১৮ জুলাই ২০২৫, ১৩:১৩

১৬ জুলাইয়ের উদ্যমই ছাত্র সমাজকে ৩৬ জুলাই অবধি নিয়ে গিয়েছিল

মোহাম্মদ আলী  © টিডিসি সম্পাদিত

সেদিন বিকাল ৩টায় ষোলশহর স্টেশনে কোটা সংস্কারের দাবিতে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল। কিন্তু চট্টগ্রামের কুখ্যাত সন্ত্রাসী নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সকাল ১০টা থেকেই ষোলশহর স্টেশন দখল করে রাখে। এমনকি তারা নিজেদের অস্ত্রসজ্জিত ছবি ফেসবুকেও প্রচার করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরাও ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার মাধ্যমে রনির এই ক্যাম্পেইনে যোগ দেয়। 

হঠাৎ বেলা ১২টার দিকে ফেসবুক লাইভে এসে রাফি ঘোষণা দেয়, ‘যে যেখানে আছেন এখনই ষোলশহর আসেন।’ শিক্ষার্থীরা এ ঘোষণায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে রাসেলকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত রাফি কার সঙ্গে পরামর্শ করে নিলো?’ রাসেল আমাকে বললো- ‘ভাই আপনি ওর সাথে কথা বলেন।’ এরপর আমি রাফিকে ফোন দিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা বলি। 

তখন চট্টগ্রাম শহরে ছাত্রশিবিরের চারটি শাখার সমন্বয়ে মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি নুরুল আমিন ভাইয়ের সঙ্গে মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় সবগুলো শাখাকে তাদের সকল জনশক্তিকে নিয়ে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। 

এরপর মুরাদপুর মোড়ের আশপাশে আমরা নির্ধারিত সময় অপেক্ষা করতে থাকি। আমাদের অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ ষোলশহর ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। চকবাজার রোডের দিক থেকে ইট-পাটকেল মারতে থাকে। আমরা চাচ্ছিলাম যেকোনো মূল্যে মিছিল নিয়ে বহদ্দারহাটের দিকে চলে যেতে। আমরা যখন সন্ত্রাসীদের ধাওয়া দিই, পেছনে অক্সিজেন রোডের দিক থেকে যুবলীগের ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা গুলি করা শুরু করে। তবে আমাদের সংখ্যা বেশি হওয়াতে ওরাও টিকতে পারেনি। চলতে থাকে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। আন্দোলনের সার্বিক বিষয়গুলো তদারকি করছিলেন চবি শিবিরের সদ্য সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম ভাই।

আরও পড়ুন: ছাত্রলীগের বর্বর হামলার শিকার হয়ে পালানো শিক্ষার্থীদের জুলাইয়ের বিভীষিকার গল্প

পরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্রশিবিরের জনশক্তিরা বিভিন্ন স্থানে অংশ নেয়। বহদ্দারহাটের ওখানেই শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্ত গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। ইটপাটকেল বিপরীতে ঘাতকের গুলি এসে শান্তর দেহ এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়! এরমধ্যে দুই নাম্বার গেট এলাকায় আইআইইউসি শাখার ভাইয়েরা অবস্থান নিলে তাদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালায়। তবে পরক্ষণে আইআইইউসির শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি এবং প্রস্তুতির বিষয়টি পুরো চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। সেদিনই ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী পথচারী ফারুকও উন্মাদ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়। আহ! শহীদ ফারুক জানলোই না কেনো তাকে হত্যা করা হয়েছে। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, কোটা আর অধিকার এসব নিয়ে যাদের কোনো মাথাব্যথাই ছিল না, সেই ফারুকের কি নির্মম মৃত্যু হলো! সন্ত্রাসীরা ফারুককে আন্দোলনকারী মনে করেই হত্যা করেছিল।

এরপরেই আমরা খবর পাই ষোলশহর এলাকায় চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন। শহীদ ওয়াসিম প্রথম থেকেই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। অসীম সাহসী যুবক ওয়াসিম ১৫ জুলাই ষোলশহর থেকে লীগ তাড়াতেও অসামান্য ভূমিকা রাখে। ১৬ জুলাই আন্দোলনে আসার পূর্বে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সবাইকে দ্রুত ষোড়শহরে আসারও আহ্বান করেন তিনি। একইদিন রংপুরে শহীদ হন আবু সাঈদ। বুক পেতে গুলি বরণ করে নেওয়ার যে দৃষ্টান্ত আবু সাঈদ-শান্তরা স্থাপন করেছিলেন ১৬ জুলাই, সেই উদ্যমই ছাত্রজনতাকে ৩৬ জুলাই অবধি নিয়ে গিয়েছিলো। 

১৬ জুলাই দেশব্যাপী ৬ জন নিহত হওয়ায় ১৭ জুলাই লালদিঘীতে শহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বেলা ১টা ৩০ মিনিটে আমরা লালদিঘীতে পৌঁছাই। মাঠের চারিপাশ পর্যবেক্ষণ করি। আগে থেকেই পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। ৩টার দিকে ধীরে ধীরে মানুষ জমায়েত হতে থাকে। মুজাহিদ ভাইয়ের ইমামতিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে ছয় শহীদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

আরও পড়ুন: ১৮ জুলাই: আন্দোলন দমাতে পুলিশের গুলি, নিহত ৩১— বন্ধ ইন্টারনেট সেবা

আন্দোলন থামাতে সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধের উদ্যোগ নেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সিন্ডিকেট সভায় ১৭ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে ছাত্রদের রাত ১০টার মধ্যে এবং ছাত্রীদের সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। প্রশাসন সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক হল থেকে বের করে দেয়, অথচ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ৫ আগস্ট পর্যন্ত অস্ত্রসহ হলে অবস্থান করেছিলো। তখন প্রশাসন ছিল নীরব।

জানাজার পর সন্ধ্যায় হাটহাজারীতে বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারির বাসায় জরুরি পরামর্শ সভা শুরু হয়। চলে শেষ দুই দিনের আন্দোলনের বিশ্লেষণ। সবার মধ্যে হতাশার কারণ—ঢাবি, জাবি, রাবিতে ছাত্রলীগ হটানো গেলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো হলগুলো ছাত্রলীগের দখলে। সাবেক দায়িত্বশীলরা এর দায় আমাদের কাঁধে চাপান।

সেদিন রাত ৮:৩০টায় একসাথে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং শুরু হয়: QMT সমন্বয়কদের মিটিং, বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের পরামর্শ সভা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চল শিবিরের আন্দোলন কমিটির বিশেষ বৈঠক। যেখানে উপস্থিত ছিলেন মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি নুরুল আমিন। জুলাইয়ের প্রতিটি দিন এমনই কেটেছিলো আমাদের।

১৮ জুলাইয়ের কর্মসূচি শাহ আমানত ব্রিজ (নতুন ব্রিজ)-এ সকাল ১০টায় ঠিক করা হয়। সিদ্ধান্ত ছিল আমরা কর্মসূচি ঘোষণা করবো ১৮ জুলাই সকাল ৮টায়। যাতে সন্ত্রাসীরা বুঝে ওঠার আগেই আমরা দাঁড়াতে পারি। তবে আগে প্লেস ঘোষণা না হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই আমরা আমাদের সকল শাখাকে আগেই বলে রাখি। যাতে সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়। 

আরও পড়ুন: বুলেটের আঘাতে থেমে গেল রিকশাচালক জসিমের স্বপ্ন

শাহ আমানত ব্রিজ চত্বরে গিয়ে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। প্রায় ৩-৪শ পুলিশ। নদীর ওই পারে কয়েক প্লাটুন বিজিবি প্রস্তুত। এদিকে রেড ক্রিসেন্টের রেসকিউ টিম পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তোলে। আমাদের ভাইয়েরা আল্লাহর উপর ভরসা করে স্লোগান দিয়ে শুরু করলাম। রাস্তা অবরোধ করে শুরু হলো গগনবিদারী শ্লোগান। ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার।’

আমার সাথে একজন ছিল যার প্রায় ৮-১০টা ছররা গুলি মাথা, পিঠেসহ অনেক জায়গায় লেগে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো। কিন্তু তাকে থামাতে পারছি না। আজকে কিছু একটা করবেই। আমাকে বললো আপনি আমাকে থামাচ্ছেন কেনো? আমার ভাই আবু সাইদ শহীদ হয়েছে, আমি বসে থাকতে পারি না। বললাম আমি সমন্বয়ক। মরে গেলে লাভ কী? হাসিনা যদি থেকে যায়? সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে। পাশে থাকা ফার্মেসি থেকে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে গলির ভিতর দিয়ে দৌড়াতে থাকি। 

অলিগলি, বস্তি, গাড়ির ওয়ার্কশপ পার হয়ে সামনে আগাতে থাকি। বস্তির লোকজন পানির ব্যবস্থা করে। অনেকক্ষণ হাঁটছি, টায়ার্ড। আমার সাথে ছিল মেহেদী হাসান অন্তর আর দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র জুবায়ের (মহানগরীর সাথী)। জুবায়ের বললো, ভাই আমাদের বাসা এই দিকেই, চলেন বাসায় যাই। ওদের দুই জনের সহযোগিতা নিয়ে হাঁটতে থাকি। জুবায়েরদের বাসায় যাওয়ার পথে আন্দোলনে আসা ওই মেয়েগুলোর সাথে দেখা হয়। তুমুল আতঙ্ক নিয়ে তারা একটি বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলো। মেয়েদের একটা সিএনজিতে তুলে দেই নিরাপদে বাসায় পৌঁছতে। জুবায়েরের বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে বিশ্রাম নিলাম।

আরও পড়ুন: শরীরে ১৯০, মাথায় ৫৬ ছররা গুলি—চোখ হারিয়ে বাঁচার লড়াই শুভ বেপারীর

মিছিলের সময় আমার মোবাইল নিয়েছিলো হাবিবুল্লাহ খালেদ। কারো সাথে যোগাযোগ নেই। পরে একটা মোবাইল থেকে কল দিয়ে জানালাম আমি ঠিক আছি। বাড়িতে অন্তরের নম্বরটা দিলাম। জুবায়েরের বাবার সাথে পরিচয় হলো। কো-অপারেটিপ বুক সোসাইটিতে চাকরি করেন। বাড়ি পটুয়াখালী। দুপুরে ভালোই আদর যত্ন করলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকাল, বাসায় ফেরার পালা। জুবায়ের অক্সিজেনের উদ্দেশে একটা সিএনজি ঠিক করে দিলো। পথে শুনি বহদ্দারহাটে আবার ঝামেলা হচ্ছে। পুলিশ এবং ছাত্রলীগ সংঘবদ্ধভাবে আন্দোলনকারী জনতার উপরে নির্বিচারে গুলি করে। রাফিসহ সমন্বয়কদের বললাম যেভাবেই হোক বহদ্দারহাট থেকে সবাইকে চলে যেতে হবে।

ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বুলেট ও টিয়ারশেল শেষ হলে পুলিশ নিবৃত্ত হয়। ওইদিন প্রায় তিন শতাধিক লোক গুরুতর আহত হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া শহীদ হয়। 

পরদিন ১৮ জুলাই বহদ্দারহাটের নির্মম ঘটনা লিখে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়, সাথে ছিল ছাত্রলীগের ভাড়া করা সন্ত্রাসীরা। স্থানীয় মানুষজন সবাই নিরুপায় হয়ে বিল্ডিংয়ের গেট বন্ধ করে দেয়, যার কারণে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ ছিল না। গুলিবিদ্ধ হলে মেডিকেলে নেওয়ারও সুযোগ নেই। একাধারে গুলি চলছিল। গুলিবিদ্ধ নিথর দেহগুলো মাটিতে পড়ে ছিল।

লেখক: সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবির