্রাম আছে কিন্তু পিএইচডি প্রোগ্রাম নাই। এসব ইউনিভার্সিটিতে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ক্ষেত্রবিশেষে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট পজিশনগুলো তাই মাস্টার্স শিক্ষার্থীরাই পেয়ে থাকে। একেবারে টপ র্যাংক ইউনিভার্সিটিতে পড়ার বাধ্যবাধকতা না থাকলে এসব ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করতে পারেন।
(২) বড় ডিপার্টমেন্টে অ্যাপ্লাই করা - উপরের পয়েন্টের বিপরীতও আছে। টপ রাংকড অনেক জায়গায় ডিপার্টমেন্ট অনেক বড় হয়। প্রতি বছর হয়তো হাজার হাজার শিক্ষার্থী আসছে। সেক্ষেত্রে পিএইচডি স্টুডেন্ট ছাড়াও মাস্টার্সের স্টুডেন্টেরা নানা অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ পেতে পারে।
(৩) প্রফেসরের কাছ থেকে ফান্ডিং পাওয়া -প্রফেসরদের ম্যানেজ করতে পারলে পিএইচডির মতোই মাস্টার্সে ফান্ড পাওয়া যায়। আপনার কাজে বা প্রোফাইলে প্রফেসর যদি বেশি সন্তুষ্ট থাকেন, তাহলে ফান্ড পেতে পারেন। আবার কোনো প্রজেক্টের কাজে জরুরি দরকার হলে অনেক সময়ে মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদেরও ফান্ড দেয়া হয়। আমার নানা প্রজেক্টে মাস্টার্স লেভেলের শিক্ষার্থীদের ফুল ফান্ড নানা সময়ে দিয়েছি। কাজেই প্রফেসরেরা কেবল পিএইচডিতেই ফান্ড দেন, তা সব সময়ে ঠিক না। মাস্টার্সেও পেতে পারেন। নিজের দক্ষতা বাড়ান এবং প্রফেসরদের সাথে আগে থেকে যোগাযোগ করুন।
আরও পড়ুন: আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা: সবার কি পিএইচডি করার দরকার আছে?
(৪) ফুল ফান্ড না পেলেও অন্যান্য ফান্ড - ধরা যাক আপনার অ্যাপ্লাই করা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে ফুল ফান্ড মিলছে না। সেক্ষেত্রে গ্রাজুয়েট কোঅর্ডিনেটরের সাথে ইমেইলে যোগাযোগ করে অন্যান্য সুবিধা নিতে পারেন। যেমন ইনস্টেইট টিউশন রেইট (যা অনেকখানি কম হয়), ৫০% টিউশন ওয়েইভার, এরকম। অথবা কোনো রকমের স্কলারশিপ।
(৫) গ্রাজুয়েট অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ - একবার ক্যাম্পাসে এসে গেলে নানা রকমের কাজের সুযোগ পাওয়া সহজ হয়। মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা অনেক সময়ে ঘণ্টা হিসাবে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, টিউটর, ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট, লাইব্রেরি/রিক্রিয়েশন সেন্টার এসব জায়গায় কাজ পেতে পারে। একটা উদাহরণ দেই -- আমার ডিপার্টমেন্টে পিএইচডি স্টুডেন্টদেরকেই আমরা ফুল ফান্ডিং দেই। কিন্তু মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের থেকে প্রচুর পরিমানে Hourly TA নিয়োগ করি। এই সেমিস্টারে আমি ৪৫ জন মাস্টার্সের শিক্ষার্থীকে টিচিং অ্যাসিস্টেন্ট হিসাবে নিয়োগ করেছি। এরা মাসে ১০০০-১২০০ এর মতো বেতন পাবে। টিউশনের কিয়দংশ হলেও উঠে আসবে।
এছাড়াও ক্যাম্পাসের নানা ল্যাবে নানা কাজের জন্য লোক লাগে। আমার পরিচিত অনেক মাস্টার্স শিক্ষার্থী আমাদের মেডিকাল স্কুলের নানা ল্যাবের অ্যাপ বা ওয়েবসাইট বানাবার অথবা ক্যাম্পাস আইটি-তে কাজ করছে।
(৬) ইন্টার্নশিপ বা অফ ক্যাম্পাস জব - পেইড ইন্টার্নশিপে গিয়ে সেই সময়ে অনেক শিক্ষার্থী ভালো অংকের বেতন জোগাড় করে তা দিয়ে মাস্টার্সের পড়ার খরচ যোগায় সেটা দেখেছি। এছাড়া অনুমতি নিয়ে অফ ক্যাম্পাস সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা/সপ্তাহ কাজ করা যায়। আমার এক ইরানী ছাত্র আর এক চীনা ছাত্রী এভাবে তাদের মাস্টার্সের খরচ যোগাড় করেছে কিছুটা হলেও।
(৭) সেলফ ফান্ডিং - মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের প্রায় অধিকাংশই নিজের খরচে পড়তে আসে। অন্তত প্রথম সেমিস্টারের খরচ নিয়ে চলে আসে। (একদা বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরাও তাই করতো।)। এটাকে ইনভেস্টমেন্ট হিসাবে চিন্তা করলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় - মাত্র দেড় বছর পরে ফুল টাইম চাকুরিতে গেলে ইনভেস্ট করা অর্থ অচিরেই উঠে আসবে।
সমস্যা যেটা বুঝলাম তা হলো অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ব্যাংকে স্টুডেন্ট লোনের সিস্টেম মনে হয় নাই। অথবা থাকলেও কাগজে কলমে। তাই ভারতীয় নেপালী পাকিস্তানী ছাত্ররা গাদায় গাদায় আসতে পারলেও বাংলাদেশের কেউ এভাবে আসতে পারে না। এজন্য বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদেরকে বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর উপরে চাপ দেয়ার কথা বলবো।
কত সামান্য ইস্যুতে দেশে আন্দোলন হয়, আর এই কমন সেন্স ব্যাপারটা নিয়ে যদি কেউ না বলে তাহলে ব্যাংক লোন দিবে কেন?
সেদিন একজন বাংলাদেশী ছাত্রের সাথে কথা বললাম। সে এখানে এসেছে নিজের খরচে পড়তে। তার পরিবার বিশাল ধনী নয় মোটেও। কিন্তু এখানে আসার আগে কয়েক বছর চাকুরি করে কিছু সঞ্চয় করেছিলো। প্রথম সেমিস্টারের খরচ সেভাবে দিয়েছে। আর এখানে এসে দুই মাসের মধ্যে ক্যাম্পাস আইটি-তে চাকুরি পেয়ে গেছে, যা দিয়ে থাকা খাওয়ার খরচ এবং কিছুটা টিউশন সাপোর্ট হয়ে গেছে।
মাত্র এক বছর ৩ মাসে সে ডিগ্রিও শেষ করে ফেলছে। কাজেই সেলফ ফান্ডে আসা একেবারেই অসম্ভব নয়, ধনী পরিবারও লাগে না, আর সাহস করে যারা আসে তারা একেবারে মারা পড়ে না। এছাড়া আরেকটা অপশন হলো এখানে আসার পরে mPower বা প্রডিজি থেকে স্টাডি লোন নেয়া। এসম্পর্কে আমার একেবারেই ধারণা নেই তবে কেউ কেউ এভাবে লোন জোগাড় করেছে বলে জানিয়েছে।
(*তবে এটা পুরোপুরি নিজ দায়িত্বের ব্যাপার। এইটা নিয়ে কথা বলা বিপদজনক, কারণ লোকজন রেগে যায় এবং কিছু কিছু লোক গালি দিতে আসে। যদিও বিশ্বের অন্য সব দেশের শিক্ষার্থীরা এইটা ভালো করেই বুঝে। আমার ডিপার্টমেন্টে ৭০০ মাস্টার্স স্টুডেন্ট যা আছে, তার ৬৫০ জনই সেলফ ফান্ডেড ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট। তবে তাদের মধ্যে সর্বসাকুল্যে ৩ জন বাংলাদেশী। এমন না যে অ্যাপ্লাই করে নাই বা অ্যাডমিশন পায় নাই। কিন্তু সেলফ ফান্ডে কেউ পড়বেনা এমন পণ করে রেখেছে মনে হয়।
যাই হোক, কে কীভাবে পড়তে আসবে সেটা দিনের শেষে তার বিচার বুদ্ধির ব্যাপার। যাহোক, মাস্টার্সে পড়ার অর্থায়নের উপায় নিয়ে লিখবো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তাই এই লেখাটা লিখলাম। কিছু লোকজন এতেও গালি দিবে, তাদের জন্য বলে রাখি, উপরের পুরো পোস্ট আমার মতামত বা Opinion মাত্র। এটাকে ধ্রূব সত্য হিসাবে প্রচার করছি না। যা দিনকাল পড়েছে, ফেইসবুকে নিজের ব্যক্তিগত পোস্টও যে মতামত দেয়ার জায়গা, তা লিখে দিতে হচ্ছে!!)
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বার্মিংহামের আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।