কুকুরের সত্য গল্প
- রবিউল আলম লুইপা
- প্রকাশ: ২৮ মে ২০২০, ০৭:২৪ PM , আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৪:৩০ PM
‘Dog is the only living animal who can sacrifice their life for You’
‘কুকুরের বিশ্বস্ততা নিয়ে আমরা অহরহ ঘটনা বা গল্প শুনেছি, কিন্তু আপনি জানেন কি কুকুরই একমাত্র প্রাণী যে নিজের জীবনের চেয়ে তাঁর মাস্টারকে বেশি ভালবাসে’। অবাক হয়েছেন হয়তো, কিন্তু এর চেয়েও বেশি অবাক হবেন কিছু সত্য ঘটনা পড়লে। আপনাদের সাথে ৫টি রিয়েল ডগস টেইল (কুকুরের গল্প) শেয়ার করব আজ...
১. চিয়াও বাও
চলতি বছরে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা দিয়েই শুরু করছি। ঘটনাটি ঘটেছে চিনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে। ডেইলি মেইল জানিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারিতে চীনে যখন মহামারী মারাত্মক পর্যায়ে ওই কুকুরটি তখন হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরের তাইকং হাসপাতালে তার প্রবীণ মালিকের সঙ্গে আসে। দুর্ভাগ্যবশত তার মালিক পাঁচদিনের মাথায়ই মারা যায়। মালিক মারা গেছে সেই তিন মাস আগে। বিশ্বস্ত কুকুর সেটি ‘মানতে নারাজ’। দিনের পর দিন বসে আছে হাসপাতালের লবিতে। মালিক ফিরবেন বলে…।
সাত বছর বয়সী পুরুষ মনগ্রিল কুকুরটির নতুন নাম দেয়া হয়েছে জিয়াও বাও (ছোট্ট প্রহরী)। হাসপাতালের ক্লিনার ৬৫ বছর বয়সী সু ইউসেন জানান, ‘উহানে করোনায় মৃত ৩ হাজার ৮৬৯ জনের মধ্যে কুকুরটির মালিকও একজন। তিন মাস আগে তিনি মারা যান। এরপর থেকে চিয়াও বাওকে হাসপাতাল থেকে অনেক চেষ্টা করেও সরানো যায়নি। বাধ্য হয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে খাওয়াচ্ছে।’
উহানে গত ১৩ এপ্রিল লকডাউন উঠিয়ে নেয়া হয়। নার্সরা জানিয়েছেন, ‘ছোট্ট প্রহরী’-কে কোনো সংগঠনের কাছে পাঠানোর চেষ্টা চলছে। চিয়াও বাও নিয়ে আরো জানতে পড়ুন:
(https://www.dailymail.co.uk/…/Loyal-dog-waits-Wuhan-hospita…)
২. হাচিকো
যে কুকুরের কথা না বললে বিশ্বস্ততার গল্প বলা অসম্পূর্ণ থাকে তাঁর নাম হাচিকো। সত্য এই ঘটনাটি জাপানের। ১৯২৩ সালে ইজাবুরো উনো টোকিও ইউনিভার্সিটির কৃষি বিভাগের একজন নামকরা প্রফেসর। তার আদরের কুকুরটি তার নিত্যসঙ্গী, আকিতাইনু প্রজাতির এই পশমী কুকুরের নাম হাচিকো। আদর করে প্রফেসর তাকে ডাকতেন হাচি।
প্রফেসর ইজাবুরো প্রতিদিন ট্রেনে জাপানের শিবুয়া স্টেশন থেকে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করতেন। সকালবেলা হাচিকোকে সাথে নিয়ে শিবুয়া স্টেশনে আসতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য ট্রেনে উঠতেন হাচিকে বিদায় দিয়ে। লেকচার শেষ করে বিকাল ৩টার সময় তিনি আবার ফিরে আসতেন শিবুয়া স্টেশনে, হাচি তার জন্য অপেক্ষা করতো। এরপর দুজনে মিলে হেঁটে একসাথে বাড়ি ফিরতেন। হাচির ছোট্ট পৃথিবীতে এই সময়গুলোই ছিল সত্যিই আনন্দের।
হাচিকো বাকি জীবনটা এভাবেই হয়তো কাটিয়ে দিতে পারত, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না। ১৯২৫ সালে প্রফেসর ইজাবুরো যখন ক্লাসে লেকচার দিচ্ছিলেন, সেই অবস্থাতেই তার হঠাৎ করে স্ট্রোক হয়। পরবর্তীতে হাসপাতালে নেবার পর সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এদিকে বিকাল ৩টায় হাচিকো উৎসাহ নিয়ে শিবুয়া স্টেশনে অপেক্ষা করে রইলো তাঁর মাস্টারের প্রত্যাবর্তনের জন্য, কিন্তু কেউ এলো না।
বিশ্বস্ত হাচিকো পরেরদিন ঠিক ৩টা বাজে শিবুয়া স্টেশনে গিয়ে একই জায়গায় বসে রইল। ভাবখানা এমন, প্রফেসর এখনই ট্রেন থেকে নেমে তাকে কোলে তুলে নেবে আর সে লেজ নেড়ে তাকে সম্ভাষণ জানাবে। কিন্তু প্রিয় মাস্টার আজও এলো না। কিন্তু হাচি হাল ছেড়ে দিল না। পরের ১০ বছর হাচিকো তাঁর মাস্টারের জন্য শিবুয়া স্টেশনে একই ভাবে অপেক্ষা করেছে।
একসময় প্রফেসরের ছাত্রদের কানে এই ঘটনাটি গেলো। একদিন তার একজন ছাত্র ট্রেনে চেপে শিবুয়া স্টেশনে হাচিকোকে দেখতে এলো। সেখানে হাচিকোকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। ফিরে গিয়ে সে একটি দৈনিক পত্রিকায় হাচিকোর এই প্রভুভক্ততা নিয়ে কলাম ছেপে দিল, এতে সমগ্র পৃথিবী জেনে গেলো হাচিকোর কথা। বিশ্বস্ততা আর বন্ধুবাৎসল্যের প্রতীক হিসেবে সবাই হাচির উদাহরণ দিতে লাগলো। বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন হাচিকোকে একনজর দেখার জন্য জাপানে আসতে লাগলো।
টানা ১০ বছর ধরে ঝড়-বৃষ্টি, ঠান্ডা এমনকি বার্ধক্য আর আর্থ্রাইটিসকে উপেক্ষা করে শিবুয়া স্টেশনে হাচি তাঁর মাস্টারের জন্য অপেক্ষা করে অবশেষে ১৯৩৫ সালের এক শীতল সন্ধ্যায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে প্রাকৃতিকভাবেই। তার মৃতদেহ শহরের লোকজন রাস্তায় আবিষ্কার করলো। সবাই গভীর আলিঙ্গনে তাকে বুকে তুলে নিল, তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করলো প্রফেসর ইজাবুরোর কবরের পাশেই। ১০ বছর পর প্রিয় মাস্টারকে পাশে পেয়ে হাচিকোর কেমন লাগছিল, তা আর জানা সম্ভব হয়নি।
হাচিকো সমস্ত বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছিল, তার মৃত্যুতে কেঁদেছিল হাজারো মানুষ। তার স্মরণে শহরবাসী শিবুয়া স্টেশনে একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি তৈরি করে ঠিক সেই জায়গাটায়, যেখানে সে প্রফেসরের জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করতো। তাকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘হাচিকো: এ ডগস টেইল’ চলচ্চিত্র, যা অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করে (IMD Rating 8.1/10)
হাচিকো নিয়ে আরো জানতে পড়ুন: (https://en.wikipedia.org/wiki/Hachik)
৩. ববি: দ্য ওয়ান্ডার ডগ
এবারের গল্পটা আমেরিকার অবিস্মরণীয় কুকুর ববিকে নিয়ে, যে মাস্টারের ভালবাসার টানে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছিল। ২ বছর বয়সী এই স্কচ কলি প্রজাতির কুকুরটি ছিল ফ্র্যাঙ্ক ব্রেজিয়ারের চোখের মণি।
১৯২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফ্র্যাঙ্ক ও এলিজাবেথ ব্রেজিয়ার দম্পত্তি ছুটি কাটানোর জন্য নিজ শহর সিলভারটন থেকে ইন্ডিয়ানা স্টেটের উদ্দেশ্যে গাড়ি করে বেরিয়ে পড়েন। সঙ্গে নিয়ে যান আদরের কুকুর ববি কে। কিন্তু কিভাবে যেনো ইন্ডিয়ানায় পৌঁছে ছোট্ট ববি আলাদা হয়ে গেল ফ্র্যাঙ্ক ব্রেজিয়ার থেকে। অনেক খুঁজেও ববিকে না পেয়ে ববিকে খুজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে ফ্র্যাঙ্ক-ব্রেজিয়ার সিলভারটনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন।
১৯২৪ সালের ফেব্রুয়ারির এক সকালে সিলভারটনে নিজেদের বাড়ির দরজায় আঁচড়ের শব্দে এলিজাবেথ ব্রেজিয়ার একটু যেন ভয়ই পেলেন। ধীরে ধীরে গিয়ে সদর দরজা খুলতেই যা দেখলেন তা বিশ্বাস করা যায় না। তার আদরের ববি দরজায় সটান দাঁড়িয়ে আছে! ববির অবস্থা অবশ্য খুবই খারাপ। ববির শরীর হাড্ডিসার, বিভিন্ন অংশ লোমহীন, পায়ের নখ বালি আর পাথরে লেগে ক্ষয়ে গেছে। টানা ছয় মাসেরও বেশি সময় নিয়ে প্রায় দুই হাজার ৫৫১ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়ানা থেকে সিলভারটন এসেছে ববি।
ছোট্ট এই চারপেয়ে নায়কের কথা রাতারাতি সবাই জেনে গেল। ববির অভাবনীয় কীর্তির জন্যে সে পেয়েছিল অজস্র পুরষ্কার। তার মাঝে রয়েছে অনেকগুলো মেডেল, ট্রফি, শহরের বিভিন্ন স্থানের চাবি, এমনকি দামি পাথরখচিত কলারও। ববিকে নিয়ে ‘রিপ্লি’স: বিলিভ ইট অর নট’ এ একটি লেখাও স্থান পেয়েছিল, এমনকি তার এই নায়কোচিত ভূমিকায় ববি নিজেই অভিনয় করেছিল একটি ফিল্মে।
তিন বছরের মাথায় ১৯২৭ সালে ছোট্ট সাহসী ববির মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর পোর্টল্যান্ডে পোষা প্রাণীদের কবরস্থানে তাকে কবর দেয়া হয়। সিলভারটনের মানুষ তখন তার সম্মানে একটি পোষা প্রাণীদের প্যারেডের আয়োজন করে। এরপর থেকে প্রতিবছর এই প্যারেডটি নিয়মিত হয়ে আসছে। সিলভারটন শহরে ববির ছোট্ট একটি বাড়ি এবং অবিকল ববির মতো দেখতে একটি ছোট্ট ভাস্কর্যও তৈরি করে শহরবাসী। তাকে দেয়া হয় শহরের নাগরিকের মর্যাদাও।
ববিকে নিয়ে আরো জানতে পড়ুন: (https://en.wikipedia.org/wiki/Bobbie_the_Wonder_Dog)
৪. রুসওয়ার্প
রুসওয়ার্প বাদামি-কালো রঙের ইংলিশ কলি জাতের এই কুকুরটি ছিল শহরের বাসিন্দা গ্র্যাহাম ন্যুটেলের বিশ্বস্ত সঙ্গী। ১৯৮০ সালের দিকে ইংল্যান্ডের গার্সডেল ছোট একটা রেলস্টেশনের রেললাইনকে টিকিয়ে রাখতে শহরের প্রায় ৩২ হাজার মানুষের পিটিশন সাক্ষর পায়ের থাবাও সংযুক্ত করে অংশ নেয় রুসওয়ার্প নিজেও। ১৪ বছর বয়সী রুসওয়ার্পের পায়ের ছাপকে বৈধ একটি সাক্ষর হিসেবেই পিটিশনে রাখা হয়েছিল। তবে মূল গল্প এটি নয়।
১৯৯০ সালের ২০ জানুয়ারির সুন্দর এক সকালে মাস্টার গ্র্যাহাম ন্যুটেল সঙ্গী রুসওয়ার্পকে সঙ্গে করে তার হোম টাউন বার্নলি থেকে সারাদিনের জন্যে ঘুরতে বের হন, গন্তব্য ল্যান্ড্রিনড্রড ওয়েলস। কিন্তু সেদিন সারাদিন শেষেও গ্র্যাহাম আর রুসওয়ার্প বাড়ি ফিরে এলো না। দিন গড়িয়ে যখন পরদিন সকাল হলো, তখন টনক নড়ল প্রতিবেশীদের, শুরু হলো খোঁজাখুঁজি। সপ্তাহজুড়ে পোস্টার লিফলেট ইত্যাদি বিলি করা হলো, কিন্তু গ্র্যাহাম আর রুসওয়ার্পের কোন খোজ কেউ পেল না।
এর প্রায় তিন মাস পর অবশেষে এপ্রিলের ৭ তারিখ একটি পাহাড়ি ঝর্ণার পাশে তাদের খোঁজ পাওয়া যায়। গ্র্যাহাম জীবিত ছিলেন না, কিন্তু রুসওয়ার্প বৃষ্টি আর ১১ সপ্তাহের ভয়াবহ শীত উপেক্ষা করেও মাস্টারের মৃতদেহকে পাহারা দিয়ে রেখেছিল। ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর ঠান্ডায় জর্জরিত রুসওয়ার্প মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। সে এতই দুর্বল ছিল যে, তাকে পাহাড় থেকে বয়ে নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও সে তাঁর মাষ্টারের মৃতদেহ ফেলে কোথাও যায়নি।
শহরে পর্যাপ্ত চিকিৎসার পর রুসওয়ার্প খানিকটা সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু বেঁচে থাকার ইচ্ছা বুঝি মাস্টারের সাথেই চলে গিয়েছিল তার। আর তাই অনেক সেবা-শুশ্রূষার পরও মাস্টারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার একটু পর সে-ও পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। গ্র্যাহামের কফিনটি কবরে নামানোর সময় রুসওয়ার্প করুণ গলায় যেভাবে আর্তনাদ করেছিল, গার্সডেলের বাসিন্দারা বহুদিন তা মনে রেখেছে।
রুসওয়ার্পকে নিয়ে আরো জানতে পড়ুন: (https://www.telegraph.co.uk/…/Dog-who-stayed-by-dead-master…)
৫. নাম নেই (হুমায়ুন আহমেদ পরিবারের পোষ্য)
বরেণ্য সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’-তে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তার পিতা তখন ময়মনসিংহ জেলার কোনো এক থানার ওসি। বাসভবন হিসেবে পেয়েছেন পুরনো কোনো এক জমিদার বাড়ি। চারদিকে ঝোপজঙ্গল। এক দুপুরে হুমায়ূন আহমেদ ভাই-বোন নিয়ে উঠোনে খেলছিলেন। দালানের সিঁড়িতে বসে ছিল তার সবচেয়ে ছোটভাই আহসান হাবীব (বর্তমানে প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট ও লেখক)। হঠাৎ একটি গোখরো সাপ বেরিয়ে এসে ফণা তুলে আহসান হাবীবকে ছোবল মারতে উদ্যত হয়। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
হুমায়ূন আহমেদের বাবার একটি পোষা কুকুর ছিল। কালবিলম্ব না করে কুকুরটি হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাপটির ওপর, কামড়ে ধরে সাপটির উদ্যত ফণা সমেত মাথা, কামড়ে ওটাকে ছিঁড়ে ফেলে। সাপের নিশ্চল দেহ পড়ে থাকে সিঁড়িতে, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায় শিশু আহসান হাবীব।
তিন দিন পর কুকুরটির দেহে সাপের বিষক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করে। নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে আস্তে আস্তে। একপর্যায়ে শরীরে ঘা হয়ে যায়। তীব্র যন্ত্রণায় দিন-রাত কাতরাতে থাকে কুকুরটি। সপ্তাহ খানেক এ দৃশ্য দেখে আর সহ্য করতে পারলেন না ওসি ফয়জুর রহমান আহমেদ। নিজের ব্যক্তিগত বন্দুক দিয়ে গুলি করে মেরে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলেন কুকুরটিকে।
হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন— ‘মৃত কুকুরটিকে মাটিচাপা দেয়ার পর তাঁর পিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, যে আমার পুত্রের জীবন রক্ষা করল, আমি তাকে নিজ হাতে হত্যা করলাম!’ (এখানে হুমায়ূন আহমেদের পিতার কোনো অপরাধ নেই। যদিও তিনি অপরাধবোধে ভুগছিলেন। প্রিয় কুকুরটিকে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতেই তিনি ওটাকে হত্যা করেছিলেন।)
আরো জানতে পড়ুন:
(https://bn.bdebooks.com/…/%E0%A6%86%E0%A6%AA%E0%A6%A8%E0%A…/)
৬. গেলার্ট (বোনাস গল্প)
সত্য ঘটনার পাশাপাশি এবার একটি পুরানো লোকগাঁথার বিখ্যাত একটি কুকুরের করুণ গল্প শোনা যাক। অনেক আগে উত্তর ওয়েলসের বেডগেলার্ট গ্রামে লিওয়েলিন নামে এক রাজপুত্র ছিল। তারই পোষা কুকুরের নাম গেলার্ট (জানা গেছে, ইংল্যান্ডের রাজা জন লিওয়েলিনকে উপহার হিসেবে গেলার্টকে দিয়েছেলেন)। মাস্টারের জন্য সর্বদা নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকতো গেলার্ট। আর তাই তো রাজপুত্র কখনও তাকে কাছছাড়া করতেন না, করতেন অসম্ভব আদর।
রাজপুত্র লিওয়েলিন ছিলেন খুব ভাল মাপের একজন শিকারী। শিকারে যাওয়ার সময় কখনওই গেলার্টকে রেখে যেতেন না। প্রতিটি শিকারে যাওয়ার সময় তিনি বিশেষ এক ধরনের ভেঁপু বাজাতেন, আর সেই শব্দে তার সবগুলো কুকুর বুঝে ফেলতো এটি শিকারে যাবার সংকেত। তৎক্ষণাৎ সবাই ছুটে আসতো, সেই সাথে গেলার্টও।
দুর্ভাগ্যজনক একদিন রাজপুত্র শিকারে যাওয়ার জন্য ভেঁপুতে আওয়াজ করেন। সেই আওয়াজ পেয়ে তার সব কুকুর ছুটে এল, কিন্তু কেন যেন গেলার্ট ভেঁপুর আওয়াজ খেয়াল করতে পারলো না। রাজপুত্র খানিকক্ষণ তাকে এদিক ওদিক খুঁজে মন ভার করে তাকে ছাড়াই শিকারে চলে গেলেন। প্রাসাদে রয়ে গেল তার স্ত্রী ও এক বছর বয়সী ছোট্ট ছেলে।
শিকার শেষে রাজপুত্র সন্ধ্যায় প্রাসাদে ফিরলেন। সবার প্রথমেই গেলার্ট তাকে স্বাগত জানাতে দৌড়ে এল। হঠাৎ রাজপুত্র খেয়াল করলেন, গেলার্টের সারা শরীরে আঁচড়ের চিহ্ন। চোয়াল রক্তমাখা, লাল টকটকে তাজা রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে দাঁত বেয়ে নিচে। গেলার্ট মহা উত্তেজিত আর উৎফুল্ল। অজানা আশংকায় রাজপুত্রের মন ভারি হয়ে গেল, তিনি দৌড়ে নিজ কামরায় এলেন, গেলার্টও তাকে অনুসরণ করল। কামরায় এসে তিনি আঁতকে উঠলেন, তার ছোট ছেলেটির বিছানা ওলটানো, সমস্ত কামরা লন্ডভন্ড।
কিন্তু ছোট বাচ্চাটির কোনো চিহ্নই নেই কোথাও। রাজপুত্র গেলার্টের দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর রেগে উঠলেন। নিশ্চয়ই তার অনুপস্থিতিতে জানোয়ারটা তার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে, হয়তো খেয়েও নিয়েছে। আর দেরি করলেন না, খাপ থেকে তলোয়ার বের করে তিনি উৎফুল্ল গেলার্টের হৃৎপিণ্ড বরাবর তীক্ষ্ণ তলোয়ারটি ঢুকিয়ে দিলেন। পুরো সময়টা গেলার্ট অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তাঁর মাস্টারের দিকে।
গেলার্ট যখন কাতর শব্দ করতে করতে মৃতপ্রায়, ঠিক তখন রাজপুত্র কোথায় যেন বাচ্চার একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে তিনি ছেলের বিছানাটি সরিয়ে দেখলেন, তা ছেলে হাসিমুখে শুয়ে আছে। আর ছেলেটির পাশেই বিশাল বড় এক নেকড়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে আছে। ঘটনাটি বুঝতে রাজপুত্রের এক মুহূর্তও দেরি হল না। তিনি বুঝলেন গেলার্ট আসলে নেকড়েটিকে মেরে বাচ্চাটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
আর সেই ঘটনাটি দেখাতেই মনিবের কাছে দৌড়ে গিয়েছিল সে। রাজপুত্র ছুটে গেলেন গেলার্টের কাছে, কিন্তু ততক্ষণে সে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ফেলেছে। প্রিয় কুকুরকে নিজ হাতে হত্যা করে রাজপুত্র শোকে প্রায় পাগল হয়ে গেলেন। তারপর ভগ্ন হৃদয়ে গেলার্টের মৃতদেহ তার রাজ্যের সবচাইতে উঁচু জায়গায় সমাধিস্থ করলেন, যাতে সবাই তার এই বিশ্বস্ত কুকুরের কথা জানতে পারে। এরপর থেকে গেলার্ট মানুষের মনে ও গল্পে স্থান করে নিয়েছে।
গেলার্ট কে নিয়ে আরো জানতে পড়ুন: (https://en.wikipedia.org/wiki/Gelert)
পরিবারের নির্ভরযোগ্য সদস্য আর বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে এই প্রাণীর বিকল্প নেই। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ শতাংশ পরিবার কুকুরকে তাদের পারিবারিক সদস্য হিসেবে লালন পালন করে। আর আমরা তাদের নিকৃষ্ট বলে অবজ্ঞা করি, তাঁর নাম জড়িয়ে অমানুষদের গালি দিই।
এর বাইরে ব্যতিক্রম হিসেবে ফেসবুক কেন্দ্রিক ‘ডগস লাভার অব বাংলাদেশ’ ‘রবিনহুড দ্য এনিমেল রেসকিউয়ার’ গ্রুপগুলোর বর্তমান কাজগুলো আমাদের জন্য আশার আলো দেখায়। প্রাণীকে ভালবাসুন, তারা আপনাকে রিওয়ার্ড দেবে।
তথ্যসূত্র:
www.wikipedia.org
https://roar.media/bangla/ (৩১ আগস্ট ২০১৮)
http://www.bangladesherkhabor.net (১ ডিসেম্বর, ২০১৮)
https://www.deshrupantor.com (২৬ মে, ২০২০)
https://www.dailymail.co.uk/…/Loyal-dog-waits-Wuhan-hospita… (25th May, 2020)
https://www.telegraph.co.uk/…/Dog-who-stayed-by-dead-master… ()
https://bn.bdebooks.com/…/%E0%A6%86%E0%A6%AA%E0%A6%A8%E0%A…/