আত্মহত্যা ‘ফ্যাশন’ নয়, অসুস্থতা ও অসহায়ত্ব

  © টিডিসি ফটো

আত্মহত্যা! এক ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধির নাম। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব জীবনে থাকবেই। কেউ হাটুর উপর তাল ঠুকে দু’আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে উড়িয়ে চায় জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব; কেউ নিজেকে নিঃশব্দের কারাগারে বন্দী করে নিজেই হারিয়ে যায় না ফেরার দেশে। এক গল্পের পিছনে রয়ে যায় আরেক গল্প।

তরুণ-তরুণীদের মাঝে আত্মহত্যা ও গোপন হতাশার প্রবণতা প্রবল। কেউ নিজেকে ঘুরিয়ে নিতে শেখে কেউ সে সামর্থ্যটুকুও রাখে না। বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। আত্মহত্যা এবং তা এড়িয়ে চলার নানা পরামর্শ নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং কথা সাহিত্যিক ফজলুল পলাশ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডিআইইউ প্রতিনিধি সাদিয়া তানজিলা-

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বর্তমানে তরুণ সমাজে আত্মহত্যা নামের সামাজিক ব্যাধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর কারণ কী?
ফজলুল পলাশ: আত্মহত্যার প্রবণতা অল্পবয়সী তথা তরুণদের মধ্যে বেশি। বিশ্বের সব দেশে কমবেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। আত্মহত্যার বিষয়টি নতুন নয়। তবে ইন্টারনেট ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কারণে আমরা এখন সহজেই এ খবরগুলো পেয়ে যাই। তাই এটা এখন নিয়মিত ঘটনা। বর্তমান তরুণ সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে একটি বা দুটি বিশেষ কারণ নয় একাধিক কারণ আছে। আবার এ বিষয়টি আপেক্ষিক অর্থাৎ এক একজনের কাছে আত্মহত্যার কারণের ভিন্নতা আছে।

একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে- একটা ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবাসে। এরা কেউ একজন (ছেলে/মেয়ে) তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে প্রতারণা করলো। ফলাফল আত্মহত্যা। কিন্তু সবসময়ই যে প্রতারণার শিকার আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে বিষয়টি তেমনও নয়।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সমাজবিজ্ঞানের বা মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা প্রবণতার কারণ কী?
ফজলুল পলাশ: আত্মহত্যাকে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে অবশ্যই এমিল ডুর্খেইমকে ( ১৮৫৮-১৯১৭) আলোচনায় আনতে হবে।অষ্টাদশ শতাব্দীতে সমস্ত ফ্রান্স জুড়ে বিপ্লবের কারণে চরম আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। যার প্রভাবে ওই সময় ফ্রান্স ছাড়াও ইউরোপীয় অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। সে উপলব্ধি থেকে ডুর্খেইম সুইসাইড (SUICIDE) নামে একটি বই লিখে ফেলেন। সেখানে আত্মহত্যার পেছনে দুটো প্রধান কারণ চিহ্নিত করেন।

এক. আধুনিক সমাজে সংহতির অভাব। দুই. সঠিক মূল্যবোধের অভাব। আসলে প্রকৃত অর্থে আমাদের দেশ বা পৃথিবী জুড়ে আত্মহত্যার পেছনের কারণ কিন্তু এ দুটোই। আর এ কারণ দুটোকে ঘিরে আছে আরো হাজারো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণ। মূলত সমাজ যতবেশি আধুনিক হবে, মানুষের প্রযুক্তি নির্ভরতা ও একাকীত্ব ততই বৃদ্ধি পাবে। কমে যাবে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন। ফলে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবার অবলম্বনগুলো কমতে থাকবে। যে একটা বা দুটি অবলম্বনকে আঁকড়ে সে বাঁচবে তার কোনটা যদি হারিয়ে ফেলে বা হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয় তাহলে তার মাঝে এ ভয়ংকর পথটিকেই সহজ মনে হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ মানুষরাই দেখা যায় আত্মহত্যার মত জঘন্য কাজে লিপ্ত হন এটা কতটা যুক্তিযুক্ত?
ফজলুল পলাশ: অনেকই এটাকে মূল কারণ বলে মনে করেন। তবে কথাটা আমার কাছে যৌক্তিক নয়। আমাদের সকলের মাঝে আবেগ আছে। কেউ সেটা পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ করে, কেউ করে না। যারা বেশি বেশি আবেগকে প্রকাশ করে তাদের আমরা আবেগপ্রবণ ধরে নেই। কিন্তু ঘটনা অনেকটাই উল্টো মনোবিজ্ঞানের ভাষায় প্রাথমিকভাবে আমরা ব্যক্তিত্বকে Extrovert এবং Introvert এ দুটোভাগে দেখি।মূলত Introvert দের মাঝে এ প্রবণতা বেশি হয়।

মজার একটা কথা, যদিও বিষটি ভয়ংকর তারপরও আমার উপলব্ধি প্রযুক্তি নির্ভর জীবনে আমরা সবাই এখন Introvert বা অর্ন্তরমুখী। সেদিন একটা চায়ের দোকানের সামনে দেখলাম পাঁচ বন্ধু আড্ডা দিচ্ছে। তাদের মধ্যে তিনজন গেমস একজন চ্যাটিং ও শেষের জন মুভি দেখছে। সবার পাশে চায়ের কাপ। মাঝেমধ্যে একটু কথা বলছে। তবে মূল ফোকাস মোবাইলে। কি দারুণ আড্ডা,তাই না? এখানে সোশ্যাল বন্ডিংটা কোথায়? এভাবেই বন্ধুর সাথে বন্ধুর, পরিবারের সদস্যের সাথে ব্যক্তির একটা দূরত্ব ডেকে আনছে ভয়ংকর পরিণতি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আত্মহত্যা রোধে পরিবারের ভূমিকা কী রূপ হত্তয়া উচিত মনে করেন?
ফজলুল পলাশ: অবশ্যই পরিবারের একটা বড় ও প্রধান ভূমিকা আছে। একটা শিশু পরিবারে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠে। ব্যক্তির সবচেয় বড় আবেগ, আশ্রয় ও ভালোবাসার জায়গা হলো তার পরিবার। যে পরিবারের সদস্যদের মাঝে ভালোবাসা ও সম্পর্কের গভীরতা বেশি। যে পরিবারের সদস্যরা প্রত্যেকে খোলামেলা ভাবে নিজেদের সমস্যাগুলো পরিবারের অপর সদস্যের কাছে ভাগাভাগি করতে পারে। সেসব পরিবারের সদস্যের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা কম। একজন সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে আমি বিশ্বাস করি পারিবারিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে এধরনের সমস্যা সর্বোচ্চ কমিয়ে আনা সম্ভব।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: অনেকে বলছেন বর্তমানে আত্মহত্যা একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ কী?
ফজলুল পলাশ: আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হতাশা ও কোন কিছু না পাওয়ার তীব্র মনোকষ্ট। পাশাপাশি ব্যার্থ বা সফল না হওয়ার প্রচন্ড ভীতি। আমাদের সবার মাঝে উচ্চাকাঙ্খা এবং সফলতা পাওয়ার চেষ্টা থাকে। কিন্তু অনেকেই সে কাঙ্খিত সাফল্য বা সেখান থেকে ব্যার্থ হওয়াটাকে জীবনের বড় ব্যার্থতা ভেবে নেয়। এরা ঘুরে দাঁড়ানো পরিবর্তে বেছে নেয় আত্মহত্যাকে। বর্তমান সময়ে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে মনেকরি, শর্টকাট সফল হওয়ার প্রবণতা ও প্রতিযোগিতা, নিজের অবস্থান, যোগ্যতা ও দক্ষতার চাইতেই বেশি কিছু প্রাপ্তির অসুস্থ মানসিকতা, অতিমাত্রায় হতাশা ও পারিবারিক বন্ধনের অভাব।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বর্তমানে অনেকেই আত্মহত্যার আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তার কর্মকাণ্ডের আভাস জানিয়ে দিচ্ছে। এর কারণ কি শুধুই হতাশা নাকি কোথাও এর জন্য অনুসরণ প্রিয় স্বভাববোধ কাজ করছে?

ফজলুল পলাশ: আসলে অতিরিক্ত কোনকিছুই পজিটিভ নয়। আপনি যেকোন বিষয়ের সামনে অতিরিক্ত বা মাত্রাতিরিক্ত কথাটা বসিয়ে দেন সেটা নেতিবাচক মনে হবে। আমাদের কাছে সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম এখন ফেসবুক। এছাড়াও টুইটার, ইন্সট্রগ্রামসহ আরো অনেক অ্যাপস রয়েছে।

মজার বিষয় হলো এখন আমরা কাছের বন্ধুর চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার মানুষটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ফলে আত্মহত্যার পূর্বে অনেক এমন স্ট্যাটাস দিচ্ছে। অনেকে হয়তো লাইক, কমেন্ট, ব্রেভো এমন কিছুও বলছে। আর কিছু সময় পরে সে মানুষটি আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর কাজটা করে ফেলছে। আমি মনে করি, আমাদের পরিচিতদের মাঝে এমন কোন পোস্ট যদি চোখে পড়ে তাৎক্ষণিক তাকে ফেরানোর জন্য ইতিবাচক কথা বলা উচিৎ।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আত্মহত্যাকে অনেকেই ‘ফ্যাশন’ বলে আখ্যায়িত করছেন। কেন এমন ভাবছেন তারা?
ফজলুল পলাশ: এই মনে করাটা বা এমন কথা হয়তো সোশ্যাল মিডিয়া রিলেটেড সুইসাইডের ক্ষেত্রে কেউ কেউ বলে থাকতে পারেন। তবে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। এটা ফ্যাশন নয়, বরং এক ধরনের অসুস্থতা কিংবা অসহায়ত্বও বলা যেতে পারে। যারা আত্মহত্যা করছে তার একটা টার্গেট গ্রুপ থাকে। (সেটা এক বা একাধিক ব্যক্তি হতে পারে) আত্মহত্যা করবে এমন ব্যক্তি তার ওই টার্গেট গ্রুপকে সামনে রেখেই কাজটা করে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ফজলুল পলাশ: আপনাকেও ধন্যবাদ।


সর্বশেষ সংবাদ