সুষম রহস্য উদঘাটন প্রকল্প - পর্ব ০১
- মো. মাহফুজুর রহমান
- প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১১:২৩ AM , আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১১:২৩ AM
তারা ছয়জন। রহস্যে ঘেরা কল্পনা যাদের। রোমাঞ্চ যেন সকাল-বিকাল নিত্যসঙ্গী হয়ে ধরা দেয় তাদের কাছে। তারা হল কলেজের একদল ছাত্রের দুর্দান্ত একটি সার্কেল। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় অভিযানে বেরিয়ে পড়ার যে ঝোঁক তাদের আছে, তা আমাদের কাছে অকল্পনীয়।
মোটকথা আমাদের চিন্তার বাইরে। তারা গুরুদয়াল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির কয়েকজন কিশোর। হাওর-বাওর এর অথৈ পানিতে আর দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠে যাদের শৈশব-কৈশোর গড়ে উঠেছে। ঘোলা পানির বিল-ঝিলের মাঝে যাদের সুখ-দুঃখ আর আকাশের নীল রং মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
দুরন্ত যৌবন যাদের প্রতি নিঃশ্বাসের সাথে ঝিলিক মারে। সাহস দেখে মনে হয় যেন ঐ হিমালয় পর্বতটাকে গ্রেপ্তার করে হাওড়ের পানিতে চুবিয়ে মারবে তারা! তৎকালীন অখণ্ড ভারতের বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহের ভাটির জনপদ, কিশোরগঞ্জ মহকুমা যা বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলা, তারই কাহিনি এটি।
সময়টা গত শতাব্দীর মাঝামাঝির কোন এক ভাদ্র মাস। মূল গল্প শুরু করার আগে গুলশান সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া যাক।
দলের কেন্দ্রবিন্দু হলো গুলশান। ছয় কিশোরের একটি দল। এরা সব সময় একসাথেই থাকে। কলেজের পাশেই একটি মেসে থাকে তারা। কলেজ বন্ধের দিনও তারা একসাথে ঘুরাঘুরি করে। এদের নেতা গুলশান। ডাক নাম তার গুলশান। পুরো নাম আব্দুল্লাহ খালেদ গুলশান। দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র গুলশানকে সবাই সংক্ষেপে ডাকে শানু। আর মাঝে মাঝে বলে 'ওস্তাদ'। ওস্তাদ বলার কারণ আছে। সব কাজেই সে ওস্তাদির খেল দেখিয়েই চলছে। খেলাধুলায় তার সমকক্ষ খুঁজে পাওয়া বিরল। যেমন দৌড়ে, তেমন সাঁতার কাটে। কয়েকদিন আগে নরসুন্দা নদীতে ডুব সাঁতার প্রতিযোগিতায় সে বিএসসি, বিকম আর বিএ ক্লাসের ছাত্রদের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে। ময়মনসিংহের ডিসি সাহেব স্বয়ং উপস্থিত থেকে তাকে সোনার মেডেল পরিয়ে দেন।
মারামারির বেলায় গুলশানকে চেনাই যায় না। কলেজের ছাত্র বলে মনেই হয় না। মনে হয় কিশোরগঞ্জ শহরের বড় গুন্ডা। একবার তো সে কলেজ পাড়ার কুখ্যাত গুন্ডা রবিকে মারতে মারতে নরসুন্দা নদীর পানিতে বেশ কিছুক্ষণ চেপে ধরে রেখেছিল। রবি ডিগ্রী ক্লাসে-পড়া অবস্থায় লেখাপড়ার ইস্তফা দেয়। যে রবি মাস্তানকে চার পাঁচজন মিলেও আটকাতে পারে না, সেই রবি গুলশানের হাতে যে মার খেয়েছিল সেই দৃশ্যটি এখনও সবার চোখে জীবন্ত। মাস্তানের সাইজ ছিল প্রায় দ্বিগুণ। মাস্তানের অপরাধ ছিল একটাই, সে গুলশানকে 'বেঁটে মশাই' বলে টিটকারি করেছিল। গুলশান আসলেই একটু খাটো। প্রায় পৌনে পাচঁ ফুট। গড়ন একটু প্রশস্থ। হাত দু'টো সামান্য লম্বা। কলেজের ইংরেজির শিক্ষক জনাব আশোতোষ বাবু গুলশানকে বলে "বখতিয়ার খিলজি অব টুয়েন্টি সেঞ্চুরী।" সময় পেলে সে বন্ধুদের সাথে ব্রহ্মপুত্র-নরসুন্দা আর মেঘনার তীর ধরে হেঁটে বেড়ায় দূর থেকে বহুদূর।
গুলশানের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায়। ছয়জনের দলের অন্য পাঁচজনের বাড়িই হলো ভাটি এলাকায়। তাদের পার্থক্য ঐ জায়গাতেই। গুলশান কখনও ভাটি যায়নি। হাওড় দেখিনি। একবার সেখানে যাওয়ার খুব শখ তার। লেখাপড়ায় গুলশান আরও গতিসম্পন্ন ব্যক্তি। অনেক জটিল জটিল ক্যালকুলাস সে অনায়াসেই করে ফেলে। গুলশান মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় (বর্তমান এসএসসি) হায়ার সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিল। সেবার পাকুন্দিয়া থেকে একজন ফাস্ট ক্লাস আর ষোলজন হায়ার সেকেন্ড ক্লাস পায়। আর কেউ পাশ করেনি। গুলশানের গায়ের রং মাগুরশালা। অর্থাৎ মাগুর মাছের মতো। গুলশান একটা মেয়েকে পছন্দ করে। মেয়েটির নাম আফরোজা। একটু মোটা, তবে মিষ্টি। গুলশান মাঝে- মাঝে অবাক হয় এই ভেবে যে, মেয়েটির এখনও বিয়ে হয় না কেন? আবার মাঝে মাঝে নার্ভাস হয় এই ভেবে যে, যেকোনো দিন হয়তো মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাবে। আফরোজাদের বাড়ি করিমগঞ্জের ইলইচ্চেয়ার বাজারের পাশে। ঘটনার শুরু এখান থেকেই। তবে মূল ঘটনার শুরু আরও পরে।
একদিন ভাদ্রে 'ইলশে গুঁড়ি' বৃষ্টির পর সূর্যমামা তার রৌদ্রের প্রখরতা মেলে ধরল। উত্তাপ নিয়ে ভেজা মাটি তার ভিতরের সুপ্ততাপ মুক্ত করে দিয়ে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ন্যায় শ্বাস ফেলেছিল। বায়োলজি ক্লাসের পর আফরোজা এসে গুলশান কে জিজ্ঞেস করল -
- শানু কেমন আছছ?
- হুম। বালা আছি। আমারে তুই কইরা ডাহছ কেড়ে? তোর চে (চেয়ে) বয়সে বড় অওয়ার (হওয়ার) সম্ভাবনা আছে।
- চ্যরি। তোর মেজাজ এমন খাড়া কেড়ে সব সময়? মনে হয় যেন ঠাডা ফরছে! ভাল্লুক কোহানকার!
- ভাল্লুকের দার থাইক্কেয়া (কাছ থেকে) দূরে থাহিছ। এতে তোর মঙ্গল অইব।
- হুম। এই হোন (শোন) কালফোয়া (কালকে) আমার বেয়া। তোর দাওয়াত। লগে তর পাঁচ সাগরেদকেও লইয়্যা যাইছ। বুঝছছ?
আফরোজা চলে গেল। গুলশান চুপ করে বসে রইল। বেচারা গত দু-তিন দিন যাবৎ অনেক মনোযোগ দিয়ে আফরোজার জন্য একটি চিঠি লিখেছিল। দিতে পারেননি। কয়েকটি বানান নিয়ে তার একটু সন্দেহ ছিল। কারণ, সে কয়েকটা জায়গায় বেশ কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছে। তাই এগুলোর বানান নিয়ে একটু দোটনায় ছিল। বানানগুলো হলো- 'প্রত্যুৎপন্ন', 'কিংকর্তব্যবিমূঢ়', এবং 'কুজ্ঝটিকা'। আর আফরোজা যদি বানান ভুল ধরে, তা'হলে যদি বদনাম হয়ে যায়? মান-সম্মান চলে যায়? যদি ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয়ে যায়?
আর এখন তো সেই সুযোগও নেই। এ যুগের হলে সে নিশ্চিত একটা মন-খারাপি সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কিছু একটা লিখে দিত। আপাতত সে নরসুন্দার চলমান স্রোতের দিকে তাকিয়ে তীরে বসে আছে। আফরোজাকে লেখা চিঠিটা কয়েক ভাঁজ করে ছিড়ে নদীতে ভাসিয়ে দিল। সেটা ছেঁড়ার আগেও সে ঐ বানানগুলো নিয়ে খানিকটা সময় চিন্তা করে নেয়। সেদিন বিকেলবেলা ঘন কালো মেঘলা আকাশের ন্যায় ছায়া পড়েছে শানুর চোখ-মুখে। একে একে তার সার্কেলের অন্য পাচঁ সঙ্গীও হাজির। বলতে গেলে তারা সবাই গুলশানকে এক কথায় ওস্তাদ মানে। হামিদ, আলমাস, বখতিয়ার, শহুর আলী আর দুলাল। সবাই মূলত বায়োলজির প্র্যাকটিকেল ক্লাস করে এসেছে। বিষয়টা সবাই আগেই শুনেছে। শহুর আলী একটু বেশি বাচাল। সামান্য কিছু হলেই লাফালাফি করে।
শহুর আলী বলে- ওস্তাদ শানু। প্র্যাকটিকেল ক্লাস করছ নাই যে?
শানু বলে- আজকে আমি নিজেই প্র্যাকটিকেল হয়ে গেছি। আফরোজার নাকি বেয়া (বিয়া)।
শহর আলী- হেরে আবার কেডা বিয়া করে? যে মোডা (মোটা) বিয়ের রাইতেই দুর্ঘটনা একটা ঘটবো।
সবাই হেঁসে দিল। গুলশান আচমকা একটানে শহর আলী কে নরসুন্দর গর্ভে নিক্ষেপ করল। সবাই একসাথে চিৎকার দিয়ে হাততালি দিল। এরপর আর কোন সাড়াশব্দ নেই। শহুর আলী পানিতে ডুবে মরবে না তা সবাই জানে। কারণ, এই ছয়জনের প্রত্যেকটাই হল পানির পোকা।এরা রুই, কাতলা, শিং, মাগুর আর বোয়ালের চেয়েও দ্রুত সাঁতার কাটে। প্রতিদিন গোসল করার সময় তারা নরসুন্দর বুক চিরে সাঁতরিয়ে ঐ পাড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে। সবাই কিছু একটা দেখবে বলে অপেক্ষায়। গুলশানও ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি লুকিয়ে নিয়ে অপেক্ষারত। শহুর আলীও কিছুক্ষণ ডুবে থেকে হঠাৎ পা দু'টোকে সোজা করে উপড়ে তুলে ভাসিয়ে দিল। স্থানীয় ভাষায় একে বলে 'কলাগাছ ভাসা'। অর্থাৎ, মাথা তখনও পানির নিচে আর পা দুটো সোজা লম্বভাবে পানির উপরে দণ্ডায়মান। এবার হাততালির আওয়াজ আরও দীর্ঘস্থায়ী হলো।
বক্তিয়ার বলতে লাগলো- কি কছ তোরা? আফরোজা বেগম তো আজ বিকেল পর্যন্ত প্র্যাকটিকেল ক্লাস করেছে। হের না কাল বিয়া? বিয়া হইলে আইজ কেমনে তাইনে (সে) ক্লাস করে? আইজ গায়ে হলুদ অইবো না? কত কিছুর ব্যবস্থা করার আছে যে।
দুলাল বলল- আরে রাখ। এরা ফহিন্নী। কিসের আয়োজন?
এবার গুলশান দুলালের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই দুলাল এক লাফে কয়েক হাত পেছনে সরে গেল।
এবার বকতিয়ার বলে উঠলো- আরে! এরার বাড়িতে যাইতেই তো সময় লাগে প্রায় ঘন্টা চারেক, যদি গরুর গাড়ি পাওয়া যায়। আর না অইলে যদি হাডন লাগে (হাঁটা লাগে) তাইলে তো ভোরে রওনা দিতে অইব। যাইতে যাইতে দুফুর (দুপুর)অইব! হে তো মামার বাসাতে থাইক্কেরয়া ফরে (পড়ে)। তাইলে হের যাইতে তো লাইত (রাত) অনব! কেমন কেমন জানি গোলমাল লাগতাছে। কাইল কি আসলেই হের বিয়া?
গুলশানও এখন বখতিয়ারের কথায় যুক্তি খুঁজে পেল। ইতিমধ্যে শহুর আলীও নদী থেকে উঠে এলো। গুলশানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা পাঁচজন।
হঠাৎ গুলশান জিজ্ঞেস করল- কাল কি বার রে? একজন জবাব দিল শুক্রবার। (চলবে)
(আলোচিত গল্পটি মো. মাহফুজুর রহমান স্যারের "রাজহংসী বধ" গল্পের বই থেকে নেওয়া।)
লেখক: প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালী সরকারি কলেজ।