১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২১:৪৬

‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ইবির প্রথম শিক্ষক হিসেবে একাত্মতা জীবনের বড় পাওয়া’

অধ্যাপক ড. এমতাজ হোসেন  © সৌজন্যে প্রাপ্ত

অধ্যাপক ড. এমতাজ। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) কলা অনুষদের ডিন হিসেবে। এছাড়াও ইউট্যাব ইবি শাখার কার্যনির্বাহী সদস্য এবং জিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় মহাসচিব তিনি। জনপ্রিয়তার ফলস্বরূপ আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলেও শিক্ষক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন বরেণ্য এই অধ্যাপক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ এবং রাজপথে নেমে ছাত্র-জনতার অন্তরের মনিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন গুণে-মানে অনন্য এই অধ্যাপক। সম্প্রতি তার কথা শুনেছেন ডেইলি ক্যাম্পাস। সেই আলাপের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো—

এই মুহূর্তে সেশনজটকে সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসা সবচেয়ে বেশি দরকার বলে মনে করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন ও ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এমতাজ হোসেন। তিনি বলেন, শিক্ষকদের অনুভব করতে হবে যে শিক্ষার্থীগুলো আমাদের এবং এদের যথাসময়ে বের করে দিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের।

‘‘যত দীর্ঘ সময় তারা সেশনজটে আটকে থাকবে ততবেশি তাদের পারিবারিক চাপ, মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, তারা না চাইলে জোর করে করা সম্ভব না। এখনকার সেশনজট নিরসনে অর্ডিন্যান্সের তোয়াক্কা না করে পরিস্থিতি বিবেচনায় কাজ করতে হবে। আইন অনুযায়ী চলতে গেলে সেশনজট বেড়ে যাবে। কারণ যেভাবে এতগুলো ক্লাস, এতগুলো ওয়ার্ক আওয়ার (একেকটি কোর্সে ক্লাসের নির্দিষ্ট সময়কাল) বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেটা মেনে চলতে গেলে চাপ আরো বাড়বে।’’

পড়ুন: এবারও মেয়েরা জিপিএ-৫ ও পাসের হারে এগিয়ে

অধ্যাপক ড. এমতাজ বলেন, ক্লাসগুলো নিয়মিত নিলে শিক্ষকেরা ক্লাসে যাওয়ার আগে নিজেরাও পড়াশোনা করে যাবে। তাদের মাথায় কাজ করবে যে আমাকে নতুন তথ্য খুঁজে নিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে। এভাবেই শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি হবে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতির সামনে প্রতিষ্ঠা করেছে আমাদের বিবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে একাউন্টটিং ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রথম দিকের যেসব ছাত্র বেরিয়েছিল; তারা দেশসেরা ছিল। তারাই দেশবাসীকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে চিনিয়েছে। তবে এই অবস্থানটা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে অবক্ষয়ের দিকে গেছে। শিক্ষককে ক্লাসমুখী করতে না পারলে আমাদের উদ্দেশ্য কখনোই অর্জিত হবে না।

আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক ১০টার বাসে এসে ২টার বাসে চলে যায়। তাহলে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যদি ৬ ঘন্টা বা ৮ ঘন্টার হয়, তাহলে সে থাকছে ৪ ঘন্টা। এতে করে ২টার পরের ক্লাসগুলো আর হয় না। শিক্ষকদের দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাসে রাখতে বা ক্লাস নেওয়ানোর ব্যবস্থা করতে ভাইস চ্যান্সেলরের পাশাপাশি ডিনদের যে ক্ষমতা তা বৃদ্ধি করতে হবে।

শিক্ষকদের রাজনীতির নামে অতিরিক্ত মাখামাখি এবং এটাকেই অধিক গুরুত্ব দেওয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান কমে গেছে বলে মনে করেন ইবির এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে আওয়ামী লীগের মধ্যেই ভিসিপন্থী ও ভিসিবিরোধী দুটো গ্রুপ হয়েছিল।

এদের দলাদলি ও ভিসির কাছে যাওয়া নিয়ে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল; যেখানে শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। একগ্রুপ চিন্তা করেছে কীভাবে ভিসির কাছে থেকে সুযোগ সুবিধাগুলো আদায় করা যায়; আরেক গ্রুপ চিন্তা করেছে কীভাবে ভিসির কাছে যাওয়া যায়। এসবের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম বা পাঠদানের যে মূল জিনিস, তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. এমতাজ

ইবি অধ্যাপক বলেন, সুবিধা পেতে পেতে আমাদের অভ্যাস এমন হয়ে গেছে যে; সুবিধাটা বন্ধ করে দিলে স্বয়ং ভাইস চ্যান্সেলরের উপরেই শিক্ষকরা ক্ষিপ্ত হবেন। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক ১০টার বাসে এসে ২টার বাসে চলে যায়। তাহলে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যদি ৬ ঘন্টা বা ৮ ঘন্টার হয়, তাহলে সে থাকছে ৪ ঘন্টা। এতে করে ২টার পরের ক্লাসগুলো আর হয় না। শিক্ষকদের দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাসে রাখতে বা ক্লাস নেওয়ানোর ব্যবস্থা করতে ভাইস চ্যান্সেলরের পাশাপাশি ডিনদের যে ক্ষমতা তা বৃদ্ধি করতে হবে।

‘‘কেননা একেকটা অনুষদের ডিনরাই সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে, তারা তদারকি করতে পারবে। একজন উপাচার্য একা একা তদারকি করে কখনোই এটা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। আমি ভেবেছিলাম শিক্ষার্থীরা অন্তত এবছরের জন্য দাবি করবে যে আমরা বৃহস্পতিবারেও ছুটি বাতিল করে ক্লাস করতে চাই, প্রয়োজনবোধে শুক্রবারেও পরীক্ষা দিতে চাই, কিন্তু এ বিষয়টি আসেনি।’’

শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে অভ্যুত্থান ঘটেছে; এর পেছনে মূল সৈনিক হচ্ছে দেশের তরুণ ছাত্রসমাজ। তারা অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেছে। আমরা বিন্দুমাত্র ভাবিনি যে; শেখ হাসিনা এত স্বল্প সময়ে এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন।

পড়ুন: আমার দেশ পত্রিকা চলতি বছরই চালু করা হবে: মাহমুদুর রহমান

ছাত্র আন্দোলনের সময়কার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে এই শিক্ষক বলেন, শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে অভ্যুত্থান ঘটেছে; এর পেছনে মূল সৈনিক হচ্ছে দেশের তরুণ ছাত্রসমাজ। তারা অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেছে। আমরা বিন্দুমাত্র ভাবিনি যে; শেখ হাসিনা এত স্বল্প সময়ে এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন। আন্দোলনে প্রথম আমি ও আল কুরআন বিভাগের নাসিরউদ্দিন মিঝি দুজন গিয়ে ওদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করি।

‘‘সেদিন ওরা মোটামুটি ২০-৩০ জন মিছিল করে শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছিল। একাত্মতা পোষণ করার পর আমার মনে হল যে, এই শিক্ষার্থীদের পাশে আমাদের সবটুকু নিয়ে দাঁড়ানো দরকার। পরদিন শুক্রবার, নামাজ শেষে ৩০-৩৫ জন ছাত্রকে নিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে একত্রিত হয়ে সরকার পতনের আন্দোলনকে বেগবান করার চেষ্টা করি।’’

আমার উপস্থিতিতে ছাত্রদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরে আসে এবং আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে আন্দোলনকে সফল করতে যা করা দরকার, তাই করার ঘোষণা দেই। সেই পরিস্থিতিতে আমি ক্যাম্পাসে ফ্যাসিবাদী সরকারবিরোধী যে শিক্ষকেরা আছেন; তাদের সাথে যোগাযোগ করে সবাইকে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করি। তারাও রাজি হয়ে পরের দিন সবাই মিলে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর কথা দেয়। পরেরদিন আমরা ফ্যাসিবাদ বিরোধী শিক্ষকেরা সবাই মিলে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াই। সেদিন আমার অনুভব হয় যে শিক্ষক হিসেবে আমি বৃহৎ একটি অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছি। 

শিক্ষকদের নিয়ে আন্দোলনে ড. এমতাজ

আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছিলেন বলে জানান ড. এমতাজ। তিনি বলেন, সেদিন রাত দশটার পর থেকেই আমার ফোনে অপরিচিত নাম্বার থেকে নানা রকম হুমকি আসতে থাকে। এক পর্যায়ে আমাকে বলা হয় যে আমরা আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোক, আপনি যদি এখান থেকে সরে না যান তাহলে আপনার প্রাণনাশ করা হতে পারে।

এরপর আমি একটু মানসিকভাবে বিচলিত হয়ে পড়ি। সেদিন রাতে আমরা ডরমেটরিতে যে শিক্ষকেরা ছিলাম তারা রুম অদলবদল করে রাত্রি যাপন করি যাতে আমাদের খুঁজে না পায়। আমরা যদি সেদিন ভয় পেয়ে সেখান থেকে চলে আসতাম তাহলে পরের দিন আমাদের স্থানত্যাগের বিষয়টি জানাজানি হত এবং আমার ছাত্ররা মানসিক মনোবল হারিয়ে ফেলত।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন অবস্থাতেই কোন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। আমরা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এই কাজটি করতে সক্ষম হয়েছি। যখন স্বৈরতান্ত্রিক শেখ হাসিনার পতন ঘটে, তখন যে বিজয় উল্লাস ছাত্র জনতার মধ্যে ছিল সেই বিজয় উল্লাস নিয়ে আবার তারা ক্যাম্পাসে ঢোকে, বিজয় মিছিল করে, আমরা সবাই মিষ্টিমুখ করি।- অধ্যাপক ড. এমতাজ

শনিবার শিক্ষার্থীদের অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচীর দিনেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী কিছু শিক্ষক, কর্মকর্তা অফিস করছিলো। ছাত্ররা তাদের অফিস করা দেখে উত্তেজিত এবং রাগান্বিত হয়ে দলবেঁধে ক্যাম্পাসে ঢুকে যায়। ছাত্ররা প্রশাসন ভবনের প্রতিটি কক্ষে গিয়ে তাদের বেরিয়ে যেতে বলছিল।

‘‘এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিলো যে তারা যেকোনো সময় ভাঙচুরে লিপ্ত হতো। প্রশাসন ভবনের ভিতরেই অগ্রণী ব্যাংকের কার্যক্রমও চলছিল। ছাত্ররা একসময় অগ্রণী ব্যাংকেও ঢুকে পরে। আমি বেশ ঝুঁকি নিয়ে প্রশাসন ভবনের প্রত্যেকটি ফ্লোর থেকে ছাত্রদের নামিয়ে দেই, অগ্রণী ব্যাংকের কলাপসিবল গেট ধরে এই ব্যাংককে রক্ষা করি।’’

ছাত্ররা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিল এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন অবস্থাতেই কোন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। আমরা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এই কাজটি করতে সক্ষম হয়েছি। পরদিন যখন স্বৈরতান্ত্রিক শেখ হাসিনার পতন ঘটে, তখন যে বিজয় উল্লাস ছাত্র জনতার মধ্যে ছিল সেই বিজয় উল্লাস নিয়ে আবার তারা ক্যাম্পাসে ঢোকে, বিজয় মিছিল করে, আমরা সবাই মিষ্টিমুখ করি।