শৃঙ্খলাপরায়ণতার শিক্ষা শৈশবকাল থেকেই শুরু করা উচিত
- ড. কে এম আতিকুর রহমান
- প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৬:৫৬ PM , আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৭:৪৯ PM
বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শৃঙ্খলাপরায়ণ জাতি হচ্ছে জাপান। ব্যক্তি, পারিবারিক ও কর্মস্থলে তারা সমানভাবে শৃঙ্খলাপরায়ণ। এই মূল্যবোধের চর্চা অবশ্য চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনামেও পরিলক্ষিত হয়। তাদের সবারই সংস্কৃতি ও নৃ-তাত্বিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য বিদ্যমান।
কোভিড-১৯ হতে উত্তরণের ক্ষেত্রে চীনের সাফল্য আসে মূলত: কনফুসিয়ানিজমের কারণে। কনফুসিয়ানিজমের মূল দর্শনই হলো শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেম। জাপানিজরা তো বিশ্বকাপ ফুটবল স্টেডিয়ামে নতুন এক শৃঙ্খলা মডেল সৃষ্টি করেছেন। খেলা শেষে স্টেডিয়াম ও গ্যালারি পরিষ্কার করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। জাপানে শৈশবকাল হতে পরিবার ও বিদ্যালয়ে শিশুরা শৃঙ্খলা শিখে অত্যন্ত আগ্রহভরে। পারিবারিক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ও বিনয় শিক্ষাটাকে খুবই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বিদ্যালয়ে শিশুরা প্রবেশ করে লাইন ধরে এবং নির্ধারিত পোষাক পড়ে। প্রবেশদ্বারে শিক্ষকরা তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে গ্রহণ করে। অভ্যর্থনাদাতা ও গ্রহীতার চোখে-মুখে থাকে আনন্দের স্ফুলিঙ্গ।
শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ, ডেস্ক অথবা বেঞ্চে তারা নির্ধারিত নিয়মানুসারে বসে থাকে। ক্লাস চলাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকে পিনপতন নীরবতা (প্রশ্নোত্তর পর্ব ছাড়া)। দুপুরের খাবার ব্রেককে জাপানের বিদ্যালয়গুলো শিক্ষা-সময় হিসেবে ব্যবহার করে। লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের খাবার নিজে গ্রহণ, নির্দিষ্ট স্থানে বসে খাবার খাওয়া, তৈজসপত্র (খাবার ট্রে) নিজে পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ করা এবং ফ্লোরসহ কিচেন রুম পরিষ্কার শিশুদেরই করতে হয়। এসকল অভ্যাসের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শৃঙ্খলা শিক্ষার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা হয়ে যায়।
জাপানে প্রি-স্কুলের কিছু শিক্ষার্থী একসাথে খাবার গ্রহণ করছে
শৃঙ্খলাপরায়ণতা কি? কেন? ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের কোনো কাজ বিধি মোতাবেক, যথাসময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে ও নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য করার নামই শৃঙ্খলাপরায়ণতা। শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনের জন্যই জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া মূলত বিশ্ব দরবারে নিজেদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। শৃঙ্খলাপরায়ণতার উদাহরণ হিসেবে আমরা আরও কিছু বিষয় বিবেচনা করতে পারি। যেমন, সঠিক সময়ে খাওয়া, ঘুমানো ও ঘুম হতে ওঠা। আবার, সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে পড়তে বসা, নিজের ঘর পরিষ্কার রাখা, দরজা-জানালা খুলে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করাও শৃঙ্খলাপরায়ণতার উদাহরণ।
সকাল ৯টায় ক্লাস হলে ৮:৫০ এর মধ্যে শ্রেণিকক্ষে হাজির হয়ে খাতা, কলম, বেঞ্চ ও জানালা ঠিক করে প্রস্তুত থাকা। পরীক্ষার হলে কমপক্ষে পনেরো মিনিট পূর্বে আসন গ্রহণ করা এবং পরীক্ষার নিয়মকানুন (প্রবেশপত্রে লেখা) সম্পূর্ণরূপে মেনে চলার নামই শৃঙ্খলা। শৃঙ্খলাপরায়ণতার মাধ্যমে আত্ম-উন্নয়নের ব্যবস্থা করে একজন ব্যক্তি সফলতার শিখরে পৌঁছতে পারে। যেমন, একজন ব্যবসায়ী শৃঙ্খলার মাধ্যমে পুঁজিপতি হতে পারে। আবার শৃঙ্খলার অভাবে একজন ব্যবসায়ীকে লোকসান গুণতে হয়। যেমন, একজন ব্যবসায়ী যদি সকাল ১১টার সময় দোকান খুলে স্বাভাবিক ভাবেই ক্রেতা সেখানে কম আসবে। কারণ মানুষ অফিস-আদালত খোলার আগেই কিছু সেবা বা পণ্য ক্রয় করে অফিসে যেতে চায়। এই সময় তথা সকাল ৮টার মধ্যে যারা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান খুলবে তার প্রতি ক্রেতার আস্থা বেশী থাকবে।
একজন কর্মকর্তা সঠিক সময়ে অফিসে আসলে সেবাগ্রহীতা নিশ্চিতভাবে আস্থাশীল থাকে যে, ঐ স্যারকে ঐ সময় পাওয়া যায়। এতে অফিসারের সুনাম, প্রমোশন এবং চাকরির তৃপ্তি বেড়ে যায়। এই প্রাপ্তিগুলো তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে অনেক সমৃদ্ধি বয়ে আনে। যেমন, ঐ কর্মকর্তার সন্তান-সন্ততি, স্বামী-স্ত্রী, মা-বাবা সমাজে সুপরিচিতি বা সম্মান নিয়ে চলতে পারে। তার বৈধ আয়-রোজগারও বেড়ে যায়।
চীনে সকাল ৮টায় অফিস শুরু হয়। সকল স্টাফরা সকাল ৮টার আগেই বায়োমেট্রিক হাজিরা দিয়ে ডেস্কে বসেন। আর সেখানে কারখানাগুলোতে মালিক কাজে লেগে যান সকাল ৭টায়; অন্যান্য স্টাফরা আসে সকাল ৮টায়। মালিক, শ্রমিকদের সঙ্গে সকল কাজ করে থাকেন। শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য চীন, জাপানে জবাবদিহি করতে হয় সর্বক্ষেত্রে।
যে জবাবদিহি গ্রহণ করে, নিশ্চিতভাবে তাকে অধিক শৃঙ্খলাপরায়ণ হতে হয়। অন্যথায়, অধঃ:স্তনদের কখনো শৃঙ্খলার জন্য জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয় না। পাশ্চাত্য দেশগুলোতেও শৃঙ্খলার ঘাটতি নেই। হয়ত শৃঙ্খলাপরায়ণতার ধারাগত পার্থক্য থাকতে পারে। যেমন, ইউরোপ, আমেরিকাতে ব্যক্তিগত জীবনে কেউ ভিন্ন থাকলেও সামাজিক ও পেশাগত জীবনে শতভাগ শৃঙ্খলাপরায়ণ। ব্যক্তিগত জীবনাচার ভিন্ন হতে পারে, তবে সেটা তাদের সমাজের শৃঙ্খলারই উদাহরণ।
পেশাগত জীবনে পাশ্চাত্য জনগণের দায়িত্ব, নিয়মানুবর্তিতা, জবাবদিহিতা ও সময়ানুবর্তিতার নজীর অতুলনীয়। পাশ্চাত্য শৃঙ্খলাপরায়ণতা আইনি কাঠামো দ্বারা বিধিবদ্ধ। অন্যদিকে, প্রাচ্যের শৃঙ্খলা চর্চা অনেকটা আদর্শগত ও নৈতিক কাঠামো দ্বারা স্বীকৃত। পাশ্চাত্যের শৃঙ্খলার সাথে মানবাধিকার প্রশ্নও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অন্যদিকে, প্রাচ্যের অনেক দেশে শৃঙ্খলাপরায়ণতা মানবাধিকার দ্বারা পরিচালিত না হয়ে আদর্শ বাস্তবায়নের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়।
আমাদের মত সমাজগুলোতে শৃঙ্খলাভঙ্গ করাটাকে এক ধরনের শৃঙ্খলাপরায়ণতার চর্চা বলে মনে করা হয়। দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনেক সমাজে এটা লক্ষণীয়। আমাদের পরিবারগুলোতেই শৃঙ্খলা চর্চার বড় সংকট আছে বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে মা-বাবাই প্রধানত দায়ী। কারণ, শিশুরা মা-বাবার আচরণ দেখে দেখে শেখে। শিশুরা উপদেশ আয়ত্ত করতে পারে না। তারা যা দেখে তা-ই নিজের জীবনে চর্চা করে। পরিণত জীবনে ঐ চর্চাই নিজের অজান্তেই চর্চিত হতে থাকে।
বাবা সন্ধ্যার পরে অহেতুক ঘরে থাকে না, মা সময়-অসময় শপিং করতে বাহিরে চলে যায়। মা-বাবা অপ্রয়োজনে সত্যকে এড়িয়ে চলে; এমতাবস্থায় সন্তান একই শিক্ষায় বড় হতে থাকবে। অন্যদিকে বাবা-মা জ্ঞান চর্চা করে, শালীন পোশাকে অভ্যস্ত হলে সন্তানও এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। বাবা পেশার প্রতি দায়িত্বশীল হলে সন্তানও স্বাভাবিকভাবে দায়িত্বশীল হয়ে বেড়ে উঠবে। মা-বাবা সমাজে, অফিসে সৎ থাকলে সন্তানও বাধ্য হবে সৎ হতে। মা-বাবা যথাসময়ে খাওয়া ও ঘুমাতে গেলে সন্তানও এর বাহিরে যেতে পারে না।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, মা-বাবা যখন অফিসে দেরি করে যায়, অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত হয়, সন্তান মনে করে এটাই বুঝি শৃঙ্খলা। মা-বাবা যদি সকাল-বিকাল বন্ধু-বান্ধব নিয়ে অর্থহীন আড্ডায় মত্ত থাকে, সন্তানও ঘন ঘন বাহিরে যেতে, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডায় মত্ত হওয়ার বৈধতা পেয়ে যায়। বাবা-মায়ের প্রতারণামূলক আচরণ, বকধার্মিকতা আমাদের সমাজের অনেকের মাঝে থাকার কারণে সন্তানও এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। অসৎ বাবার সৎ উপদেশ সন্তানদের মাঝে বিরক্তি তৈরি করে। আবার সৎ বাবার মেজাজি স্বভাবও সন্তানকে ভালো ফলের শিক্ষা দেয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শিশুদেরকে শৃঙ্খলা শিক্ষার পথে অনেক ক্ষেত্রে বাঁধা তৈরি করছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শৃঙ্খলার যেমন মূল্য দেওয়া হয় না; পারিবারিক শিক্ষায়ও তেমন দৈন্য লক্ষ্য করা যায়। বাবা ফোনকলে মিথ্যা বলছে, প্রতারণা করছে, তদবির বাণিজ্য করছে; সেই পরিবারে সন্তান কেমন করে শৃঙ্খলাপরায়ণতার শিক্ষা পাবে?
বিদ্যালয়ে শিক্ষক যদি ক্লাস না নেন, ক্লাসে সঠিক সময়ে না আসেন, সঠিক পড়াটা না পড়ান, শিক্ষার্থী আকাশ হতে শৃঙ্খলা শিক্ষা পাবে? শিক্ষকের আচরণই শিক্ষার্থীর ৫০% শৃঙ্খলার শিক্ষা সরবরাহ করে। প্রতিদিন ক্লাসে দেরিতে এসে সুন্দর কথা বললেও ছাত্ররা ঐ শিক্ষকের কথা গ্রহণ করবে না। এটা মানবপ্রকৃতিরই অংশ। একজন ভাল মানুষের তথা ভাল শিক্ষকের কড়া শাসনও শিক্ষার্থীরা মেনে নেয়। কারণ তারা দেখে, স্যারের উদ্দেশ্য নিশ্চিতভাবেই ভালো ছিল। ভালো শিক্ষক হওয়ার আগে ভালো মানুষ হওয়া বেশি দরকার। আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়িত্বশীল নয়, সময়ানুবর্তী নয়, সৃজনশীল শিক্ষাদানে আগ্রহী নয়। আর এই ব্যাপারগুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে খটকা তৈরি করে। এটা দিবালোকের মতই সত্য। ফলে বিদ্যালয়গুলো হতে জিপিএ-৫ বের হচ্ছে কিন্তু শৃঙ্খলা বের হচ্ছে না। এরাইতো বড় হয়ে অফিস-আদালতে অফিসার হিসেবে যোগদান করছে। অফিসে এসে দায়িত্ব, ন্যায়পরায়ণতা, শৃঙ্খলাপরায়ণতাকে তারাই সেকেলে ধ্যানধারণা বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। ফলে পুরো সমাজ আজ শৃঙ্খলাহীনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। দু’একজন শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হয়ে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। যে শিক্ষক বিদ্যালয়ে তিন দিন আসে, যে শিক্ষক নিজের ছাত্রকেই প্রাইভেট কোচিংয়ে ডাকে, শিক্ষার্থীরা তাকে টাকার মাপে পরিমাপ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এতে সমাজে ঐ শিক্ষকের অবস্থান হয়ে যায় অনেকটা আঁস্তাকুড়ে। এজন্যই আজ শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষকের সম্মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
আমাদের সরকারি অফিসগুলোতে শৃঙ্খলাপরায়ণতার দৈন্য মহামারি রূপ ধারণ করেছে। সেবাগ্রহীতারা অফিসে প্রবেশ করে ভয় নিয়ে আর বের হয় বকা দিতে দিতে। ৯টার অফিস কয়টায় খুলে কেউ জানে না। আবার অফিস খুললেও বস্ টেবিলে নেই। বস্ টেবিলে থাকলেও ব্যস্ত আছি বলে সেবাগ্রহীতাকে তাড়িয়ে দেয়। একটি বানান ভুলের জন্যও কখনো একটি ফাইল হয়তো একমাস আটকে থাকে। দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর দেখা গেলো ফাইলটা হারিয়ে গেছে। বড় বড় বসরা আজকাল মিটিং-সিটিং নিয়েই বেশী ব্যস্ত থাকে। অথচ দক্ষিণ চট্টগ্রাম হতে ঢাকায় এসে একজন সেবাগ্রহীতা তার পিছনে পাঁচ মাস ধরে ঘুরছে। আর সেদিকে তার কোন খেয়ালি নেই। আইনের প্রয়োগ, জবাবদিহিতা না থাকলে শৃঙ্খলা কোনো কালেই তৈরি হবে না। যারা জবাবদিহিতা গ্রহণ করবে তারাই আমাদের সমাজে বেশী শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে। তাই আজ এই অবস্থা। প্রশ্নটা হচ্ছে, আমরা প্রকৃতই দেশকে ভালোবাসি কিনা? যদি বাসি তাহলে প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার চর্চা করতে হবে এবং সেটা শুরু হবে শৈশব কাল থেকেই।
লেখক: ড. কে এম আতিকুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।