স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়েও দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস
বাংলাদেশে সব ধরনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের নজির আছে। হালে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা শিক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়েও দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, তা অস্বীকারও করা হয়।
শুধু তা-ই নয়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর প্রকাশ করে সাংবাদিকরা প্রশাসনের দিক থেকে চাপের মুখেও পড়েন। প্রশ্ন ফাঁসের ‘ভুয়া’ প্রতিবেদন প্রকাশ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে- এমন হুমকিও দেয়া হয়েছে সাংবাদিককে।
পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার ঘটানাও আছে। তদন্তে প্রমাণ হওয়ার পরও পরীক্ষা বাতিল করা হয়নি এমন নজিরও আছে। এই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে শিক্ষক, চিকিৎসক, ছাত্র ও কোচিং সেন্টারের লোকজন জড়িত বলে প্রমাণ মিলেছে। জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, প্রশ্ন প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।
২০০১ সাল থেকে পরবর্তী ১৬ বছরে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে ১০ বার। সিআইডি সম্প্রতি ২০২০ সালের প্রশ্ল ফাঁসের একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এই ঘটনা জানতে পেরেছে। তারা মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে সাত জনই চিকিৎসক। আর এই ফাঁস করা প্রশ্ন দিয়ে দুই হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। তারা পাশ করে চিকিৎসকও হয়েছেন।
২০২১ সালে পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এক হাজার ৫১১টি অফিসার (ক্যাশ) পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকার্স কমিটির আওতায় ওই নিয়োগ পরীক্ষা হয়। পরে তদন্তে দেখা যায়, প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে বুয়েটের শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরসহ ১৬ জন জড়িত।
তাদের মধ্যে আাছেন ব্যাংক কর্মকর্তা , টেকনিশিয়ান, পিয়ন। এই চক্রটি চেইনের মতো কাজ করেছে। ওই পরীক্ষায় এক লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন চাকরি-প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন। নিয়োগ পরীক্ষা অবশ্য পরে বাতিল করা হয়।
আরও পড়ুন: মেডিকেল ভর্তির প্রশ্নফাঁসের দায় স্বীকার দুই চিকিৎসকের
২০১৭ সালে মাধ্যমিক (এসএসসি) সমমানের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের বড় ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালেও এসএসসির প্রশ্ন ফাঁস হয়। পরীক্ষা মনিটরিং কমিটি প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা স্বীকারও করে। ২০০২২ সালে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী থেকে এসএসসির প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
দেখা যায়, ওই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে একজন প্রধান শিক্ষক কাম কেন্দ্র সচিব, দুই জন সহকারী শিক্ষক এবং অফিস সহায়ক জড়িত। মোট ছয়টি বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁস করেন তারা।
২০১৯ সালে ৪০ তম বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের একটি চক্রের পাঁচ সদস্যকে আটক করে ঢাকা মোট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। পুলিশ তখন জানায় তারা ৪০ তম বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁসের চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ফাঁসের আগেই তারা আটক হয়। তবে আগে তারা বিবিএসের প্রশ্ন ফাঁস করেছে।
২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের একটি চক্রের ১০ সদস্যকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সুষ্টি হয়। এরপর সিআইডি এই ঘটনার দুই বছর ধরে তদন্ত করে এই ফাঁসের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ শিক্ষার্থীসহ ১২৫ জনকে চিহ্নিত করে আদালতে চার্জশিট দেয়। তার ঢাবির ১৮ শিক্ষার্থীসহ ৪৭ জনকে শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াও বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে আসছিল।
গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, গত কয়েক বছরে প্রশ্ন ফাাঁসের ঘটনা কমেছে। ব্যাপক অভিযান, প্রশ্ন প্রণয়ন, পরিবহণ ও বিতরণ আরো নিরাপদ করায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সর্বশেষ প্রশ্ন ফাঁস হতো ডিজিটাল পদ্ধতিতে। বিশেষ করে এমসিকিউ পদ্ধতির পরীক্ষায় কেন্দ্রে প্রশ্ন দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা মাইক্রো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে বাইরে চলে যেতো। আর আরেকটি গ্রুপ তা সল্ভ করে ডিভাইসের মাধ্যমেই নির্ধারিত পরীক্ষার্থীর কাছে পাঠাতো।
আরও পড়ুন: খুলনা মেডিকেলের ১১ শিক্ষার্থীর তথ্য সিআইডিতে
‘‘তবে তার আগে পরীক্ষার একদিন, দুইদিন বা কয়েক ঘন্টা আগে প্রশ্ন ফাঁস হতো। সেটা সম্ভব হতো প্রেস থেকে বা পরিবহণের কোনো পর্যায়ে। এর সঙ্গে প্রেস বা প্রশ্নপত্রের সঙ্গে সংযুক্তদের কেউ কেউ জড়িত থাকতেন,” জানান তিনি।
তিনি বলেন, এর পেছনে আমরা তদন্তে বড় ধরনের আর্থিক লেনদেনের ঘটনাও বিভিন্ন সময় উদঘাটন করেছি।
‘‘তবে এখনো কিছু নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। আর সমস্যা হচ্ছে, নিয়োগ পরীক্ষা আইনে পাবলিক পরীক্ষা নয়। তাই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের আটক করলেও তেমন শাস্তির মুখোমুখি করা যায় না। তারা জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার প্রশ্ন ফাঁসের বাণিজ্য শুরু করে,” জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, ‘‘প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, কারণ, এর চাহিদা আছে। আর এই ফাঁসে যারা জড়িত, তারা আর্থিক দিক দিয়ে ব্যাপকভাবে লাভবান হন।”
তার কথা, ‘‘প্রশ্ন ফাঁস প্রশ্ন তৈরি থেকে, ছাপা পরিবহণ এবং বিতরণ যে-কোনো পর্যায়ে হতে পারে। তাই প্রতিটি পর্যায়ে সৎ এবং যোগ্য লোক থাকা দরকার। থাকা দরকার কঠোর মনিটরিং। সেটা না থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।”
তিনি বলেন, ‘‘শুধু সৎ হলেই চলবে না, দক্ষতাও থাকতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণাও থাকতে হবে। যেমন ধরুন যে কম্পিউটারে প্রশ্ন তৈরি হলো সেখান থেকে তা ডিলিট করলেই শেষ হয়ে যায় না। আসলে সেটা থেকে যায়। প্রিন্টারেও থেকে যায়। কোনো অনলাইন ডিভাইসেও থেকে যেতে পারে। তাই ওই প্রযুক্তি সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে কীভাবে কাজ করতে হয় তা-ও জানতে হবে।”
‘‘এই প্রশ্ল ফাঁস আমাদের বিভিন্ন পেশার ব্যক্তি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। যদি এক হাজারে এজনও ফাঁস করা প্রশ্নের মাধ্যমে চাকরি পেয়ে থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা মেডিকেলে ভর্তি হয়ে থাকেন, তাহলে সেটাও তো বিরাট আস্থাহীনতার জায়গা তৈরি করে,” বলেন শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই শিক্ষক।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ মনে করেন, অস্বীকারের সংস্কৃতি সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে। তার কথা, " প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার পর তা বার বার অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু শুরুতেই সেটা স্বীকার করে, তদন্ত করে তা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হয়তো বন্ধ করা যেতো। কিন্তু এটা অস্বীকার করায় আরো বিস্তৃত হয়েছে।”
আরও পড়ুন: ছাত্রলীগের রাজনীতিতে উত্থান থ্রি ডক্টরসের তারিমের, আটক হয়েছিলেন আগেও
তার কথা, ‘‘আগে প্রয়োজন কমিটমেন্ট। এরপর যার কাজ, তাকে দিতে হবে। শিক্ষার কাজ শিক্ষকদের দিয়ে করাতে হবে। দীর্ঘকাল একটি বিষয়ের মানোন্নয়নে কাজ করতে হবে। বার বার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে হবে না।”
এই দুইজন শিক্ষকই মনে করেন, ‘‘কিছু কোচিং সেন্টারের এটা একটা ব্যবসা। তার সব সময় প্রশ্ন ফাাঁসের চেষ্টায় থাকে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থা যদি ঠিক হতো, তাহলে কোচিং সেন্টারেরই প্রয়োজন হতো না।”
বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ পাবলিক পরীক্ষায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের শাস্তির বিধান আছে। তবে আইনে নিয়োগ পরীক্ষা পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত নয়। ফলে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় জিজিটাল বা অন্য আইনে মামলা করা হয়। প্রশ্ন ফাঁসসহ বিভিন্ন ঘটনায় ঢাকার আদালতে ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরের মামলা হয়েছে ২০০টি। ওই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৫টি মামলা। আর এর মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র একটি মামলায়। আইনের দুর্বলতার কারণেই অপরাধীদের শাস্তি দেয়া যাচ্ছে না বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ মনে করেন, আইনটি আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন। আর তদন্তও আরো দক্ষতার সঙ্গে করা উচিত, যাতে আসামিরা শেষ পর্যন্ত সাজা পায়।
তার কথা, ‘‘এই প্রশ্ন ফাঁস নিয়েও এক ধরনের রাজনীতি আছে। ঘটনা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা আছে। আবার প্রশ্ন কমিটিতে থাকা নিয়েও রাজনীতি ও তদবির আছে। ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।”
তিনি বলেন, ‘‘দায় স্বীকার করে অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আর সবাইকে এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।”