এখন সাম্য কেবল ঈদের জামাতেই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী  © সম্পাদিত

ঈদ উৎসবের, আনন্দের, উচ্ছ্বাসের। কিন্তু, সে উচ্ছ্বাস আনন্দ আর উৎসব কতটুকু দেশের সাধারণ মানুষের হয়েছে? ঈদ কতটুকু আনন্দ সমানভাবে ছড়াতে পারছে সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থায়? ঈদকে সাম্যের উৎসব বলা হলেও, কতটা সাম্য বজায় থাকে আমাদের ঈদ উদযাপনে। ঈদ উদযাপনের একাল-সেকালসহ বদলে যাওয়া সামাজিক-রাষ্ট্র-কাঠামোয় ঈদ নিয়ে শিক্ষা, শিক্ষাঙ্গন ও তারুণ্যের গল্পে সাজানো পূর্ণাঙ্গ নিউজ-পোর্টাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হয়েছেন লেখক, প্রাবন্ধিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি খোলাখুলি কথা বলেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে; তার চৌম্বক অংশ তুলে ধরা হয়েছে পাঠকদের জন্য। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের নিজস্ব প্রতিবেদক খাঁন মুহাম্মদ মামুন

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পক্ষ থেকে আপনাকে ঈদের শুভেচ্ছা।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাদেরও ঈদের শুভেচ্ছা। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঈদ নিয়ে আপনার সবচেয়ে ভালো বা উল্লেখযোগ্য স্মৃতি বা ঘটনা কী?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ঈদের সবচেয়ে ভালো আনন্দ হচ্ছে শৈশবের আনন্দ; ঈদ আসলে তরুণদের জন্য, শিশু-কিশোরদের জন্য। আর আমাদের সময়ে যে ঈদ কেন্দ্রিক একটি সামাজিক বন্ধন আমরা দেখতাম এখন আর তা নেই। আমাদের সময়ে ঈদে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাওয়া, খাওয়া দাওয়া করা-এখন আর তা দেখা যায় না; এখন তো এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাওয়াই কঠিন হয়ে গেছে। এখন হয়তো শিশুরা নতুন জামা কাপড় পায়; তা আবার সবার ক্ষেত্রেও না। এখন বৈষম্য আরও বেড়েছে; দরিদ্র ঘরের শিশুরা এখনো নতুন জামা পায় না। অর্থাৎ, ঈদ এখন আর আগের সে ঈদ নেই; পুঁজিবাদী আর ভোগবাদী বিলাসী সমাজ কাঠামোয় তা হারিয়ে গেছে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঈদ আসলে সামাজিক মেলবন্ধনের আর আনন্দের হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা না হয়ে বরং সমাজে বৈষম্য আরও বেড়েছে। তাহলে এ-ই সামাজিক পরিবর্তন কী আমাদের বদলে যাওয়া সমাজ কাঠামো এবং রূপান্তরিত রাষ্ট্র কাঠামোরই আপেক্ষিক ফল?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অবশ্যই, অবশ্যই; এটি নির্ভরশীল ছিল আমাদের স্বাধীনতার পর আমাদের দেশের ক্ষমতা কাদের হাতে থাকবে। পাকিস্তান আর থাকবে না—এটা বোঝা যাচ্ছিল যখন উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হয়। তখন দুটি ধারা ছিল একটি জাতীয়তাবাদী ধারা এবং একটি পুঁজিবাদী ধারা। জাতীয়তাবাদীরাই পুঁজিবাদের পক্ষে ছিল এবং তারা পুঁজিবাদ চেয়েছে; এটি ব্রিটিশ আমলে চেয়েছে, পাকিস্তান আমলে চেয়েছে এবং বাংলাদেশ আমলেও চেয়েছে। আর সমাজতন্ত্রের পক্ষে যারা ছিল তারা চেয়েছে সামাজিক মালিকানা। কিন্তু, যারা সামাজিক মালিকানা চেয়েছে তারা খুব বেশি ক্ষমতায় আসতে পারেনি। যারা ছিল বা এসেছে তারা একটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেছে তা হলো পুঁজিবাদী ধারা। ফলে, ক্ষমতা বা রাষ্ট্র কাঠামোয় কোন রূপান্তর হয়নি; যা দরকার ছিল। রূপান্তর বলতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি; অর্থাৎ রাষ্ট্র মালিকানা জনগণের হবে এবং তা কোন নির্দিষ্ট শ্রেণির কাছে আবদ্ধ থাকবে না—স্বাধীনতার যে দাবি ছিল, তা পূরণ হয়নি। ফলে, স্বাধীনতা আমাদের রাজনৈতিক মুক্তি দিলেও, সকল মানুষকে যে দাবি ছিল তা পূরণ হয়নি; অর্থাৎ স্বাধীনতা সকলকে মুক্তি দিতে পারেনি। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি ঈদের আনন্দ হারিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন, তাহলে আমাদের ঈদের সে আমেজ বা আনন্দ আবারও ফিরিয়ে আনা সম্ভব কি-না? 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সেজন্য আমাদের সামাজিক আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে। সমাজ বদলের যে আন্দোলন তা অব্যাহত রাখতে হবে। সমাজ কাঠামোয় এখনও আপনি পুঁজিবাদী ছাপই দেখবেন। এ-ই যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের মারামারি, তা কেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের মানুষ আর বাইরের মানুষ তারা দু'মানুষই তো একই মানুষ। তারা একে অপরের সাথে মিশবে, একে অপরের উপকার করবে-তা হয়নি। হয়নি কারণ, পুঁজিবাদের দেওয়াল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের মানুষ আর ভেতরের মানুষকে আমরা এক করতে পারিনি। ফলে, আমাদের সামাজিক যে দাবি ছিল, তা পূরণ হয়নি। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঈদকে কেন্দ্র করে আমাদের সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিনগুলো বিশেষ সংখ্যা বের করছে, তা আপনাদের সময়ে কেমন ছিল এবং এখন তার কেমন রূপান্তর ঘটেছে; পাশাপাশি তা যে সাহিত্য মানের প্রশ্ন-তার মূল্যায়ন আপনি কীভাবে করবেন? 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এখন তো আর সে আমেজ নেই; আমাদের সময়ে শুধু ঈদ সংখ্যা না পশ্চিম বঙ্গ থেকে প্রকাশিত পুঁজো সংখ্যার জন্যও আমরা অপেক্ষা করতাম এখন আর তা নেই। এখন ঈদ কেন্দ্রিক বিশেষ সংখ্যা বের করা হয় বিজ্ঞাপন ছাপানোর জন্য। আর বিজ্ঞাপন ছাপানো হয় লাভের জন্য; অর্থাৎ এখন ঈদ সংখ্যাও আপনার লাভ ক্ষতির হিসেবে চলে গিয়েছে। এখন সাহিত্য বা লেখা ছাপানো হয় বিজ্ঞাপন ছাপানোর একটি অংশ হিসেবে। কেননা শুধু বিজ্ঞাপন ছাপানো হলে তো তা আর কেউ নেবে না। অর্থাৎ সাহিত্য এখানে একটি অনুষঙ্গ মাত্র, উদ্দেশ্য হচ্ছে লাভ করা। সেটা পশ্চিম বঙ্গের পুঁজোর সংখ্যায় যেমন হয়েছে, আমাদের এখানে ঈদ সংখ্যায়ও তা-ই হয়েছে। আর তরুণ লেখক সৃষ্টি করা বা সাহিত্য মান বিচারের বিষয় সম্পাদক হয়তো চিন্তা করেন। কিন্তু, তিনিও তো কারো অধীন; তাকে যতটুকু অনুমোদন দেওয়া হয় তিনি ততটুকুই ছাপাতে পারেন। অর্থাৎ সাহিত্য মান দেখার সুযোগ খুব বেশি থাকে না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি সাম্যের কথা বলেছেন, আমাদের সমাজে তো সাম্য এখন একটি কেবল কথার কথায় পরিণত হয়েছে; অর্থাৎ এখন তা দেখা যায়না; তাহলে, আমাদের ঈদ আসলে কেমন হওয়া উচিৎ? 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ঈদ ধর্মীয় আবহে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান, যদিও একে ধর্মীয় উৎসব বলা হয়; কিন্তু, এটি আসলে একটি সামাজিক উৎসব। এখানে রোজা বা ধর্মীয় বিধানগুলো একক ভাবে পালন করা হলেও, ঈদের উৎসব সবাই মিলেই আমরা করি। ঈদের জামাতে ধনী দরিদ্র সকলকে একসাথে করার একটি চেষ্টা আমরা করি। পাশাপাশি, অন্য ধর্মের যারা থাকে তাদেরও আমরা এ উৎসবে অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়। অর্থাৎ, ঈদ একটি সামাজিক উৎসব।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি বলেছিলেন, ঈদকে সাম্যের উৎসব বলা হলেও আসলে বৈষম্যই বেশি—এ নিয়ে আপনার অভিমত কী?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: তা অবশ্যই, এখন ঈদে সাম্য শুধুমাত্র ঈদের জামাতেই; এরপর আর কোন সাম্য থাকে না। এখন ঈদ কেন্দ্রিক যে বিলাসী প্রতিযোগিতা তাতেও তো সাম্য থাকে না। অর্থাৎ, পুঁজিবাদী সমাজ রূপান্তরের ফলে ঈদ উদযাপনও এখন বৈষম্যমূলক হয়েছে। পাশাপাশি, শ্রেণি বৈষম্যের কারণে আবার সবাই সবার সাথে মিশতেও পারে না। ঈদ কেন্দ্রিক পোশাক-আশাক, উপহার উদযাপন সবখানেই সবাই তাদের ধনের সামর্থ্য দেখাতে চাই, ফলে তা আর সাম্যের থাকে না। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে আবারও ঈদের শুভেচ্ছা; ভালো থাকবেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাদেরও ঈদের শুভেচ্ছা।


সর্বশেষ সংবাদ