২০২৪: ‘প্রযুক্তি’ ও ‘যুক্তি’র বছরে সিদ্ধান্ত নিন ভেবে-চিন্তে...

অধ্যাপক ড. আশিক মোসাদ্দিক এবং ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির লোগো
অধ্যাপক ড. আশিক মোসাদ্দিক এবং ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির লোগো  © সম্পাদিত

সময়ের ধারায় আবারও নতুন বছরে আলোচনায় রয়েছে বৈশ্বিক নানা ইস্যুর পাশাপাশি দেশীয় বিভিন্ন প্রেক্ষাপট। বৈশ্বিক রাজনৈতিক, অর্থনীতির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যও রয়েছে এ তালিকায়। পুরোনো বছরের নানা প্রসঙ্গের সাথে  নতুন বছর কেমন হতে পারে—দেশের উচ্চশিক্ষা, তারুণ্যের নানা দিক, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং সামাজিক বিষয়বলি? আর কীভাবেই দেশের তরুণ শিক্ষার্থীরা এসব সমস্যা পাশ কাটিয়ে অব্যাহত রাখতে পারেন নিজেদের সাফল্যধারা?

সম্প্রতি এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নতুন বছরে নানা করনীয়-বর্জনীয় নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন দেশের স্থায়ী সনদপ্রাপ্ত অন্যতম বেসরকারি উচ্চশিক্ষালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আশিক মোসাদ্দিক। ফার্মেসি বিষয়ের অধ্যাপক এবং বিশ্বের সেরা ২% বিজ্ঞানীর তালিকায় গত ২০২০ থেকে টানা পাঁচবার স্থান পাওয়া পুরোদস্তুর এ গবেষকের সঙ্গে কথা হয় সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে।

২০২৪ সালকে প্রযুক্তি ও যুক্তির বছর হিসেবে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. আশিক মোসাদ্দিক বলেন, বিগত বছরগুলো বিচার করলে আমরা বুঝতে পারবো—আমাদের প্রতিদিনের জীবনে প্রযুক্তি এসে ভর করেছে। আমাদের সকালের শুরু থেকে সন্ধ্যা, এমনকি ঘুমানোর আগ পর্যন্তও আমরা প্রযুক্তিনির্ভর থাকি। আমাদের নিত্যদিনে প্রযুক্তি একটি অতি প্রয়োজনীয় এবং সহজ জীবন ধারণের জন্য একটি আবশ্যকীয় উপাদানে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তিকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই; তাকে নিয়েই আমাদের চলতে হবে।

আরও পড়ুন: উচ্চশিক্ষায় সনদনির্ভরতা কাটিয়ে গবেষণায় জোর দিতে হবে

বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), সোশ্যাল মার্কেটিং, বিভিন্ন ধরনের অ্যাপস, কোডিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ডাটা সায়েন্স—এসব প্রযুক্তির সাথে আমাদের খাপ খাইয়ে চলতে হবে জানিয়ে এই অধ্যাপক পরামর্শ দিয়েছেন—প্রযুক্তি যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার বিষয়ে। তার মতে, প্রযুক্তি একটি মাধ্যম—এটি আমরা নিয়ন্ত্রণ করবো।

উদাহরণ হিসেবে ড. আশিক বলেন, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারের জন্য আপনাকে কোনো খরচ দিতে হয় না। কিন্তু এটি আপনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বলতে আর কোনো কিছু রাখল না। এখন আমরা হোয়াটসঅ্যাপের লোকেশন অন রেখে কথা বললে সহজেই ব্যক্তির অবস্থান জানতে পারি। ২০২৪ সালে প্রযুক্তির নানা পরিবর্তন আসবে অর্থাৎ এ খাতে একটি বড় নাড়া দিবে। সেজন্য ২০২৪-এ তরুণদের প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হতে হবে, দক্ষ হতে হবে। 

তরুণদের প্রযুক্তির নানা বিষয়ে পরামর্শের পাশাপাশি তিনি কথা বলেছেন, ২০২৪ সালে বিভিন্ন পরিবর্তনের বিষয়েও। তার মতে, চতুর্থ ও পঞ্চম শিল্প-বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বেশকিছু চাকরির বাজার শেষ হবে। প্রতিটি শিল্প বিপ্লবেই বেকারত্ব সৃষ্টি হয়। বিপরীতে নতুন নতুন চাকরির বাজার বা ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। সেজন্য তরুণদের প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে।

অধ্যাপক ড. আশিক মোসাদ্দিক। টিডিসি ফটো

তিনি বলেন, এর আগে বিগত ২০২২ এবং ২৩ সালের খারাপ দিক হচ্ছে—ভার্চুয়াল ভাইরাসের আক্রমণ এবং মনোজাগতিক নানা পরিবর্তন। সামাজিক মাধ্যমে বেশি অবস্থানের কারণে একাকিত্ব সৃষ্টি হচ্ছে—নতুন বছর ২০২৪ সালে এটি তৈরি করবে একাকিত্বের মহামারি যেন কাছে থেকেও আমরা সবাই দূরে। সেজন্য এ বছর আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের প্রযুক্তি খুব সাবধানে ব্যবহার করতে হবে, খুব যৌক্তিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

শিক্ষার বাইরে তরুণদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় বিষয়াবলি নিয়েও সতর্ক থাকতে হবে জানিয়ে এই শিক্ষকের পরামর্শ সবক্ষেত্রে অটোমেশন এবং ডিজিটালাইজেশনের কারণে ২০২৪ সালে আমাদের প্রযুক্তি নির্ভরতার বিষয়ে সতর্ক থাকবো। তার মতে, আমাদের সামনে আরও খারাপ সময় আসছে। 

প্রযুক্তি ব্যবহারের নানা বিষয়ে সতর্কতার পাশাপাশি তরুণদের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়েছেন প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার জন্য। তারুণ্যের মধ্যে বিভিন্ন হতাশার চিত্র তুলে ধরে তিনি জানান, তারুণ্যের সর্বোচ্চ অর্জন বা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে পরিবর্তন করতে হবে তারুণ্যের চিন্তাধারায়। সেজন্য আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে সর্বোচ্চ ভালো অর্জনের। প্রযুক্তিকে সাথে নিয়ে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে  আরও বেশি ইতিবাচক হওয়ার পরামর্শও এই শিক্ষকের।

আরও পড়ুন: প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের যুগ-ধারায় এগিয়ে যেতে চাই

শিক্ষার পাশাপাশি অধ্যাপক ড. আশিক মোসাদ্দিক কথা বলেছেন স্বাস্থ্য নিয়েও। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, তরুণদের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনতে । তার মতে, অতিরিক্ত আহারের কারণেই বাড়ে নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি। এছাড়া খাবার নিয়ে নানা অবিদ্যা,  ভুল ধারণা, ভেজাল খাদ্য গ্রহণ এবং অনিয়মও তারুণ্যকে পিছিয়ে রাখছে। খাদ্যে ভেজালের এ সময়কে কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এখন খাবার গ্রহণের চেয়ে এসব খাবার বর্জন করাই বড় চ্যালেঞ্জ।

অতিরিক্ত খারাপ  কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ মহামারি আকার ধারণ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন আমরা অনেক বেশি খাচ্ছি, অনেকবার খাচ্ছি। ফলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি। এখন আমাদের দিনে চার থেকে পাঁচবারও খাবার গ্রহণ হয়ে যায়; এটি বন্ধ করতে হবে, দিনে দুবার বা তিনবার পরিমিত খাবার গ্রহণ করতে পারলে খাদ্য সংক্রান্ত কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে।

২০২৪ সালে নতুন অনেক কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির পাশাপাশি দরকার হবে দক্ষ মানবসম্পদেরও। সেজন্য জোর দিতে হবে হাতে-কলমে বা কারিগরি বিভিন্ন দিকগুলো শেখার প্রতি। এখন তারুণ্যের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দক্ষতা বৃদ্ধি জানিয়ে তিনি বলেন,  এখন গণিত পাঠ কমছে, ফলে যুক্তিও কমে যাচ্ছে। গণিত ও যুক্তি তরুণদের এগিয়ে দেবে এবং এখন আরও বেশি করে গণিত শেখার পাশাপাশি শিখতে হবে জীবন যাপনের বিজ্ঞান। 

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস। ছবি: সৌজন্যে প্রাপ্ত।

তরুণরা তাদের বিশ্বাসের মাধ্যমে সবকিছু অর্জন করতে পারে জানিয়ে এই শিক্ষকের পরামর্শ তরুণদের আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হওয়ার। সমস্যার পরিবর্তে সমাধানের ভাবনা, ভাবনা থেকে বিশ্বাস এবং বিশ্বাস থেকে করণীয় পথ তৈরি হবে। কেবল তখনই সাফল্য আসবে। 

২০২৪ সালে যেসব খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে তার মধ্যে কৃষি হতে পারে অন্যতম। এ বছর বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনায় কৃষিখাতে আমাদের আরও প্রস্তুতির বছর। সবার আগে দেশ জানিয়ে অধ্যাপক ড. আশিক বলেন, এখন শিল্প খাতকে ছাপিয়ে কৃষি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিনা—এমন প্রশ্নও আসবে। কৃষিতে সর্বোচ্চ যান্ত্রিকীকরণ ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য বৈশ্বিক সংকটের কথা মাথায় রেখে কৃষিতে সর্বোচ্চ জোর দেওয়ার পরামর্শ এই অধ্যাপকের।

দীর্ঘ প্রায় এক ঘণ্টা তিরিশ মিনিটের ঘরোয়া আলোচনায় তিনি তরুণদের জন্য ২০২৪-এ বিশেষ ২৪টি পরামর্শ দিয়েছেন। সংকট, সম্ভাবনার এ সময়ে ২০২৪-এ এসব টিপস আরও সহজ করতে পারে দেশের তারুণ্যের পথচলাকে।

০১. সবাইকে আগে সালাম দিন। ২০২৪- এ যদি নিজের জন্য শান্তি ও রহমত পেতে চান তবে তা আগে অন্যকে দিতে হবে। কারণ সালামের চেয়ে ভালো দোয়া আর হয় না।

০২. নিজের শিকড়কে কখনও ভুলে যেওনা; কারণ আপন পরিচয় যত ছোটই হোক, তাই তোমার গর্ব। আমরা বাঙালি এটাই বড় পরিচয়। ২০২৪-এ অন্য কিছু সাজার চেষ্টা তোমার মুখোশ খুলে দিবে।

০৩. সব বিষয়ে এবং সব পেশায় প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করো। ২০২৪-এ নতুন প্রযুক্তি না শিখলে তুমি পিছিয়ে যাবে। এই শিক্ষায় তোমার বুদ্ধিকে আরো শানিত করবে।

০৪. অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া তোমার মধ্যে হতাশা ও একাকিত্ব তৈরি করতে পারে। তাই এর পরিমিত ও যৌক্তিক ব্যবহার তোমাকে এই মহামারি থেকে রক্ষা করবে।

০৫. এআই ও প্রোগামিং সহ নতুন প্রযুক্তির বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ তোমাকে সামনের আসনে রাখবে।

০৬. চীনা সভ্যতার ইতিহাসে ২০২৪-এ  মানব সভ্যতা নবম সাইকেলে বা পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, যা আগামী ২০ বছর চলবে। তাই এ সময় সাবধানে থাকতে হবে যেন প্রযুক্তি আমাকে নিয়ন্ত্রণ না করে।

০৭.  ২০২৪ থেকে কোনো কিছু তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিও না। ভুল হয়ে যেতে পারে। তাই একটু ভেবে-চিন্তে যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করবে।

০৮. যুক্তিতে মুক্তি—এটা সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করো। তথ্য প্রবাহের যুগে সকল কিছুর পিছনে তুমি যুক্তি প্রয়োগের সুযোগ পাবে।

০৯. ২০২৪-এ সবচেয়ে বড় পরিবর্তন তোমার খাদ্যাভাসে আনো। খারাপ কার্বোহাইড্রেড ও প্রসেসকৃত খাবারকে বাদ দিয়ে প্রাকৃতিক ফাইবারযুক্ত খাদ্যগ্রহণ বাড়াও।

১০. এ বছর যে যত বেশি ইমিউনিটি তৈরি করবে সে তত বেশি সুস্থ থাকবে—তার জন্য তোমার দেহের রেচন প্রক্রিয়াকে নিয়মিত করো এবং হাই কমোডের পরিবর্তে বাংলা প্যান ব্যবহার তোমাকে দ্বিগুণ ইমিউনিটি দিতে পারে।

১১. ভয়াবহ রোগ থেকে বাঁচতে ২০২৪-এ সঠিক জীবনাচরণ শুরু করো, যেমন রাতে অল্প আহার, এ দৃষ্টিভঙ্গি তোমাকে দীর্ঘ আয়ু প্রদানে সহায়ক হতে পারে।

১২. সকল প্রকার জুস এবং ড্রিংসকে না বলো। কোনো যুক্তিতেই এসব অখাদ্য গ্রহণ করো না।

১৩. ২০২৪-এ আয়ুর্বেদ খাদ্য গ্রহণের প্রচলন বৃদ্ধি পাবে। ফলে এক নতুন জীবনধারার সুফল সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

১৪. সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রভুকে শুকরিয়া জানাও, একটি সুন্দর শুভ দিন সূচনার জন্য। দেখবে তোমার মন ভালো হয়ে গেছে।

১৫. ২০২৪-এ পৃথিবীতে তাপমাত্রা ও  প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাবে। তাই নিজেকে হাইড্রেট রাখতে প্রচুর পানি পান করো এবং খুব ঠান্ডা পানি গ্রহণে সতর্ক থাকো।

১৬. অভিজ্ঞ মানুষের সাহচার্যে থাকো। তাদের জ্ঞান ও পরামর্শ তোমাকে সাবধান হতে সাহায্য করবে।

১৭. ভেবেচিন্তে টাকা খরচ করো—তরুণ থেকেই সঞ্চয় বা ব্যবসা তোমাকে সফল মানুষে পরিণত করবে।

১৮. বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হোন। বেশি খারাপ বন্ধুর চেয়ে কম সংখ্যক ভালো বন্ধু তোমাকে সুখী করবে।

১৯. ২০২৪-এ শিষ্টাচার শিখতে আগ্রহী হোন। এই শিক্ষা তোমাকে সঠিক পথের দিশা দিবে এবং বিকৃত রুচির পরিবর্তন আনবে।

২০. রান্না করা শিখুন—যার মাধ্যমে স্বনির্ভরতা ও পারিবারিক বন্ধুত্ব দৃঢ় হবে।

২১. পজিটিভ মাইন্ডসেট লালন করো। ইতিবাচকতাই যৌক্তিক বাস্তবতা সৃষ্টি করে যা নিজের প্রতিটি কাজ সবচেয়ে ভালো ভাবে করতে উৎসাহী করবে।

২২. তরুণ অবস্থায় সমাজসেবা করুন। অন্যের উপকার তোমাকে অপ্রত্যাশিত সাফল্য এনে দিবে।

২৩. নিজের জন্যই অন্যকে ক্ষমা করুন। ক্ষমা তোমাকে প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে সহায়তা করবে।

২৪. জীবনের মনছবি দেখো এবং  ভাবনার শক্তি অর্জনের জন্য যোগ ব্যায়াম ও মেডিটেশন করো যা তোমাকে  ভিতর থেকে বদলে দিবে।


সর্বশেষ সংবাদ