শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের জন্যও একটি কমিশন গঠনের প্রয়োজন ছিল

অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান
অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান  © টিডিসি ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান। বর্তমানে তিনি বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক হিসেবে প্রায় চার বছর যাবত দায়িত্ব পালন করছেন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে ঢাবিতে অধ্যাপনা করা এই শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী ফোরাম, শিক্ষক সমিতি ও প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে এ শিক্ষাবিদ উচ্চশিক্ষার হালচাল, শিক্ষক-ছাত্ররাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে। গল্প-আলাপে পাঠকদের জন্য তার চুম্বক অংশ তুলে ধরছেন ইরফান এইচ সায়েম

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা সব ধরনের রাজনীতি বন্ধের বিষয়ে দাবি তুলছেন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? 

অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান: আমি প্রথমেই বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে বিশ্বের সকল শিক্ষককে আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানাই। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েরই রাজনীতি রয়েছে এবং এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার ১৯৭৩ অনুযায়ী শিক্ষকদের রাজনীতি করতে কোন বাধা নেই এবং শিক্ষকদের যে দল/গ্রুপ রয়েছে সেগুলো পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে কাজ করে।

আমি মনে করি, শিক্ষকদের কোন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নকে সামনে রেখে রাজনীতি করা উচিত নয়। ছাত্র রাজনীতি বিগত বছরগুলোতে খুবই কলুষিত ছিল। বিগত ১৫/১৬ বছরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের উত্থান দেখেছে, তাদের অত্যাচার নিপীড়ন দেখেছে। ছাত্রলীগের গেস্টরুম কালচারের মত ভয়ানক নির্যাতন ব্যবস্থা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মেনে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য আওয়ামীপন্থী এই ছাত্রসংগঠনটি সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে নানাভাবে ব্যবহার করে তাদেরকে ছাত্রলীগের দাশে পরিণত করেছিল। ফলে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এতদিন কোন অভিযোগ করতে না পারলেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। তাদের এই দাবি বা ঘোষণা অত্যন্ত যৌক্তিক। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ৮০ দশকের স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলনসহ স্বাধীনতা পরবর্তী বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা সম্পর্কে বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে উপলব্ধির ঘাটতি থাকতে পারে এবং বিগত বছরগুলিতে ছাত্রলীগের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির কারণে ছাত্ররা ক্যাম্পাসে আর ছাত্ররাজনীতি দেখতে চায় না।

তবে আমি মনে করি ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে। ছাত্ররাজনীতি না থাকলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় না। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা নানাভাবে বঞ্চিত হয়। দেশের যেকোনো ভাল কাজে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যেভাবে অবদান রাখতে পারে অন্য কোন পেশার মানুষ সেভাবে পারে না। ছাত্ররাজনীতি হতে হবে শিক্ষাবান্ধব, বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণের জন্য, কোন অবস্থাতেই কোন দলীয় লেজুড়বৃত্তির জন্য নয়। ছাত্র-শিক্ষক সকলেরই রাজনীতি হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ও শিক্ষার্থী বান্ধব। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না থাকলে প্রকৃত জনবান্ধব নেতা পাওয়ার সুযোগ কমে যায়। তাই আমরা মনে করি জুলাই বিপ্লবের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে এমন ছাত্ররাজনীতি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। বিগত ১৫ বছরের ছাত্রলীগের তাণ্ডব বিচারের আওতায় আনা হলে ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে দেশের মানুষের ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বর্তমানে শিক্ষকরা নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? 

অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান: বিগত ১৫ বছরে ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষকদের রাজনীতি শিক্ষাঙ্গনকে কিছুটা কলুষিত করেছে। ২০২৪ এর জুলাই আন্দোলনে সরকারি দলের ছাত্রদের পাশাপাশি বহু শিক্ষক স্বৈরাচারের পক্ষ অবলম্বন করেছে বিধায় ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকদের অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে সরকারপন্থী শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে সমর্থন তো করেনি বরং সরকারকে টিকানোর জন্য কাজ করেছে। এতে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের মনস্তাত্ত্বিক জায়গায়ও ঘাটতি হয়েছে। আমি মনে করি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এই ঘাটতি কমানোর জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা হওয়া উচিত এবং সেই আলোচনায় শিক্ষকদের বেশি ছাড় দিতে হবে কারণ তাদের দায় অনেক বেশি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় শিক্ষার মান বেড়েছে, নাকি দলীয় নিয়োগ হচ্ছে? 

অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান: জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরিকে আমি সাধুবাদ জানাই না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও গবেষণায় তাদের মান ধরে রাখতে পারছে না। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ বছরে অনেক বিভাগ খোলা হয়েছে যে বিভাগগুলো খোলার প্রয়োজনও ছিল না। অনেক জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক, কর্মচারী নিয়োগ একরকম বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। সরকার বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। যেটা পেরেছে সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় লোকদের চাকরি দেওয়ার এক একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। আমি মনে করি এই মুহূর্তে কিছুটা লাগাম টেনে ধরাটা জরুরি।  

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের জন্য কমিশন হয়েছে। তবে শিক্ষা সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন দরকার নেই?

অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান: শিক্ষা সংস্কারের জন্যও একটি কমিশন থাকলে ভালো হতো। একটা নিরপেক্ষ জায়গা থেকে এই সংস্কার করা উচিত। আমাদের মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয় যথেষ্ট যোগ্য মানুষ। তিনি একজন দক্ষ ও প্রজ্ঞাবান অর্থনীতিবিদ এবং সকলের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ও সৎ মানুষ। আমি মনে করি তিনি শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য যে উদ্যোগ নেবেন তা যেমন শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেবে তেমনি সার্বিকভাবে এ দেশকে এগিয়ে নিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। উত্তরণের উপায় কী? 

অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। অনেক শিক্ষক স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে কাজ করেছেন। তাদের কর্মকাণ্ড শুধু জুলাই আগস্টেই নয় তারা বিগত ১৫ বছর শিক্ষার্থীদের পক্ষে কাজ না করে যেটা করেছে তাতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ঘাটতি হয়েছে। আমার মনে হয়, এই সম্পর্কের ঘাটতিতে দায়ী শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীকে আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ছাত্র-শিক্ষক পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসা বাড়বে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: উপাচার্য নিয়োগে কেমন শিক্ষকদের দেখতে চান। আপনাকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে কীভাবে কাজ করবেন? 

অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান: বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সিলেকশনে এবার কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমানে সৎ, যোগ্য এবং অ্যাকাডেমিক ব্যক্তিত্বদেরই দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। আমি এটাকে অত্যন্ত সাধুবাদ জানাই। আমাকেও যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে মাথায় রেখে এবং শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করবো, ইনশাআল্লাহ।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটির ক্ষমতা বা দায়িত্বকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে কিনা?

অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান: শুধু উপাচার্য কেন বরং উপ-উপাচার্য, ট্রেজারারদের ক্ষমতা বা দায়িত্বকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। উপাচার্যরাই ক্ষমতাবান হবেন, বিষয়টি এমন নয়। তারা সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে সার্বিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দেশের শিক্ষকদের মানসম্মান ও মর্যাদা সমাজে আজ প্রশ্নবিদ্ধ। ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে এসব থেকে উত্তরণের জন্য কি পরামর্শ থাকবে? 

অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান: বাংলাদেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন কাঠামো এবং সুযোগ সুবিধা উভয়ই খুবই কম। এ জায়গায়ও সংস্কার আনা উচিত এবং সেই সংস্কারে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের তথ্যকে কাজে লাগানো উচিত।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence