ঈদের এক সপ্তাহ আগেই নতুন জামা কিনে লুকিয়ে রাখতাম

রবিউল ইসলাম পলাশ
রবিউল ইসলাম পলাশ  © টিডিসি ফটো

সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তীত হয় আমাদের বয়স। বড় হয়ে যাই আমরা। বয়ে যাওয়া এই সময়ের মধ্যে আমাদের জীবনে বছরে দুইবার ঈদ আসে। প্রতি ঈদে যেনো মনে হয় ইস যদি আমার চলে যাওয়া শৈশবের ঈদ কেউ ফিরিয়ে দিতো!

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হওয়া হাজারো মানুষের মতো আমিও একজন। ঈদ এলেই যেনো শুরু হতো নতুন জাম-কাপড়ের কড়া আবদার। ঈদের এক সপ্তাহ আগেই নতুন জামা কাপড় লাগবেই। ঈদ মানেই আমাদের কাছে ছিলো প্রতিযোগীতা। লুকিয়ে রাখতাম নতুন কেনা জামা কাপড়। প্রতি রাতে একবার করে হলেও দেখতাম কত সুন্দর কাপড় এটা! লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যের জামা কাপড় দেখার চেষ্টা করতাম।

মেহেদী পাতা সংগ্রহ মানে চুরি করে হলেও এনে রাখতাম ঈদের আগের রাতে হাত রাঙাতে। ঈদের আগের রাত পরিবারের মহিলা সদস্যদের জন্য ছিলো পৃথিবীর ব্যস্ততম সময়। এই ব্যস্ত সময়ের মাঝেও মেহেদী পাতা বেঁটে হাতে পড়িয়ে দিতে হতো তাদের।

পটকাবাজি ছিলো ঈদের চাঁদের সাথে গভীর সম্পর্ক। চাঁদ আকাশে দেখা দেওয়ার সাথে সাথে চারিদিকে পটকার শব্দে মাতোয়ারা হয়ে যেতো। একবারতো পটকা ফুটানোর সময় হাতের মধ্যেই পটকা ফুটে গিয়েছিল। তাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম মাটিতে।

আমি নিজে ভাল গান গাইতে না পারলেও প্রচুর বাংলা গান শুনতাম। তখনতো আর মোবাইল এতো সহজলভ্য ছিল না। বাসায় সিডি প্লেয়ার দিয়ে পছন্দের গায়কদের গান শুনতাম। ঈদ উপলক্ষ্যে নতুন নতুন এলবাম আসতো খুব। সাইকেল চালিয়ে শহরে যেতাম জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, শাফিন, বিপ্লব, পথিক নবী প্রমুখ শিল্পীদের এলবাম সংগ্রহ করতে।

প্রতি ঈদে ৪/৫টা এলবাম সংগ্রহ করতে না পারলে মনে হতো ঈদটাই বৃথা। নামাজের পর পাল্লা দিয়ে বাজাতাম নতুন নতুন গান। একবার শহরে সারাদিন থেকেও জেমসের একটা এলবাম কিনতে না পেরে কি কান্নাই না করেছিলাম।

তখন আমর সমবয়সী চাচাতো ভাইয়েরা মিলে ঈদের গরু কুরবানীর সময় আমরা ছোটরা সারাদিন গরুর আশেপাশে থাকতাম। গরুর চামড়া উঠানোর পর বিশেষ এক পর্দা আছে যেটা দিয়ে ঢোল জাতীয় একটা বাদ্য যন্ত্র বানিয়ে সারাদিন বাজিয়ে বেড়াতাম। আর এই পর্দা লাগানো হতো মাটির হাড়ির কিংবা কলসের গলায়। 

মাটির হাড়ি সংগ্রহ করার জন্য সেকি প্রতিযোগীতা ছিলো! কারো মাটির হাড়ি কিংবা কলস চুড়ি করে আনতাম কিংবা নিজের বাড়ির ভালো কলস বা হাড়ি ভেঙ্গে নিয়ে যেতাম। এর জন্য যে মায়ের কাছে কত বকুনী আর মাইর খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। আর দুপুরের পর পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ একসাথে খাওয়ার স্বাদ আজও মনে গেঁথে আছে। 

ফুফু-ফুফা, চাচা-চাচী,মামা-মামী ও ভাই বোনেরা আসতো ঈদের পরের দিন। সেই দিনটাও ছিলো অন্যরকম ঈদ। আসার সময় হাতে করে বিভিন্ন খাবার, মিষ্টি নিয়ে আসতো। সেগুলো সংগ্রহ করে রেখে দিতাম আর অনেক দিন ধরে খেতাম। ওই সময়ে আমাদের ফ্রিজ ছিলো না। মাংস বিশেষ পদ্ধতিতে শুকিয়ে কিছুদিন খাওয়া হতো।

আমাদের বিনোদন বলতে ছিলো বিটিভি। সাত দিনব্যাপী বিটিভির ঈদ অনুষ্ঠান আমাদের কাছে অধরা এক আনন্দ ছিলো। মিস করতাম না কোন অনুষ্ঠান। ঈদের আগে যেভাবেই হোক ব্যাটারী চার্জ করে আনতাম আর উপভোগ করতাম জীবনের সেরা বিনোদনগুলো।

ঈদের পরের দিন পালিয়ে সিনেমা দেখার গল্প না হয় নাই বললাম। বাড়িতে লুকিয়ে লুঙ্গির নিচে প্যান্ট পড়ে পালিয়ে যেতাম সিনেমা হলে। ধরা পড়ে মাইরও খেয়েছিলাম কয়েকবার। সেইসব ঈদ যেনো আজও খুঁজে বেড়াই অসীম এই শূন্যতার ভীড়ে। খুঁজে বেড়াই আমার শৈশবকে।

লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা


সর্বশেষ সংবাদ