লেখক-নাট্যকারদের দুর্দশা দেখে সুদে ব্যবসা শুরু করেছিলেন শেক্সপিয়ার
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২০, ১২:৪১ PM , আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২০, ১২:৪১ PM
ইংরেজি সাহিত্যের কিংবদন্তি উইলিয়াম শেক্সপিয়রের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বিশ্বের সর্বকালের শীর্ষস্থানীয় নাট্যকারদের একজন তিনি। আজ থেকে ৪০০ বছর আগে বিদায় নিয়েছিলেন। রেনাসাঁর অমর সৃষ্টি শেক্সপিয়রকে নিয়ে বলা হয় রেনেসাঁর ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদে তিনি যতটা নিষ্ঠাবান ছিলেন; ততোটা ছিলেন না সামগ্রিক মানবিকতা ধারণে সচেষ্ট।
কিন্তু আমরা ‘হ্যামলেট’ নাটকের সুবিখ্যাত সংলাপকেই যদি বিবেচনা করি তবে বলতে হবে শেক্সপিয়ার ছিলেন বড় মাপের মানবতাবাদী। প্রিন্স হ্যামলেটের অমিয় বাণী প্রমাণ করে মানুষকে শেক্সপিয়ার সৃষ্টির সেরা আসনেই দেখেছিলেন ‘মানুষ কী অপূর্ব সৃষ্টি! তার যুক্তিতে কতো মহান, কী অসীম তার কার্যকলাপ! কী সুন্দর দর্শন, কী চমৎকার তার চলন, কী অভাবনীয় তার প্রকাশ, প্রশংসাযোগ্য! মনের মতো!’
শেক্সপিয়ারের এমনি মানব প্রেম আমরা আবার দেখতে পাই ‘টেমপেস্ট’ নাটকে। মিরান্ডা মানব-বর্জিত দ্বীপ-বন্দী প্রথম যেদিন ফারদিনান্দকে দেখে, তার মানুষের প্রতি অপরিসীম উচ্ছ্বাস উথলে উঠে: ‘কী বিশ্বয়! কতো চমৎকার দর্শন মানুষে এ পৃথিবী পূর্ণ! মানুষ জাতি কতো সুন্দর! আহ্ জয় হোক নতুন বিশ্বের, কী সুন্দর মানুষে এটা পূর্ণ।’
জানা যায়, দর্শকদের মনোরঞ্জনের চাহিদা মেটাতে প্রতি সপ্তাহে প্রায় তিন-চারটে নাটক করতে হত শেক্সপিয়ারদের। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত নাট্যকারদের কমতি নেই। ছিলেন জন লিলি, জর্জ পিল, টমাস ন্যাশ, রবার্ট গ্রিন এবং সেই সময়ে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে খ্যাতির তুঙ্গে যিনি—শেক্সপিয়রের সমসাময়িক ক্রিস্টোফার মার্লো। একদিন তো ‘ইউনিভার্সিটি উইট’ রবার্ট গ্রিন, বেজায় রেগে গেলেন শেক্সপিয়ারের ওপর; গাল দিয়ে বললেন, ‘আমাদের ধার করা পালকে সজ্জিত কাক’। অথচ দু-তিন বছরের মধ্যেই ষষ্ঠ হেনরিকে নিয়ে তিনটে নাটক ও খান তিনেক কমেডি লিখে ফেলেছেন শেক্সপিয়ার। সবগুলোই হাউসফুল। আর শিক্ষা ও প্রতিভা সত্ত্বেও পয়সাকড়ির মুখ দেখেননি ইউনিভার্সিটি উইট-দের অনেকেই। কেবল স্টেজের ম্যানেজার, শেয়ার হোল্ডার আর রিচার্ড বারবেজ-এর মতো কিছু তারকা অভিনেতাই মোটা অঙ্কের অর্থ আয় করেন। আর লেখকদের প্যামফ্লেট ছাপাতে হয়। রোগে ভুগে মরতে হয়।
চোখের সামনে নাট্যকার-লেখকদের এই দৈন্যদশা দেখেছিলেন বলেই কি শেক্সপিয়ার ১৫৯৯-এ নিজে ‘লর্ড চেম্বারলেন্স মেন’ বলে নট্ট কোম্পানিতে শেয়ার কিনতে শুরু করেছিলেন? যাতে নিজের পরিশ্রমের মূল্য থেকে কেউ বঞ্চিত না করতে পারে তাঁকে? এটাও শোনা যায়, এ কারনে শেক্সপিয়র সুদে টাকা ধার দিতেন, আর কিঞ্চিৎ মামলাবাজও ছিলেন।
শেক্সপিয়ার সব মিলিয়ে সাঁইত্রিশটা নাটক লিখেছিলেন। কী নেই তাতে? যমজ চরিত্র নিয়ে মশকরা, মুখরা নারীকে বশ করা, গাধার মুখোশ পরা গেঁয়ো লোকের সঙ্গে পরিদের রানির প্রেম, বীভৎস খুন, ধর্ষণের পর জিভ এবং হাত কেটে ফেলা, মহাযুদ্ধ, রাজদ্রোহ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, ইডিপাস কমপ্লেক্সে ভুগে মা’র প্রতি বিষোদ্গার, বাবাকে নৃশংস ভাবে অন্ধ করে দেওয়া, গর্ভবতী স্ত্রীকে পরপুরুষের সঙ্গে লিপ্ত বলে সন্দেহ, কী না আছে তাতে! এই নাটকের সব চরিত্র— নায়ক, নায়িকা, ভিলেন— সবাইকেই তো তিনিই সৃষ্টি করেছিলেন। তার মানে, এই চরিত্রদের বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে তাদের মতো করে ভাবা বা ব্যবহার করা কল্পনা করতে হয়েছিল তাঁকে!
এই নিয়েই চমৎকার লিখেছেন আর্জেন্টিনার লেখক হোর্হে লুই বোর্হেস। ‘ইতিহাসে আছে যে মৃত্যুর কিছু আগে বা পরে শেক্সপিয়ার নিজেকে ঈশ্বরের সন্নিকটে দেখতে পেলেন। এবং বললেন ‘আমি, যে এত মানুষ হয়েছি, এখন, হয়তো বা বৃথাই, শুধু এক জন হতে চাই। আমি হতে চাই’। তখন ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে দিয়ে ভেসে এল ঈশ্বরের বাণী ‘হে আমার শেক্সপিয়ার, আমিও কোনও একক ব্যক্তি নই। আমি পৃথিবীটাকে স্বপ্ন দেখেছি, ঠিক যেমন তুমি স্বপ্ন দেখেছ নিজের কাজের মধ্যে। আমার স্বপ্নের অনেক ফর্মের মধ্যে তুমিও আছ। আমারই মতো যে আদতে অনেক, কিন্তু কেউ নয়’। ‘এভরিথিং অ্যান্ড নাথিং’—সেই কাহিনির নাম দিয়েছিলেন বোর্হেস।
সত্যি বলতে কী, ইংরেজ এ নাট্যকার বিশ্ব সাহিত্যে যেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন, তা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। টানটান উত্তেজনার কাহিনী, কালজয়ী সংলাপ আর শক্তিশালী চরিত্র সৃষ্টি করার মাধ্যমে তিনি পরিণত হয়েছেন সকল সময়ের সেরা নাট্যকারে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক যাকে হোমার, মিল্টন, দান্তেদের সমকাতারে বিবেচনা করা হয়। তবে সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে তাকে অনেকেই নির্দ্বিধায় বেছে নেবেন। শেক্সপিয়ারের নাটকে হত্যা, রক্ত, মৃত্যু, রহস্য, সন্দেহ, প্রতিশোধ, দ্বন্দ্ব, উৎকণ্ঠা, আধি-ভৌতিক ঘটনার চমৎকার রূপায়ণ আর মানব জীবনের অমানিশা আর আশার চূড়ান্ত বিষয়গুলো আজও দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক। নাটকগুলো নানা বর্ণ, ধর্ম, জাতের চরিত্রকে যেমন উপস্থাপন করেছে তেমনি এগুলো নানা স্থান যেমন ভেনিস, ডেনমার্ক, সাইপ্রাস, লন্ডন, স্কটল্যান্ড এমনি সব এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে যেখানে রয়েছে বিশ্বায়নের আগাম ধারণা। সমগ্র বিশ্বের নানা স্থানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নাটকগুলোর বহুমুখীতাকে করেছে বর্ণিল।
রয়াল শেক্সপিয়ার কম্পানির আর্টিস্টিক ডিরেক্টর গ্রেগরি ডোরান এই মহান সাহিত্যিক সম্পর্কে দিয়েছেন কিছু দারুণ তথ্য।
১. শেক্সপিয়ারের থিয়েটার ছিল তীব্র দুর্গন্ধময়। ১৫৯৯ সালে থমাস প্লেটার লন্ডনে নতুন প্রতিষ্ঠিত গ্লোব থিয়েটারে জুলিয়াস সিজার দেখতে গেলেন। কিন্তু সেখানে বাজে গন্ধ। পেছনে দেখলেন ১২০টি ইংলিশ মাস্টিফস জাতের কুকুর। কিছু দোকানে ছিল ভালুক ও ষাঁড়ের মাংস। অঞ্চলটি বাজে গন্ধে পূর্ণ। গ্লোব থিয়েটার আগুনে ধসে পড়ার দুই মাসের মধ্যেই কাছেই গড়ে ওঠে দ্য হোপ থিয়েটার। সেখানেও একই অবস্থা বিরাজ করতো।
২. বিখ্যাত অভিনেত্রী সারাহ বার্নহার্ডিট একবার লেডি ম্যাকবেথের মূর্তি তৈরির জন্যে মডেল হয়েছিলেন। গোয়ার স্ট্যাচু অব শেক্সপিয়ার দাঁড়িয়ে আছে স্টার্টফোর্ড-আপঅন-অ্যাভনের রয়াল শেক্সপিয়ার থিয়েটারের সামনে। এর স্তম্ভমূলে চারটি ছোট মূর্তি রয়েছে। এই চারটি ব্রোঞ্জ ফিগার শেক্সপিয়ারের সাহিত্যের ৪ উপাদান তুলে ধরেছে। প্যারিসে বুলেভার্দ মন্টপানাসের নিজ স্টুডিওতে এর ডিজাইন করেন ভাস্কর্য লর্ড রোনাল্ড গোয়ার। একদিন অভিনেত্রী সারাহ দেখা করতে গেলেন গোয়ারের সঙ্গে। সেখানে সারাহ লেডি ম্যাকবেথের বিষয়ে কথা বলেন। গোয়ারের স্ট্যাচু বসানো হয় ভবনের পাশে, সোয়ান থিয়েটারে পেছনে এবং চার্চের দিকে মুখ করে।
৩. মোজার্ট 'টেম্পেস্ট'র একটি অপেরা প্রায় লিখেই ফেলেছিলেন। সবাই জানেন যে, গিওসেপি ভার্ডি তার জীবনের বহু সময় ব্যয় করেছেন কিং লিয়ারের ওপর একটি অপেরা লেখার কাজে। কিন্তু অনেকেই জানেন না, মোজার্ট টেস্পেস্টের ওপর একটি অপেরা সংস্করণ করেছিলেন। এদিকে, ফ্রেডরিক ডিলিয়াস 'অ্যাজ ইউ লাইক ইট' নিয়েও অপেরা লিখতে চেয়েছিলেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়টি ঘটেছে মোজার্টের ক্ষেত্রে।
৪. ১৫৮৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তারিখে শেক্সপিয়ারের জমজ সন্তানকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়। তাদের নাম ছিল হ্যামনেট এবং জুডিথ। এ ঘটেছিল ক্যান্ডেলমাসের দিন। ওই দিন ঐহিত্যগতভাবে ক্রিসমাসের আলোকসজ্জা নামিয়ে ফেলা হয়। ১৫ বছর পর অর্থাৎ ১৬০০ সালের ক্যান্ডেলমাসের দিন মিডল টেম্পলে অনুষ্ঠিত হয় টুয়েলফথ নাইট। এই নাটকে অন্য দুটো জমজ বাচ্চাকে নেওয়া হয়। ওই নাটকে জাহাজডুবি হয় এবং বাচ্চারা ঢেউয়ের রাজ্যে হারিয়ে যায়। ১৫৯৬ সালের গ্রীষ্মের শেষ দিকে জুডিথের জমজ হ্যামনেট মারা যান। পরে অবশ্য ওই নাটকে দুই শিশুকে আবারো এক করেন নাটকীয় কায়দায়। বাস্তবে জুডিথ কোনদিন তার জন্মদিন পালন করেননি।
৫. ১৭৮৬ সালে রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট দ্য মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসোর নামের শেক্সপিয়ারের একটি নাটক অনুবাদ করেন। তিনি নেভা নদীর পাশে হারমিটেজ থিয়েটার নির্মাণ করেন। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় তার অনুবাদকৃত নাটক। এটাই রাশিয়ার প্রথম নাটক যার অনুপ্রেরণা ছিলেন শেক্সপিয়ার।
৬. শেক্সপিয়ারের নাটকের সবচেয়ে আনাড়ি মঞ্চায়ন ঘটে ১৬২৩ সালে। ওয়াশিংটনের ফোলজার লাইব্রেরিতে হাতে লেখা শেক্সপিয়ারের দুটো নাটকের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। কেন্টের প্লাকলেতে এটি মঞ্চায়ন করা হয় পারিবারিকভাবে। স্যার এডওয়ার্ড ডেরিং নাটকের দুটো পার্টকে নিজেই এক করে বাড়িতেই তা মঞ্চায়ন করেন।
৭. একটি বিশাল রেডউড গাছের গুঁড়ির ওপর মঞ্চায়ন হয় শেক্সপিয়ারের একটি নাটক। ১৮৪০-এর দশকে পশ্চিমে যখন স্বর্ণের খোঁজে খনিতে ব্যস্ত মানুষ, তখন গিরিখাতে শেক্সপিয়ারের নাটক মঞ্চস্থ হতো। সেখানে বিভিন্ন সেলুনে মঞ্চ তৈরি করা হতো। মাঠে ক্যানভাস এবং কাঠের কেবিন বানিয়ে নাটক মঞ্চস্থ হতো।
৮. শেক্সপিয়ারকে ‘আমাদের কবিদের তারকা’ বলে ডাকতেন জনসন। শেক্সপিয়ারের চরিত্রের নামে বহু স্যাটেলাইটের নামকরণ হলেও শেক্সপিয়ারের নামে কোনো স্যাটেলাইট করা হয়নি। ১৮৫১ সালের দিকে উইলিয়াম লাসেল গ্রহের স্যাটেলাইটগুলো নামকরণ শেক্সপিয়ারের নাটকের চরিত্রের নামে করতে থাকেন। উপগ্রহ আছে যার নাম টাইটানিয়া, ওবেরন এবং পাক। এমনকি আছে প্রোসপেরো, এরিয়েল, ক্যালিবান এবং সাইকোরাক্স (ক্যালিবানের মা)। এ সবই শেক্সপিয়ারের চরিত্র। অথচ এদের কোনো কিছুর নাম শেক্সপিয়ারের নামে করা হয়নি।
তবে রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি মাথায় রেখেছে যে, এ বছর তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আগামীতে হাবল টেলিস্কোপে কোনো বিশাল নক্ষত্র বা গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেলে তার নাম শেক্সপিয়ারের নামে করা হবে।