বই পর্যালোচনা

আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’

  © সংগৃহীত

বাংলাদেশের অগ্রণী চিন্তাবিদ ও কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা রচিত একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ। দীর্ঘ স্মৃতিচারণামূলক রচনাটি ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে বই আকারে প্রকাশের আগে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রায় চার মাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তি জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সাথে লেখকের বিভিন্ন বিষয়ে কথোপকথনসমূহের বিবরণ পাওয়া যায় এই গ্রন্থে।ছফা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মনীষা এবং চারিত্র্য প্রাঞ্জল ভাষায় ও সুচারু শৈলীতে চিত্রায়িত করেছেন। রাজ্জাকের মুখনিঃসৃত সংলাপ যতদূর সম্ভব তিনি যে ধরনের ঢাকাইয়া বুলিতে কথা বলতেন সে বুলিতেই তুলে ধরেছেন ছফা। গ্রন্থটিকে ছফার গুরুদক্ষিণা বলা হয়।

১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা বৃত্তি নিয়ে পি.এইচ.ডি করার প্রচেষ্টা চলাকালে অধ্যাপক আব্দূর রাজ্জাকের সাথে আহমদ ছফার প্রথম পরিচয়। ১৮০০-১৮৫৮ সাল পর্যন্ত বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলা সাহিত্য,সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে তার প্রভাব’ বিষয়ের উপর গবেষণার জন্য বন্ধুদের পরামর্শে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে পরিচয় এবং তারপর ক্রমেই অন্তরঙ্গতা। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের স্নেহ ছায়ায় ও দীর্ঘ সহচরে থেকে তিনি তার সম্পর্কে বলেছেন- দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা নির্মাণে, নিষ্কাম জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে প্রচলিত জনমত উপেক্ষা করে নিজের বিশ্বাসের প্রতি স্থিত থাকার ব্যাপারে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের মত আমাকে অন্য কোনো জীবিত বা মৃত মানুষ অতো প্রভাবিত করতে পারেনি। 'মনীষা কান্তি' বলে একটা কথা আছে যার মানে বুদ্ধির প্রেমে পড়া। ছফার মতে তিনি রাজ্জাক সাহেবের তীক্ষ্ণ ধীশক্তির প্রেমে পড়েছিলেন। নিত্য তার কাছে ছুটতেন ছফা, জ্ঞানের টানে। সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং সমকালীন ঘটনা প্রবাহ সবকিছু নিয়েই দুজনের মাঝে হতো বিস্তর আলোচনা, তা থেকে ঠিকরে পড়তো প্রজ্ঞার আলো।

যদ্যপি আমার গুরুতে শিষ্যের কলমে উঠে এসেছে গুরুর ব্যক্তিগত জীবন, তার দৃষ্টিতে তার সময়ের অন্যান্য কিংবদন্তীদের সম্পর্কে নানা তথ্য এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নিঁখুত পর্যবেক্ষণ।[২] রাজ্জাকের বাচনভঙ্গির একটা বিশেষত্ব ছিল, তিনি ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। পোশাক পরিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অনাড়ম্বর। বিয়ে করে সংসারী হওয়া হয়নি তার। তবে খাবার দাবারের ব্যাপারে তাকে বেশ শৌখিন হিসেবেই দেখিয়েছেন ছফা। দেশী - বিদেশী সব ধরনের খাবার নিয়ে তার আগ্রহ ছিল। সমসাময়িক ব্যক্তি এবং পরিস্থিতি নিয়ে তার নিজস্ব একটা মত ছিল। সেটা প্রকাশে তিনি অকপট ছিলেন। তার মাঝে পরোপকার করার এবং ভালো কাজে পৃষ্ঠপোষকতা দানের প্রবণতা ছিল। কারো গুণ যদি তার গোচরে আসতো ব্যক্তিগত ভাবে তাকে পছন্দ না হলেও তার গুণের কদরে তার সহযোগীতায় এগিয়ে যেতেন। জ্ঞান চর্চা এবং জ্ঞান বিকাশে তার প্রচেষ্টা ছিল নির্মোহ।

ছফা রাজ্জাকের আলোচনায় উঠে এসেছে আমাদের শিল্প, সাহিত্য এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনেকের নাম। তাদের অনেকের প্রশংসা করেছেন তিনি, অনেকের ব্যাপারে করেছেন সমালোচনা। ঈশ্বরচন্দ্র, জসীমউদ্দীন, নজরুল, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিদের প্রশংসা করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে। অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যকর্মকে তিনি মনে করতেন উপস্থাপনে আধুনিক হলেও বিষয়বস্তুতে মধ্যযুগীয় ধর্ম কেন্দ্রিক। রাজা রামমোহন রায়কে তিনি মনে করতেন না অতি বড় সমাজ সংস্কারক। তার মতে 'গৌড়ীয় ব্যাকরণ' রচনাই তার সবথেকে বড় কীর্তি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তিনি যতো বড় লেখক ততো বড় মানুষ বলতে চাননি। এমনকি তার কবিতার থেকে প্রবন্ধ নিয়ে তিনি বেশি উচ্ছ্বসিত ছিলেন এবং বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। শিল্পী জয়নুল আবেদীনের সাথে ছিল তার ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক। তাকে মনে করতেন অতি উচ্চ দরের শিল্পী। গ্রান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদের দাবারু হয়ে উঠবার পিছনে ছিল তার পৃষ্ঠপোষকতা। শিল্পী এস এম সুলতানকেও তিনি সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন ভাবে।

বাঙ্গালী মুসলিমদের একটা স্বতন্ত্র শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্যের জগৎ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন। তিনি ইসলামকে মনে করতেন না পরকাল সর্বস্ব ধর্ম। পার্থিব - পরলৌকিক দুই দিকেই ইসলামে স্বীকৃত বলে তার ধারণা। বাংলাসাহিত্যে মুসলিম সাহিত্যিকরাই প্রথমে পরলৌকিকতার বাইরে এসে সাহিত্য রচনা করেছেন বলে তিনি মত দিয়েছেন। অন্যদিকে অনেক বিখ্যাত হিন্দু সাহিত্যিক নিরপেক্ষ ভাবে সাহিত্য রচনা করতে সক্ষম হয়নি বলে তিনি মনে করেন। তার মতে পাশাপাশি বাস করার পড়েও এইসব সাহিত্যিকদের সৃষ্টিতে মুসলিমদের উপস্থিতি ৫% এর বেশি হতে পারে নি। তাই মুসলিম মানসের বিকাশে তিনি ছিলেন জিন্নাহর দ্বি-জাতী তত্ত্বের সর্মথক। তার সময়ের অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তির সাথে তার আলাপ পরিচয় ছিল। তাদের অনেকের সম্পর্কে রাজ্জাক তার মতামত প্রদান করেছেন নিঃস্পৃহ ভাবে।

বই পড়া নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল এরকম, যখন আপনি কোন বই পড়া শেষ করে সেই বইটি নিজের ভাষায় লিখতে পারবেন, তখনই কেবল বইটি ঠিকভাবে আপনার পড়া হয়েছে। যদি বইটির সারবস্তু নিজের ভাষায় লিখতে না পারেন তবে বুঝতে হবে বইটা পড়া হয়নি। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তার নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তার মতে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার উপর গুরুত্ব বাড়ানো উচিত। ডিগ্রী সর্বস্ব শিক্ষার সমালোচনা করেছেন তিনি। তার মতে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নয় শক্তিশালী 'মিডল স্কুল' পারে শিক্ষার মেরুদন্ডকে শক্ত করতে। আমাদের দেশের জনগণকে তিনি মনে করেন অনেক মেধাবী। তার মতে যদি সঠিক যত্ন নেয়া যায় তবে সম্পদে পরিণত হতে পারে সাধারণ জনগণ।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক মানুষের সাথে ছিল তার সুসম্পর্ক। এমনকি তাদের অনেকেই তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তিনি হ্যারল্ড লাস্কির সাথে পাঁচ বছর পিএইচডির থিসিস করেছেন, যদিও লাস্কির মৃত্যুর পর সেটা সম্পূর্ণ করেননি কেন তা এই বইয়ে স্পষ্ট নয়। হেনরী কিসিঞ্জারের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো ছিল। যদিও তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তিনি পছন্দ করতেন না। তবে তার জানার পরিধিকে সম্মান করতেন। নিক উইলসন তার 'এশিয়া অ্যাওয়েকস' বইটি রাজ্জাক স্যারকে উৎসর্গ করেছিলেন। নিকের সাথেও প্রফেসর রাজ্জাকের একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পেরেছিল।

যদ্যপি আমার গুরুতে লেখকের ব্যক্তিগত কিছু কিছু মতামত এবং আনুষঙ্গিক গল্প উঠে এসেছে এবং ছফার জীবন-কর্মের উপর তার গুরুর যে প্রভাব ছিল সেটা বুঝতে পারা যায়। আবদুর রাজ্জাক কেন লিখতেন না, কেন তিনি সুবিধাবাদীদের চেনার পরেও তাদের প্রশ্রয় দিতেন সেটা স্পষ্ট ভাবে বুঝা যায় নি। হয়তো ছফার কাছেও সেটা স্পষ্ট ছিল না বা বলতে চাননি।

 

সর্বশেষ সংবাদ