শৈশবের দশ টাকা ঈদ সালামিতে পৃথিবী কেনার আনন্দ ছিল

প্রতীকী
প্রতীকী  © সংগৃহীত

আমাদের ছোটবেলা খুব সুন্দর ছিল। আমরা ছোটবেলায় বিধিনিষেধ না মেনে কত যে দূরদূরান্ত ছুটে বেড়াতাম সেকথা আজ মনে পড়লে কেমন যেন সে ইচ্ছাগুলো ডানা মেলে উড়তে চায়। কিন্তু সেই সাধ্য কি আর এখন আছে! ছোটবেলার ঈদ যে কত রঙিন ঘুড়ি উড়াতো আর সেই ঘুড়ির লাগাম ধরে দৌঁড়েছিলাম শত সহস্র ক্রোশ পথ। সেই পথগুলোতে এখন কেন জানি দৌঁড়ানো যায় না। হাঁটতেও কষ্ট হয়। সে পথ বড্ড অভিমান করেছে বোধহয়। 

মনে পড়ে প্রথম যখন রোজা রাখি, সেবার আমি পুকুর পানিতে অনেক খেলা করেছিলাম। তখন গরম বর্ষার মিশেলে যে আবহাওয়ারা আমাদের এলাকায় বেড়াতে এসেছিল তাতে পানির মধ্যে থাকা বেশ আরামদায়ক মনে হচ্ছিল। তাই ঘণ্টা তিনেক পানির সঙ্গে মিতালী করলে শরীরটা ঠাণ্ডা হতো।

কিন্তু আম্মুরা তো সন্তানের জন্য বেশ সচেতন থাকেন। এ কারণে কিছুক্ষণ পর পরই শব্দের কাছে ডেকে পাঠাতো পুকুর থেকে উঠবার তাগাদা দিয়ে। শেষমেষ যখন উঠতামই না তখন ভয় দেখিয়ে বলতো, ‘‘ওদের গিয়ে বলো পানিতে বেশি থাকলে পশমের গাঁ বেয়ে শরীরের মধ্যে পানি ঢুকে রোজা ভেঙ্গে যাবে।’’ অমনি আমরা নীরবতা নিয়ে পুকুর থেকে ঘরে চলে আসতাম।

সন্ধ্যা হওয়ার পর একটু আগেই ইফতার জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে যেত মায়েরা। দই-চিড়া ভিজিয়ে, সরবত বানিয়ে, প্রত্যেকের সামনে প্লেট সাজিয়ে খেজুর নিয়ে বসিয়ে দিতো। ইফতার নিয়ে রাসূল (সা.)-এর গল্প শুনতে শুনতে চারদিক থেকে আজানের সু-মধুর সুর ভেসে আসতো।

তখন প্রতিদিন নিয়ম করে রোজা রাখতে না পারলেও সেহেরি ও ইফতার কখনো বাদ যেত না। কারণ আব্বুর যে একসঙ্গে না খেলে চলেই না। সেগুলো এখন কেমন ধোঁয়াশার চাদরে লেপ্টে যাচ্ছে। আব্বুদের থেকে দিনকে দিন দূরত্বগুলো নিযুত কোটির ব্যবধান হচ্ছে।

মধ্যবিত্ত আব্বুর ঈদের আগে ব্যস্ততা বেড়ে যেত বহুগুণ। তখন তাকে কাছে পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করতাম। কারণ আমাদের ঈদে কেনাকাটা হয়নি যে! এদিকে আমরা যে গাছ থেকে মেহেদী পাতা বেটে দুহাতে মাখিয়ে নিতাম আর তারপর সেই পাতা ধুয়ে ফেললে গাঢ় লাল রঙে হাত দুটো কৃষ্ণচূড়ার মতো হয়ে যেত তা সে ভ্রূক্ষেপই করতো না। হঠাৎ করেই আব্বু যখন লাল রাঙা হাতে নতুন জামা এনে গাঁয়ে পরিয়ে দিতেন তখন সে খুশি কে দেখতো!

সকালবেলা সবাই যখন ঈদের নামাজ পড়তে মসজিদের মাঠে একত্র হতো তখন আমরা তাদের সবাইকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতাম। অনেক সুন্দর দেখাতো তাদের। একে-অপরের কোলাকুলি আর কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে ঈদ ছড়িয়ে পরতো সবখানে। আমরা কিছুটা কুড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। তা নিয়ে মায়ের কাছে দিতাম আর মা আমাদের অন্য দিনের তুলনায় ভালো খাবার রেঁধে খাওয়াতেন।

দাদুভাই আমাদের নিয়ে দোকানে যেতেন। ওখানে গিয়ে দেখতাম সাজানো খেলনাগুলো চোখ বড় বড় করে ডেকে বলছে, ‘এখনো আমরা ঝুলছি, বেশ কষ্ট হচ্ছে, তাড়াতাড়ি উদ্ধার কর বাছা।’ অমনি দাদুভাইকে পটিয়ে খেলনাগুলো আমাদের করে নিতাম। তারপর ওদের সাথে জমিয়ে আড্ডা হতো। 

দাদির হাতের ধোঁয়া ওঠা গরম সেমাইয়ের স্বাদ নিতে নিতে হাতের মুঠোয় কখন যে সালামীর দশ টাকা লেপ্টে যেত টেরই পেতাম না। সেই দশ টাকা তখন পৃথিবী কেনার আনন্দ ছিল। দাদি আমায় বড্ড আদর করতেন।
দিনভর এ বাড়ি ওবাড়ি ঘুরতে ঘুরতে কতকি খাওয়া হতো! বেশি তো খেতে পারতাম না তবে কোনো বাড়ি  মচমচে খৈ দিয়ে সেমাই হলে হাল্কা পেটপুরে নিতাম।

ঈদে আমার সবচেয়ে পছন্দের তালিকায় মলিদা থাকে। আম্মু চিড়া ভিজিয়ে নাড়কেল চিনি আদা মিশিয়ে সরবতের মতো বানায়। ওর মধ্যে খৈ মুড়ি নিয়ে খায়, আহ্ কি মজা! মনে পড়লেই জিভে জল এসে যায়। 

ঈদ-চাঁদের নিরামিষ আলোয় হারিকেনকে পাহারাদার বানিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে দাদির কাছে রুপকথার গল্প শুনতাম। প্রথম দিনের তুলনায় আমাদের দ্বিতীয় দিন থেকে ঈদ বেশি জমতো। কারণ চাচাতো-ফুফাতো ভাই-বোনেরা মিলে বিরাট এক কাফেলা হতাম। আর নানা রকম দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখতাম পুরো বাড়ি।

খেলাধুলার তো কোনো শেষ ছিল না। বিকেলে গাছে উঠে এক ধরনের খেলা খেলতাম। শ্লোকটা ছিল এরকম ‘গাছে ওঠছো ক্যা? বগের ডরে। বগ কই? ঐ ঐ’’ একজন ছিল মগা (যেমন পুলিশ) সে গাছের একজনকে লাঠি দিয়ে ছুঁতে পারলেই যাকে ছুবে সে আবার মগা হবে। খেজুরের বিচি দিয়ে উজির বাদশার খেলা ছিল, ঐ খেলায় যে মাইর রে ভাই! তারপরও মজা ছিল।

আমরা যে ঈদ কিনে আনতাম তা আট দিনেও শেষ হতো না। দাদার ঘরে খানা দানা চলতো রমরমা। দাদাদাদি কেউই নেই এখন, আর সেই আনন্দ মিছিলে যোগ দেওয়ার তোরজোরও নেই। এখন নিজেই মোটামুটি স্বল্প পরিসরে ঈদ কিনতে পারি। কিন্তু সেই আমোদ ফুর্তি এখন নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি বিএম কলেজ, বরিশাল


সর্বশেষ সংবাদ