আমাদের মেয়ে রিনি

  © সংগৃহীত

আমার একমাত্র কন্যা সন্তান রি‌নি! গতকাল সকাল থে‌কে ওকে কোথাও খুঁ‌জে পা‌চ্ছি না। ওর বয়স মাত্র চার বছর। আধো আধো ভাষায় কথা ব‌লে। ছোট ছোট পা‌য়ে নুপুর প‌রে সারা ঘরময় ছু‌টে বেড়ায়। ‌রি‌নিকে খুঁ‌জে না পে‌য়ে ওর মা পাগল প্রায়। পু‌লিশ খবর দি‌য়ে‌ছি, তারা তদন্ত কর‌ছে কিন্তু কিছু কর‌তে পার‌ছে না।

‌শেষবার রি‌নি‌কে আমাদের বা‌ড়ির পিছ‌নের মা‌ঠে আমা‌র বো‌নের মে‌য়ের সাথে খেলতে দেখা গে‌ছে। তারপর থে‌কে নি‌খোঁজ। আমার বো‌নের মে‌য়ে ঝুমা, বয়স ১৭ বছর। খুব স্মার্ট আর কিউট মে‌য়ে। ঝুমার কথা অনুসা‌রে রি‌নি‌কে নি‌য়ে খেলার সময় ওর ফোন আসে ফো‌নে কথা বল‌ার পর না‌কি রি‌নি‌কে আর দে‌খে‌নি।

‌রি‌নির মা কান্না কর‌তে কর‌তে অস্থির। বার বার জ্ঞান হারা‌চ্ছে। ওর মা খুব নরম ম‌নের। আমার নি‌জেরও খুব কান্না পা‌চ্ছে কিন্তু বাবা‌দের কাঁদ‌তে নেই। বাবারা শুধু শক্ত হ‌য়ে লড়‌তে জা‌নে। আমি কাঁদ‌লে সাথী‌কে মা‌নে রি‌নির মা‌কে থামা‌নো মুশকিল হ‌বে।

আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্র‌তিবেশী কা‌রো বাসায় খোঁজ রাখা বা‌কি নেই। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পা‌রে না। অতটু‌কো মে‌য়ে কোথায় যা‌বে? ও তো ঠিকভা‌বে কথাও বল‌তে পা‌রে না। পু‌লিশ তদন্ত ক‌রে তেমন কিছুই পা‌চ্ছে না। সবাই মি‌লে ঝুমার উপর প্রেশার দি‌চ্ছে, বি‌শেষ ক‌রে পু‌লিশরা। কারন শেষবার রি‌নি‌কে ঝুমার সা‌থে দেখা গি‌য়ে‌ছি‌ল। ঝুমা প্রথ‌মে সে কথা অস্বীকার করছি‌ল। কিন্তু পা‌শের বাসার হারুন ভাইয়া না‌কি রি‌নি‌কে ঝুমার সা‌থে মা‌ঠে খেল‌তে দেখ‌ছে। তারপর ঝুমা বলল, হ্যাঁ সে ছি‌লো ত‌বে সে ফো‌নে কথা বলার সময় রি‌নি কোথায় গে‌ছে তা দে‌খে‌নি!

পু‌লিশ ঝুমার কথায় বিশ্বাস ক‌রে‌নি বরং ওকে আইনের আওতায় নি‌য়ে জি‌জ্ঞেসাবাদ করা হ‌লো। কিন্তু ঝুমা কিছ‌ু বল‌তে নাড়াজ। আমারও ম‌নে হ‌চ্ছে ঝুমা নি‌র্দোষ। ত‌বে ল‌জিক মান‌তে নাড়াজ। আমি আমার মে‌য়ে‌কে খুঁ‌জে পে‌তে চাই সেটা যে ভা‌বেই হোক। তা‌তে অপরাধী যেই হোক শা‌স্তি তা‌কে পে‌তেই হ‌বে। ঝুমা‌কে আমি নি‌র্দোষ ম‌নে কর‌লেও ত‌বে আজ সকা‌লে পু‌লিশ যে তথ্য দি‌লো তা‌তে আমি হতভম্ব।

ঝুমার ফোন চেক ক‌রে দুজন ড্রাগ ডিলা‌রের নাম্বার পাওয়া গে‌ছে। ঝুমা‌কে কড়া জি‌জ্ঞেসাবাদ ক‌রে পাওয়া গে‌ছে ঝুমা নিয়‌মিত ড্রাগস নেয়। ড্রাগ ডিলারা না‌কি ওর কা‌ছে তিন লক্ষ টাকা পায় সেটা দি‌তে না পার‌লে ওকে তারা মে‌রে ফেল‌বে। তার জন্য তা‌দের সা‌থে ডিল ক‌রে আমার মে‌য়েটা‌কে ঝুমা তা‌দের কা‌ছে বেঁ‌চে দি‌য়ে‌ছে। কথাগু‌লো শোনার পর ম‌নে হ‌চ্ছি‌লো আমি মা‌টির নি‌চে ঢু‌কে যা‌চ্ছি। পৃ‌থিবীটা অনেকটা অন্ধকার লাগ‌ছি‌লো। ঝুমা‌কে খুন কর‌তে মন চাই‌ছে। কিন্তু ও মর‌লে আমার মে‌য়েটা‌কে তো পা‌বো না।

আজ সাত দিন হ‌তে চলল, আমার মে‌য়েটা‌কে এখনও পাই‌নি। আচ্ছা মে‌য়েটা কী খা‌চ্ছে, কী কর‌ছে? ও তো ক্ষি‌দে সহ্য কর‌তে পা‌রে না। সামান্য ক্ষি‌দে পে‌লে কান্না জু‌ড়ে দি‌তো। মে‌য়েটা‌ আমার বু‌কে না শু‌লে ঘুমা‌তে পা‌রে না। বাচ্চা মে‌য়ে মুখ ফু‌টে বল‌তেও পার‌বে না আমার ক্ষিদে পে‌য়ে‌ছে। পু‌লিশ হ‌ন্যে হ‌য়ে ড্রাগস ডিলার‌দের খুঁজ‌ছে।

আমরা আত্মীয় স্বজন মি‌লে নি‌জে‌দের মত চেষ্টা কর‌ছি। রি‌নির মা রি‌নির কথা শু‌নে অনেকটা র্নিবাক হ‌য়ে গে‌ছে। সব চেষ্টা বিফ‌লে যা‌চ্ছে। ঝুমার দেয়া তথ্য ম‌তে খুঁ‌জেও কোন লাভ হয়‌নি। পু‌লিশ ড্রাগ ডিলার‌দের এক চামচা খুঁ‌জে পে‌য়ে‌ছে কিন্তু সে তেমন কিছু তথ্য দি‌তে পা‌রে‌নি। ত‌বে সে বলল, ওরা না‌কি বাচ্চা‌দের চু‌রি ক‌রে, কিডনাপ ক‌রে বেগার মা‌ফিয়া‌দের কা‌ছে বি‌ক্রি ক‌রে দেয়। তারা না‌কি বি‌ভিন্ন কর্মব্যস্ত শহ‌রে বাচ্চা‌দের দি‌য়ে ভিক্ষা করায়।

কথাটা ভাব‌তেই বুক চি‌ড়ে কান্না বে‌রি‌য়ে আস‌ছে। আমার পরীটা যে কিনা রো‌দ সহ্য কর‌তে পা‌রে না তা‌কে দি‌য়ে ভিক্ষা করা‌বে! মানুষ কী ক‌রে এত জঘন্য হ‌তে পা‌রে! হ্যাঁ প‌া‌রে পৃ‌থি‌বী‌তে মানুষ সব‌চে‌য়ে মতমতাময়ী জীব আর সেই মানুষই ক্ষ‌নে ক্ষ‌নে রং পা‌ল্টে জা‌নোয়া‌রে রূপ নেয়। নয়ত ছোট ছোট ফে‌রেশতার মত বাচ্চা‌দের দি‌য়ে ভিক্ষা কী ক‌রে করা‌তে পা‌রে? কা‌কে বল‌বো? কী কর‌ব? চো‌খের সাম‌নে একে একে সব পথ বন্ধ হ‌তে দেখ‌ছি। কিন্তু করার মত কিছু পা‌চ্ছি না। পু‌লিশ যা‌দের ধর‌ছে তা‌দের মাধ্য‌মে ক‌য়েকটা বাচ্চা‌কে তা‌দের প‌রিবার ফি‌রে পে‌য়ে‌ছে কিন্তু আমরা আমা‌দের রি‌নি‌কে খুঁ‌জে পাই‌নি।

‌দেখ‌তে দেখ‌তে আজ তিন বছর হ‌য়ে গে‌লো। আমাদের রি‌নি হা‌রি‌য়ে গে‌ছে। অনেক খুঁ‌জেও আমার পরীটা‌কে পাই‌নি। রাস্তা ঘা‌টে চলার সময় শত শত মানুষ আর বাচ্চা‌দের ভি‌ড়ে রি‌নি‌কে খুঁ‌জি। রাস্তায় কোন বাচ্চা‌ দেখ‌লেই ছুটে তার কা‌ছে যাই ভা‌বি হয়ত আমাদের রি‌নি।

রি‌নি হারা‌নোর পর আমার স্ত্রী, প্রায় দু বছর মান‌সিক ভা‌বে অসুস্থ ছি‌লো। অনেক পাগলামী করত মে‌য়ের জন্য। বছর খা‌নিক যাবত মোটামু‌টি সুস্থ হ‌য়ে পথ শিশু‌দের নি‌য়ে টুকটাক কাজ করা শুরু কর‌ছে। ওর ধারা‌না হয়ত কখ‌নো না কখনো এদের মা‌ঝে আমা‌দের রি‌নি‌কে খুঁ‌জে পা‌বে। স‌ত্যিই কী পা‌বো? এ প্র‌শ্নের‌ উত্তর জা‌নি না।

আচ্ছা রি‌নি তো এখন বড় হ‌য়ে গে‌ছে। ওর বয়স সাত বছর হ‌য়ে গে‌ছে। আমা‌দের মে‌য়েটা কী আমা‌দের চিন‌তে পার‌বে? ওর চেহারা কী বদ‌লে গে‌ছে? ওর কি ম‌নে আছে ছোট বেলায় ও কত বিলাশীতায় ছি‌লো। ওর বাবা মা ওকে কত ভা‌লোবাস‌তো। আচ্ছা রি‌নি কি এখন সেই পরীর মত আছে? ও যখন ছোট ছি‌লো ওর মা চুল দু ভাগ ক‌রে দু সাই‌ডে ঝু‌টি ক‌রে দি‌তো। রি‌নি খিল‌খিল ক‌রে হে‌সে বলত বাবা দে‌খো আমাল মাতায় শিং।

আচ্ছা আমাদের মে‌য়েটা‌কি এখ‌নো চু‌লে ঝু‌টি ক‌রে? ওর হা‌সি মি‌ষ্টি ছি‌লো খুব। এখনও রি‌নি সুন্দর আর মি‌ষ্টি আছে? না‌কি কিছু পশু‌ত্বের আঘা‌তে মি‌টে গে‌ছে আমা‌দের মে‌য়ের মাধুর্য্যতা! মে‌য়েটা‌কে খুব দেখ‌তে ইচ্ছা করে, কো‌লে নি‌য়ে বু‌কের মা‌ঝে রাখ‌তে ইচ্ছে ক‌রে। মেয়েটা যখন কান্না করত তখন আমার বু‌কে পুতু‌লের মত মাথা দি‌য়ে রাখ‌তো। রি‌নি মা একবার ফি‌রে আয়। তো‌কে আর চো‌খের আড়াল কর‌বো না। কিন্তু আমার আর্তনাদ আমার রি‌নি শুন‌বে না।

সবার উদ্দে‌শ্যে কিছু কথা

* আপনার সন্তান‌কে চেনা বা অচেনা কা‌রো সা‌থে একা ছাড়‌বেন না। বে‌শির ভাগ শত্রু কিন্তু ঘ‌রেই থা‌কে।

* উঠ‌তি বয়‌সি ছে‌লে/মে‌য়ে‌দের প্র‌তি বাড়‌তি নজড় দি‌বেন কারন এ বয়‌সে বাচ্চা‌দের হিতাহিত জ্ঞান শুণ্য বে‌শি হয়। ভা‌লো খারা‌পের পার্থক্য বো‌ঝে কম। এ কার‌নে নেশা বা খারাপ স‌ঙ্গে জ‌ড়ি‌য়ে প‌রে।
হ্যাঁ আমার বো‌নের মে‌য়ে ঝুমা‌কে মাদক নিরাময় কে‌ন্দ্রে পা‌ঠি‌য়ে চি‌কিৎসা করা‌নো হ‌চ্ছে। সুস্থ হ‌লে তা‌কে শা‌স্তি দেয়া হ‌বে কিন্তু তা‌তে আমার রি‌নিকে ফেরৎ পা‌বো?

*আপনার সন্তান আপনার দা‌য়িত্ব। তাই বাচ্চা আর উঠ‌তি বয়‌সি সন্তা‌নের দি‌কে সবসময় কড়া নজড় রাখ‌বেন। আমা‌দের একটু সর্তকতা হয়ত রি‌নি‌দের জীবন নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচা‌বে।

আ‌মি চাইনা আমার মত আরো কা‌রো বুক খা‌লি হোক। আর কোন বাবা রা‌তের আঁধা‌রে বারান্দার রে‌লিং ধ‌রে নি‌জের সন্তা‌নের জন্য কান্না করুক! আর কোন মা মানসিক ভা‌বে অসুস্থ হোক! আর কোন রি‌নি হা‌রি‌য়ে যাক! আমি আজমীর হো‌সেন আমার স্ত্রী সাথী আর আমা‌দের একমাত্র সন্তান রি‌নি। হাজার লো‌কের ভি‌রে যা‌কে খুঁ‌জে ফি‌রি। জা‌নি না পাবো কিনা। মহান করুনাম‌য়ের কা‌ছে রোজ প্রার্থনা ক‌রি আমার রি‌নি‌কে ফি‌রে দেয়ার। আর কোন রি‌নি যে‌নো হা‌রি‌য়ে না যায় আমা‌দের মে‌য়ে রি‌নির মত।

‌বি:দ্র: উক্ত ঘটনার সমস্ত চ‌রিত্র, স্থান, কাল সম্পূর্ণ কাল্প‌নিক। কা‌রো বাস্তব জীব‌নের সা‌থে মি‌লে গেলে আন্ত‌রিকভা‌বে দুঃখীত।


সর্বশেষ সংবাদ