সাক্ষাৎকারে বোর্ড চেয়ারম্যান

প্রতি জেলায় অন্তত একটি মাদ্রাসা সরকারি হোক

  © টিডিসি ফটো

দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালনার জন্য গঠিত হয় বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। ১৯৭৮ সালের মাদ্রাসা শিক্ষা অধ্যাদেশবলে এটি স্থাপিত হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ ও মানোন্নয়নের লক্ষ্যে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার অগ্রগতি, শিক্ষা বোর্ডের নানা বিষয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা’র সাথে কথা হয়।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইরফান হক-

টিডিসি: মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিহাস সর্ম্পকে কিছু বলবেন?
প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা: এই উপমাদেশে ১৭৮০ সালে কলিকাতায় মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচলণ ঘটেছিল। তৎকালীন কতিপয় ইসলামী ইসলামী চিন্তাবিদের কল্যাণে এটা সম্ভব হয়েছিল। তারা তৎকালীন গর্ভনর ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে বিষয়টির প্রস্তাব দিলে তখন তিনি সাড়া দেয় এবং তাতে কলিকাতা মাদ্রাসার যাত্রা শুরু। এরপর বাংলা, আসাম, বিহারেও কিছু মাদ্রাসা স্থাপন হয়ে। সর্বশেষ স্বাধীনার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড স্থাপন হয়। এরপর থেকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের কার্যক্রম শুরু হয়। এই উপমহাদেশে ২৩৮ বছরের মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিহাসে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসা শিক্ষার স্বর্ণযুগ। এ সময়ের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার সিলেবাস আধুনিকায়ণ ও যুপোযোগী, মাদ্রাসার অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।

টিডিসি: বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ইতিহাস সর্ম্পকে বলবেন ?
প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা: বর্তমানে দেশে মোট ১০টি শিক্ষা বোর্ড তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড হচ্ছে একটি বিশেষায়িত বোর্ড। দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালনার জন্য গঠিত বোর্ড। এটি ১৯৭৮ সালের মাদ্রাসা শিক্ষা অধ্যাদেশবলে স্থাপিত হয়। দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ ও মানোন্নয়নের লক্ষ্যে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর দেশের সকল মাদ্রাসা পরিচালনা করে।

টিডিসি: বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের মূল কাজ কি?
প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা: বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের মূল কাজ অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডের চেয়ে কিছুটা স্বতন্ত্র। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড দেশের দাখিল এবং আলিম পর্যায়ে যতটা মাদ্রাসা রয়েছে এসবের পাবলিক পরীক্ষাগুলো পরিচালনা করে। এটা হচ্ছে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের মূল কাজ। পাশাপাশি একটি কারিকুল্যাম উইং রয়েছে। এটা অন্য কোন বোর্ডে নেই। এই উইংয়ের মাধ্যমে আরবি ও ইসলামী শিক্ষার বইগুলোর কারিকুল্যাম ও সিলেবাসও প্রণয়ন করা হয়ে থাকে।

টিডিসি: মাদ্রাসার সব স্তরের কার্যক্রম কি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড দেখে থাকে?
প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা: দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল স্তরের সব মাদ্রাসাগুলোর বিভিন্ন কার্যক্রম একটা সময় মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ছিল। ২০০৬ সাল থেকে ফাজিল ও কামিল স্তরের মাদ্রাসাগুলোর কার্যক্রম কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। এখন এসব মাদ্রাসার প্রশাসনিক দিক তারা দেখে আর আমারা পরীক্ষা পরিচালনার দিকটা দেখি। তবে ইবতেদায়ী থেকে আলিম স্তর পর্যন্ত সর্ম্পূণ কারিকুল্যাম বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড দেখে থাকে।

টিডিসি: সারাদেশে কতটি মাদ্রাসা রয়েছে?
প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা : সারাদেশে ৯ হাজার ৩৮৫টি মাদ্রাসা রয়েছে। তবে দুয়েকটি কম-বেশি হতে পারে। এসবের মধ্যে দাখিল ও আলিম স্তরের মাদ্রাসা রয়েছে। কিছু ইবতেদায়ী মাদ্রাসাও রয়েছে। তবে আমাদের স্বতন্ত্র কিছু ইবতেদায়ী মাদ্রাসা রয়েছে। একটা সময় সারাদেশে সেটি ১৬ হাজারের মতো ছিল। বর্তমানে সেটি কমতে কমতে ৭ হাজারে এসেছে।

টিডিসি: স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা কমার কারণ কি?
প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা: ১৯৮৪ সাল থেকে ইবতেদায়ী মাদ্রাসা যাত্রা শুরু । ২০০০ পর পর্যন্ত এসব মাদ্রাসা কোন আর্থিক সহযোগীতা অথবা এমপিওভুক্তি পায়নি। ২০০৮ সালের দিকে ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার জন্য ভাতা চালু করেছে। সেটার পরিমাণ মাত্র ৫০০ টাকা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সেটি ১ হাজার টাকা করেছে। পরবর্তীতে যখন ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা চালু করা হয়েছে সেটি ১ হাজার দুইশতো আসলো। এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে শিক্ষক সমাজ দাবি জানিয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে উনার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওই ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার জন্য বেতন ভাতা হয়েছে-সহকারী শিক্ষকদের ২৩ শত টাকা আর ইবতেদায়ী প্রধানদের ২৫ শত টাকা। আর এসব মাদ্রাসার সেটার জন্য নিয়ম-নিয়োগ-নীতিমালা কিছুই ছিল না। অতি সম্প্রতি ইবতেদায়ী মাদ্রাসা স্থাপন, চালুকরণ এবং পাঠদান নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এই নীতিমালা অনুসারে আমরা আবার নুতন করে ইবতেদায়ী মাদ্রাসায় পাঠ দানের ব্যবস্থা করবো। এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগীতায় করা হবে। এবং এসব মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষকরা যে ধরণের সুযোগ-সুবিধা একই রমক সুযোগ সুবিধা পাবে।

টিডিসি: দেশে কতটি সরকারি মাদ্রাসা রয়েছে?
প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা: কাগজে-কলমে ৪টি এবং বাস্তবে ৩টি। এর মধ্যে-সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা, বগুড়ার মুস্তাফাবিয়া আলিয়া মাদ্রাসা এবং ঢাকার সরকারি মাদ্রাসা ই আলিয়া মাদ্রাসা। আরেকটি হচ্ছে রাজশাহী আলিয়া মাদ্রাসা। এটি হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের দানে প্রতিষ্ঠি। বর্তমানে এখানে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল পরিচালিত হচ্ছে।

টিডিসি: দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল-কলেজ সরকারীকরণ হচ্ছে। মাদ্রাসা সরকারীকরণ নিয়ে কি ভাবছেন নীতিনির্ধারকরা?
প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা: এ কাজটি শিক্ষা অধিদপ্তরের কাজ। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি, জামিয়াতুল মুদাররেসীন এ দাবি উত্থাপন করেছে। আমারও বোর্ডেও পক্ষ থেকে বিভিন্ন ফোরামে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যদি প্রাথমিক অবস্থায় সরকারের আর্থিক সংকটের কারণে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মাদ্রাসা সরকারিকরণ করতে নাও পারে। তাহলে অন্তত প্রতিটি জেলায় একটি করে মাদ্রাসা সরকারীকণ করা হোক। আর সেটা করতে গেলে নতুন করে সেটা স্থাপন করতে হবে না। জেলায় সবচেয়ে পুরানো মাদ্রাসাকে সরকারীকরণ ঘোষণা করা যেতে পারে।

টিডিসি: মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ণ কতটুকু হয়েছে?
প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা: শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে মাদ্রাসা শিক্ষা এখন আধুনিক হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা নির্দেশনা ছিল যে, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থ্যায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করা। আমি বলবো ১০টি শিক্ষা বোর্ড থেকে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। এটিতে আমরা প্রথম স্থান অধিকার করবো। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডেও সেবাগ্রহীতাদের বোর্ডে আসতে হয় না। আমাদের সকল কাজ অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। আমাদের সিলেবাস আধুনিকায়ণ ও যুপোযোগী করা হয়েছে। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্নি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করছে। ৭৩টি মাদ্রাসায় ৫টি বিষয়ে অর্নাস কোর্স চালু রয়েছে। আমাদের ৭ হাজার মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু আছে।

টিডিসি: মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের কাজ কি?
প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা: মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের কাজটা প্রাশাসনিক। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এর আগে ‘বোর্ড’ এবং ‘অধিদপ্তরের’ দুই কাজ করতো। অধিদপ্তর সরকারের নব সৃষ্ট পদ। এখনও অধিদপ্তরের কাজ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হয়। একটা নবীন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সকল তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়।

টিডিসি: গত কয়েক বছর যাবৎ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ফল বিপর্যয় হচ্ছে। এর প্রভাব কি মাদ্রাসাগুলোতে পড়ছে?
প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা: মাদ্রাসা বের্ডে এর প্রভাব পড়েনি। অন্য বোর্ডগুলোতে এটা হয়েছে। আমাদের শিক্ষক দন্যতা রয়েছে। তারপরও আমাদের শিক্ষার্থীরা শৃঙ্খলাবোধ এবং সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ মেনে চলে। এজন্য তাদের ফলাফল অত্যন্ত ভালো। এখন পর্যন্ত দেশে যত ধরণে জঙ্গীবাদ অথবা এ ধরণের ঘটনা ঘটেছে এতে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জড়িত রয়েছে-সরকারের কোন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সেটি প্রমাণিত হয়নি।

টিডিসি: আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রফেসর এ, কে, এম, ছায়েফ উল্যা: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।


সর্বশেষ সংবাদ